মদ্যপান মানেই জিভে ঝাঁঝালো অনুভূতি, শরীরে হালকা উষ্ণতা আর মুহূর্তের মধ্যেই মন ও মেজাজে পরিবর্তন। অ্যালকোহল শরীরে ঢোকার পর দ্রুত রক্তে মিশে প্রায় সব কোষে পৌঁছে যায়। এর মূল কারণ এর রাসায়নিক গঠন। ইথানল নামের এই ক্ষুদ্র অণু সহজেই রক্ত-মস্তিষ্কের দেয়াল পেরিয়ে যায়। আর তখনই শুরু হয় তার প্রভাব।
ইতিহাস জুড়ে মানুষের জীবনে মদের ভূমিকা
মানুষের ইতিহাসে মদের প্রভাব কেবল আনন্দে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সভ্যতা গঠনের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। গাছ থেকে নেমে মাটিতে বসবাস শুরু করা পূর্বপুরুষদের সময় থেকেই এই সম্পর্কের শুরু। গবেষকদের মতে, প্রায় এক কোটি বছর আগে মানুষ, শিম্পাঞ্জি ও গরিলার পূর্বপুরুষদের শরীরে এমন জিনগত পরিবর্তন ঘটে, যা অ্যালকোহল দ্রুত ভাঙতে সাহায্য করত। সেই সময় পরিবেশ বদলে যাচ্ছিল, বন উজাড় হচ্ছিল, অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়। যারা টিকে ছিল, তারা মাটিতে পড়ে থাকা পচা ফল খেতে শুরু করে, যেখানে প্রাকৃতিকভাবে অ্যালকোহল তৈরি হতো।
এই অভ্যাস থেকেই জন্ম নেয় ‘মাতাল বানর’ তত্ত্ব। ধারণাটি বলছে, গাঁজানো ফলের গন্ধ ও স্বাদ আমাদের পূর্বপুরুষদের আকৃষ্ট করত, কারণ এতে ছিল বেশি শক্তি। যদিও সেই অ্যালকোহলের মাত্রা ছিল হালকা, আধুনিক বিয়ার-এর কাছাকাছি।
ইচ্ছাকৃতভাবে মদ তৈরির শুরু
একসময় মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে মদ তৈরি করতে শেখে। চীনের জিয়াহু অঞ্চলে প্রায় দশ হাজার বছর আগের পাত্রে চাল, ফল ও মধু দিয়ে তৈরি পানীয়ের চিহ্ন মিলেছে। সম্ভবত এরও আগে বিভিন্ন পাত্রে এই পানীয় বানানো হতো।
সমাজ গঠনে মদের ভূমিকা
বড় সমাজে বিশ্বাস তৈরি করা সহজ নয়। গবেষক রবিন ডানবারের মতে, হালকা মাতলামি যুক্ত আচার-অনুষ্ঠান বড় দলকে একত্রে রাখতে সাহায্য করেছে। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, গান, নাচ, গল্প বলা ও উপাসনার সময় মদ মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়াত। এতে শরীরে এন্ডরফিন নিঃসৃত হয়, যা আনন্দ, চাপমুক্তি ও অন্তর্ভুক্তির অনুভূতি দেয়। ফলে অপরিচিতদের সঙ্গেও সহযোগিতা সহজ হতো।

মস্তিষ্কে প্রভাব ও সামাজিক আচরণ
অ্যালকোহল মস্তিষ্কের বিচার-বিবেচনার অংশকে সাময়িকভাবে ধীর করে দেয়। এতে মানুষ বেশি খোলামেলা, কম সংকোচী হয়ে ওঠে। অন্যের কথা মজার লাগে, সামাজিকতা বাড়ে। ইতিহাস জুড়ে তাই উৎসব, ধর্মীয় আচার এমনকি শ্রমের বিনিময়েও মদের ব্যবহার দেখা যায়।
সভ্যতার পূর্বশর্ত কি মদ
কিছু গবেষকের মতে, বড় ও জটিল সমাজ গঠনের পেছনে মদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মদ মানুষের সৃজনশীলতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে। যদিও আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষির প্রভাব বাদ দিলে মদ ও রাজনৈতিক জটিলতার সম্পর্ক খুব শক্তিশালী নয়। বিতর্ক তাই চলছেই।
আধুনিক যুগে বিপদ ও প্রশ্ন
আজ মদ আগের চেয়ে অনেক সহজলভ্য। কিন্তু এর ক্ষতিও স্পষ্ট। বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর প্রায় আঠারো লাখ মানুষের মৃত্যু মদের অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত। একসময় সীমিত মদ্যপান উপকারী মনে করা হলেও সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, অল্প পরিমাণেও ঝুঁকি আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
তরুণ প্রজন্মের বদলে যাওয়া মনোভাব
সমৃদ্ধ দেশগুলোতে তরুণদের মধ্যে মদ্যপান কমছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন গেমিং ও স্বাস্থ্য সচেতনতা এর পেছনে বড় কারণ। অনেকেই মদকে ব্যয়বহুল ও ক্ষতিকর মনে করছে।
নেশাহীন নেশার খোঁজ
এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে পানীয় শিল্প নতুন পথে হাঁটছে। অ্যালকোহলবিহীন বা কম অ্যালকোহলের পানীয়ের বাজার দ্রুত বাড়ছে। ভেষজ উপাদান দিয়ে তৈরি ‘কার্যকরী পানীয়’ মন শান্ত করা বা সামাজিকতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। যদিও এগুলো এখনো মদের পূর্ণ বিকল্প নয়, তবু আগ্রহ বাড়ছে।
ভবিষ্যতের পানীয় সংস্কৃতি
গবেষকরা এমন উপাদান তৈরির চেষ্টা করছেন, যা মদের মতো অনুভূতি দেবে কিন্তু ক্ষতি করবে না। যদি এসব সফল হয়, তাহলে ভবিষ্যতে মানুষ হয়তো সংযমে ফিরবে। উদযাপনের গ্লাসে থাকবে ভিন্ন স্বাদ, ভিন্ন অভ্যাস।
মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে মদের সঙ্গে অভ্যস্ত। এই অভ্যাস রাতারাতি বদলাবে না। তবে ধীরে ধীরে পানীয়ের আলমারি বদলাচ্ছে। কেউ এতে হতাশ, কেউ আশাবাদী। হয়তো একদিন সংযমই হবে নতুন নেশা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 
























