০৩:০৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

শামসুর রাহমান : তাঁর কাছে  খোলা চিঠি 

  • Sarakhon Report
  • ০৪:৪৫:২০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৪
  • 18

আসাদ মান্নান 

প্রিয় কবি!  আপনার কি মনে আছে সেদিনের কথা? না, আপনার স্মরণে থাকার কথা নয় —  ভুলে গেছেন এ পারের সব কোলাহল, অন্তরঙ্গ  নির্জনতা ।  কিন্তু আমরা আপনাকে কী করে ভুলবো; ভুলিনি।  রক্ত গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে, খাণ্ডবদাহন দেখতে দেখতে  আপনি যে স্বাধীনতার অপেক্ষা করেছিলেন বহু দিন বহু রাত ধরে, যে স্বাধীনতার জন্য — উদাস দাওয়ায় বসে থাকে এক থুত্থুরে বুড়ো, দগ্ধ ঘরের নড়বড়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মোল্লাবাড়ির করুণ বিধবা, যে স্বাধীনতার জন্য হাড্ডিসার এক কিশোরী শূন্য থালা হাতে বসে থাকে পথের ধারে,শাহবাজপুরের জোয়ান কৃষক সগীর আলী, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি মতলব মিয়া, জেলেপাড়ার সাহসী লোক  কেস্ট দাস — ওরা সবাই অধীর প্রতীক্ষা করেছিল ।  দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে সেই স্বাধীনতার আংশিক দেখা মিললো   লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বদলে। রবীন্দ্রনাথের অঝোর কবিতার মতো ,  ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো কাজী নজরুলের সৃষ্টি সুখের গান গাইতে গাইতে  একদিন সেই স্বাধীনতা এলো বিশ্বকবির সোনার বাংলায়, নজরুলের বাংলাদেশে,জীবনানন্দের রূপসী বাংলায়   — কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!
প্রিয় কবি!  আপনার প্রয়াণ দিবসে আজ আমি ও আমরা গভীরভাবে শোকাহত;  কিন্তু শোক জানাবার উপযুক্ত শব্দ নেই,  ফুলগুলো  আমি খুঁজি কিন্তু পাইনা, আমার চোখে এখন দীর্ঘ অসুখ। কখনো কখনো বা হয়তো বাগানের ফুলও ঝরে যায়। হঠাৎ প্রচণ্ড এক কালবৈশাখি ঝড়ের তান্ডব! সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে রক্তে ভেজা  স্বাধীনতা  স্বরূপে হাজির হলো– কেউ খুব উল্লসিত, কেউ কেউ মলিন বদনে বসে আছে বিষন্ন ডেরায়। এমনটাই স্বাভাবিক — নিয়তির লেখন কে আর খন্ডন করতে পারে! জনম দুঃখিনী বাংলা। স্থির সুখ নেই, শান্তি  নেই যার কপালে— এ যেন সেই মাতা যার আঁচল ওড়ে কেবলই ঝড়ের বাতাসে।

২.
গতসন্ধ্যায় স্বভাব বশত  আমার বাইশ মাস বয়সী নাতনি  একটা অবাক  কাণ্ড করে বসে।  আমার বইয়ের জরাজীর্ণ  মলিন  তাক থেকে   একটা  জরাজীর্ণ  ছেঁড়া  বইয়ের কয়েকটি পাতা ছিঁড়ে ফেলে অবুঝ  আরুশি!  সেই ছেঁড়া পাতাগুলো জায়নামাজে সেজদারত  তার নানির কপালের কাছে  ছড়িয়ে দিয়ে  খিল খিল করে হেসে ওঠে।  ওর হাসির শব্দ শুনে আমি দৌঁড়ে গিয়ে দেখি —  বহুদিন ধরে প্রায় পরিত্যক্ত বইয়ের  ছেঁড়া  কাগজের টুকরোগুলো আর কিছু  নয়, আপনার একটি কবিতার বই ‘ এক ফোটা কেমন অনল’ – এর দু’তিনটি পাতা। এ বইয়ের  অসামান্য  কবিতাগুলো আগে পড়েছি, আজ আবার পড়লাম। এ গ্রন্থের  কবিতাগুলোর তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা কখনো ফুরিয়ে যাবে না।

প্রিয় কবি! আপনি   রূপালি জ্যোৎস্নায় স্নাত বাংলা কবিতার এক ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’। মা ও মাতৃভূমি যখনই  অপমানিত হয়েছে সবার আগে  আপনি ব্যথিত হয়েছেন, ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আমরা দেখেছি  আমৃত্যু অশুভের  বিরুদ্ধে অসীম সাহসে অক্ষরের হাতিয়ার হাতে দাঁড়িয়েছেন অকুণ্ঠ চিত্তে।

৩.
আজ থেকে আঠারো বছর আগে আগস্টের এই দিনে  সতেরো তারিখ  গোধূলির শেষ লগ্নে অস্তগামী সূর্যের আভার আলোয় আপনি অনন্তের মহালোকে পাড়ি দিয়েছিলেন। সেদিও যেমন আপানাকে ছাড়তে কেঁদে উঠেছিলো মন আজ  বারবার আপনার কথা মনে পড়ে কাঁদছে মন।  মনে পড়বে না কেন প্রিয় কবি!  আপনি যে মানবপ্রেমী কবি– বাংলা সাহিত্যে  সত্য ও সুন্দরের অন্যতম সেরা একজন  মানবতাবাদী  কবি আপনি–আপনার কবিজন্ম ধন্য; এ জন্য ধন্য যে জীবদ্দশাতেই আপনি লাভ করেছেন অগুণতি পাঠকের ঈর্ষাতুর ভালোবাসা। পাঠকের ভালোবাসাই তো একজন কবির অমূল্য অর্জন। বলুন তো কবি এ অর্জনের পেছনে কী এমন জাদুকরী শক্তি ছিল আপনার হাতে ?
বাংলা ভাষার একজন মহত্তম কবি হিসেবে  আপনি মানুষ ও মানবতার পতাকা উড়িয়েছেন স্বতন্ত্র মহিমায়। ঈর্ষণীয় নিষ্ঠা ও নিরলস  সাধনায় আমার কাছে  আপনি  অতুলীয়।  এর অন্তর্নিহিত রহস্যের মূলে কী ছিলো? যদি বলি  ভালোবাসা! হ্যাঁ,  মানুষ ও মাতৃভূমির  প্রতি আপনার গভীর মমতা আর অফুরান  ভালোবাসা। এই ভালোবাসাই তো আপনাকে বাংলাদেশের অন্যতম কবির মর্যাদা দিয়েছে। সে মর্যাদার আসন থেকে আপনাকে সহজে হটানো যাবে কি?
রাহমান ভাই!
আপনার অজস্র কবিতায়  নিরন্তর মানুষ ও মানবতার জয় গান গেয়েছেন কবি!  এখানে  তেমন একটি কবিতার কথা বলতে চাই। ‘এক ফোটা কেমন অনল’ গ্রন্থের ছোট্ট একটি সহজ সরল কবিতা– ‘পান্থজন’। এখন আপনার স্মরণে কিছু নেই,থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা পাঠকেরা কখনো ভুলিনি ।
মনে আছে, যখন প্রবলভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে  সাম্প্রদায়িকতার নাগিনী বিষদাঁত গজায়, ছোবল মারতে উদ্যত  ফণা তোলে তখন এ কবিতাটি লেখা হয়েছিল। একটি বিখ্যাত  দৈনিক কাগজের  সাময়িকীর পাতায় এটি প্রথম  প্রকাশিত হয়। কবিতাটির  অপূর্ব বাচন শৈলী  এবং এর চিরন্তন মর্মবাণী পাঠকের মন ছুঁয়ে,মানুষের মনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিকাশ ঘটায় ।   প্রায়শই  কবিতাটি পাঠ করি।  আজ আবার পড়লাম।  শুধু গরীব ও অনগ্রসর দেশে নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশে বর্তমানে সভ্যতা ও মানবতার চরম সংকট বিরাজমান।  জানি না, এই ভীতিকর মহামারি থেকে আমরা কবে  মুক্ত হতে পারবো ।  আজকের দিনে এ কবিতার প্রাসঙ্গিকতা আমাদেরকে একটি বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে শক্তি ও সাহস যোগাবে কি? এতে  অনেক পাঠকের মতো আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
মূলত এ বিবেচনা থেকেই পুরো  কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করছি–
” বহু পথ হেঁটে ওরা পাঁচজন গোধুলিতে
এসে বসে  প্রবীণ বৃক্ষের নিচে ক্লান্তি মুছে নিতে।
গাছের একটি পাখি শুধায় ওদের —
‘ বলতো তোমরা কারা?’ প্রশ্ন শুনে পান্থজন
ঝুঁকে পড়ে নিজের বোধের
কাছে ; বলে একজন, ” হিন্দুত্বের প্রতি আজন্ম আমার টান।”
দ্বিতীয় জনের কণ্ঠ বাঁশির মতন
বাজে, ‘ আমি বৌদ্ধ, হীনযান।’
এবং তৃতীয় জন বলে, ‘ আমি এক নিষ্ঠাবান বিনীত খ্রীষ্টান,’
চতুর্থ পথিক করে  উচ্চারণ, আমার ঈমান
করেছি অর্পণ আমি খোদার আরশে,
আমিতো মুসলমান। ‘
পঞ্চম পথিক খুব কৌতূহলবশে
কুড়িয়ে পতঙ্গ এক বলে স্মিত স্বরে, আমি মানব সন্তান। ‘
প্রিয় কবি!  একজন খাঁটি  মানবতাবাদী কবি বলে আপনার কলমে এরকম একটি চিরকালীন  সহজ সরল মহৎ কবিতার জন্ম হয়েছে । আমৃত্যু আপনি এধরনের অজস্র কবিতা লিখেছেন। নমস্য কবি! আপনার কাছে আমরা ও আমাদের মাতৃভাষা চিরঋণী।


৪.
স্বীকার করতেই হবে,  আজ  আপনি বেঁচে থাকলে অবশ্যই আরও কিছু কালজয়ী কবিতা পেতাম আমরা।
অকুণ্ঠ চিত্তে সবাই  স্বীকার করেন যে, শামসুর রাহমান এদেশের এক বিরল মধুর স্বভাবের কবি। আমিও  বলি, প্রিয় কবি!ব্যক্তিস্বার্থের ওপরে উঠে মানুষের  সহজাত  লোভ-লালসা, কাম-ক্রোধ, ঈর্ষা ইত্যাদি নেতিবাচক দোষ ত্রুটিকে দূরে  ঠেলে  আপনি ধীরে ধীরে  হয়ে গেলেন বিশুদ্ধ মনের  একজন নির্মল  চিত্তের  বিনয়ী মানুষ। অতুলনীয় মানবিক মূল্যবোধে অটুট থেকে আপনি আজীবন লড়াই করেছেন কথায় কলমে –শুদ্ধাচারী কুলীন  ঋষির মতো, চারপাশ থেকে বিবিধ – অপচ্ছায়া তাড়াতে চেয়েছেন নিরন্তর । জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছেন অশুভের বিরুদ্ধে।
আপনি মনেপ্রাণে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে মুক্তচিন্তা ও উদার  গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ব্যতীত সম্প্রীতির  সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। এর অভাবে একজন ব্যক্তির মানব জন্ম অসম্পূর্ণ  রয়ে যায় । কতবার কতখানে আপনার মুখে শুনেছি  সম্প্রীতি ছাড়া সমাজ ও ব্যক্তির জীবনে শান্তি আসে না। আপনি জানতেন যে, অগণতান্ত্রিক দূষিত পরিবেশ-পরিসরে  থাকতে থাকতে একটা দেশ ও তার জনগণ কী দুঃসহ দহন যাতনায় বিদ্ধ হয়ে ককিয়ে ওঠে; মানুষের জীবনে শান্তি বা স্বস্তি না থাকলে সামনে হাঁটা কষ্টদায়ক ।  আর কবি হলে তো কথাই নেই!

একজন কবিই পারেন  তাঁর আপন জাতি ও মাতৃভূমির ব্যথা বেদনাকে নিজ বুকে ধারণ করতে।  আপনি ভাগ্যবান বটে ; নিজের সমগ্র কবিজীবনে বহন করেছিলেন আপন দেশ-জাতি ও মানুষের মনের যন্ত্রণা  ও বেদনাকে।

আজ আপনাকে খুব বেশি করে মনে পড়ছে  রাহমান ভাই! আপনি নেই,  কিন্তু আপনার হাজার কবিতা আমাদেরকে শক্তি ও সাহস দিচ্ছে ;  সামনের দিকে এগিয়ে যাবার প্রেরণা যোগাচ্ছে ।  কেউ স্বীকার করুক বা না করুক আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি,  আপনার বহুবিধ  কবিতা পাঠে  সব বয়সী পাঠকেরা আনন্দ ও প্রেরণা  লাভ করেন, তাঁরা নিজের দেশটাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসার মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন । আগামী দিনেও সেই আনন্দ ও প্রেরণা লাভ করে আমাদের  তরুণ  প্রজন্ম দেশটাকে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ হবে, একটা  উন্নত বাংলাদেশ তৈরি করতে সক্ষম হবে।


৫.

কবি ও কবিতার দেশ বাংলাদেশ । প্রতিবছর ঝাঁকে ঝাঁকে, আঁকে বাঁকে বহু কবি আসছেন, আগামীতেও আসবেন। কিন্তু কতজন কালের মঞ্চে কালোত্তীর্ণ  জ্যোতি ছড়াবেন তা আমি জানি না; জানার প্রয়োজনও বোধ করি না।  তবে এটা জানি, মনে করি আপনিও আমাদের দুঃখিনী বর্ণমালার  একজন নশ্বরতা জয়ী অমর কবি। মৃত্যু আপনাকে কাল থেকে কালান্তরে পাঠকের মন থেকে হরণ করতে পারেনি,  আগামীতেও পারবে না।
বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের পরাধীন সোনার বাংলায়– আমাদের রক্তে রাঙা  অবহেলিত  জনপদে আপনার জন্ম হয়েছিল জরাজীর্ণ এক মলিন  শহরে, যাকে ঠিক নগর বলা যায় না। জন্মের পর এ শহর ঢাকায় আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে ; যৌবনকে স্বাগত জানিয়েছেন তুমুল  উদ্দামতা দিয়ে।  এ শহরের স্মৃতি নিয়ে আপনার একটি অসামান্য স্মৃতিগ্রন্থ রয়েছে — ‘স্মৃতির শহর’।
বৃটিশ ভারত ছেড়ে চলে গেলে  সবার মতো আপনিও একটা অশুভ শক্তির অধীন  স্বাধীন দেশ পেয়েছিলেন। সেই দেশে স্বাধীনতার নামে কী ঘটেছিলো তা আমার চেয়ে  আপনিই ভালো জানেন,  কবি! দেখতে না দেখতে   আপনি ও আপনার সঙ্গীরা  বুঝতে পেরেছিলেন যে, বৃটিশ চলে গেলেও পরাধীনতা যায়নি,  বরং আরও তীব্রভাবে সমাজের সর্বস্তরে শৃঙ্খল নিয়ে ঝাঁকিয়ে বসেছে।  শুরু হয় সেই শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রাম-লড়াই।  আপনি এ লড়াইয়ে একজন কলম সৈনিক হয়ে আমৃত্যু  লড়াই করেছেন। বিশেষ করে সেই  আন্দোলন-লড়াই কেন্দ্রিক আপনার অপূর্ব সব কবিতা পাঠ করে সবাই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। সেসব আজ ইতিহাস।

প্রিয় কবি!
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত  দীর্ঘ সময় পরিক্রমায় আপনি ছিলেন এক টালমাটাল সময়ের সরব  সাক্ষী– ক্ষতবিক্ষত সময়ের কলম চিত্রকর,   নান্দনিক  রূপকার । বেদনা ও নির্জনতা কখনো কখনো তীব্র বেগে লতিয়ে উঠেছে আপনার কবিতায়। পাঠক  আক্রান্ত হয় প্রবলভাবে। কবিতার একজন সামান্য পাঠক আমি  আপনাকে গভীরভাবে অনুভব করি। আপনার কবিতায় পাঠক  কখনো কখনো  মা ও মাতৃভূমির কান্নার হাহাকার খুঁজে; আমি কিন্তু   বারুদের  গন্ধ খুঁজে পায়। এ গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে  কাল রাতে আমি  স্বপ্নের   ভেতরে  ‘আসাদের শার্ট ‘ গায়ে রাজপথে নেমে যাই — জনতার ঢল নামে মিছিলে মিছিলে — গুলি চলে নির্বিচারে, রক্তে ভাসে রাজপথ, অলিগলি। লাশের ওপরে লাশ। এত লাশ! আপনার ‘ নিজ বাসভূমে’কাব্যের একটি বিখ্যাত কবিতা — রাজকাহিনী।  এ কবিতার অবিস্মরণীয় কয়েকটি পঙক্তি :–.
“এ লাশ আমরা রাগবো কোথায়?
তেমন যোগ্য সমাধি কই?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল সাগর- জল–
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই।
তাইতো রাখিনা এ লাশ আজ
মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই। ”
সন্তান হারানোর বেদনা মায়ের বুকে কত যে তীব্র হয়ে বাজে , তা শুধু  সে মা- ই জানের- যিনি হারিয়েছেন চোখের মণি বুকের ধন প্রিয় সন্তান। আপনিও জানেন কবি!  কারণ প্রিয় শিশু পুত্র মতিনের পানিতে ডুবে বেদনাদায়ক  অকাল মৃত্যু আপনি কখনো মেনে নিতে পারেননি;  আমৃত্যু পুত্রশোক  আপনাকে কাতর করেছে ; ব্যথার  আগুনে আপনাকে  পুড়িয়েছে। মতিনের প্রসঙ্গ এলে দেখেছি  আপনি কেমন বিষন্নতার অতলে হারিয়ে যেতেন অবচেতনে।
আমিও আজ বিষন্ন মনে আপনাকে  বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই প্রিয়  কবি! জেগে জেগে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি কয়েক দিন ধরে। এই দুঃসহ দুঃস্বপ্নে দেখি :  হঠাৎ একটা গুলি আমার খুলির মধ্যে  শকুনির  ঠোঁটের মতন বিঁধে গেলো।  মুণ্ডহীন আমি ; শূন্যতার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি, একা। চোখ বন্ধ, কিছুই দেখছি না।

ইতি–
আপনার স্নেহধন্য
এক অতি সাধারণ কবি।
১৭ আগস্ট ২০২৪

 

শামসুর রাহমান : তাঁর কাছে  খোলা চিঠি 

০৪:৪৫:২০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৪

আসাদ মান্নান 

প্রিয় কবি!  আপনার কি মনে আছে সেদিনের কথা? না, আপনার স্মরণে থাকার কথা নয় —  ভুলে গেছেন এ পারের সব কোলাহল, অন্তরঙ্গ  নির্জনতা ।  কিন্তু আমরা আপনাকে কী করে ভুলবো; ভুলিনি।  রক্ত গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে, খাণ্ডবদাহন দেখতে দেখতে  আপনি যে স্বাধীনতার অপেক্ষা করেছিলেন বহু দিন বহু রাত ধরে, যে স্বাধীনতার জন্য — উদাস দাওয়ায় বসে থাকে এক থুত্থুরে বুড়ো, দগ্ধ ঘরের নড়বড়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মোল্লাবাড়ির করুণ বিধবা, যে স্বাধীনতার জন্য হাড্ডিসার এক কিশোরী শূন্য থালা হাতে বসে থাকে পথের ধারে,শাহবাজপুরের জোয়ান কৃষক সগীর আলী, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি মতলব মিয়া, জেলেপাড়ার সাহসী লোক  কেস্ট দাস — ওরা সবাই অধীর প্রতীক্ষা করেছিল ।  দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে সেই স্বাধীনতার আংশিক দেখা মিললো   লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বদলে। রবীন্দ্রনাথের অঝোর কবিতার মতো ,  ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো কাজী নজরুলের সৃষ্টি সুখের গান গাইতে গাইতে  একদিন সেই স্বাধীনতা এলো বিশ্বকবির সোনার বাংলায়, নজরুলের বাংলাদেশে,জীবনানন্দের রূপসী বাংলায়   — কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!
প্রিয় কবি!  আপনার প্রয়াণ দিবসে আজ আমি ও আমরা গভীরভাবে শোকাহত;  কিন্তু শোক জানাবার উপযুক্ত শব্দ নেই,  ফুলগুলো  আমি খুঁজি কিন্তু পাইনা, আমার চোখে এখন দীর্ঘ অসুখ। কখনো কখনো বা হয়তো বাগানের ফুলও ঝরে যায়। হঠাৎ প্রচণ্ড এক কালবৈশাখি ঝড়ের তান্ডব! সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে রক্তে ভেজা  স্বাধীনতা  স্বরূপে হাজির হলো– কেউ খুব উল্লসিত, কেউ কেউ মলিন বদনে বসে আছে বিষন্ন ডেরায়। এমনটাই স্বাভাবিক — নিয়তির লেখন কে আর খন্ডন করতে পারে! জনম দুঃখিনী বাংলা। স্থির সুখ নেই, শান্তি  নেই যার কপালে— এ যেন সেই মাতা যার আঁচল ওড়ে কেবলই ঝড়ের বাতাসে।

২.
গতসন্ধ্যায় স্বভাব বশত  আমার বাইশ মাস বয়সী নাতনি  একটা অবাক  কাণ্ড করে বসে।  আমার বইয়ের জরাজীর্ণ  মলিন  তাক থেকে   একটা  জরাজীর্ণ  ছেঁড়া  বইয়ের কয়েকটি পাতা ছিঁড়ে ফেলে অবুঝ  আরুশি!  সেই ছেঁড়া পাতাগুলো জায়নামাজে সেজদারত  তার নানির কপালের কাছে  ছড়িয়ে দিয়ে  খিল খিল করে হেসে ওঠে।  ওর হাসির শব্দ শুনে আমি দৌঁড়ে গিয়ে দেখি —  বহুদিন ধরে প্রায় পরিত্যক্ত বইয়ের  ছেঁড়া  কাগজের টুকরোগুলো আর কিছু  নয়, আপনার একটি কবিতার বই ‘ এক ফোটা কেমন অনল’ – এর দু’তিনটি পাতা। এ বইয়ের  অসামান্য  কবিতাগুলো আগে পড়েছি, আজ আবার পড়লাম। এ গ্রন্থের  কবিতাগুলোর তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা কখনো ফুরিয়ে যাবে না।

প্রিয় কবি! আপনি   রূপালি জ্যোৎস্নায় স্নাত বাংলা কবিতার এক ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’। মা ও মাতৃভূমি যখনই  অপমানিত হয়েছে সবার আগে  আপনি ব্যথিত হয়েছেন, ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আমরা দেখেছি  আমৃত্যু অশুভের  বিরুদ্ধে অসীম সাহসে অক্ষরের হাতিয়ার হাতে দাঁড়িয়েছেন অকুণ্ঠ চিত্তে।

৩.
আজ থেকে আঠারো বছর আগে আগস্টের এই দিনে  সতেরো তারিখ  গোধূলির শেষ লগ্নে অস্তগামী সূর্যের আভার আলোয় আপনি অনন্তের মহালোকে পাড়ি দিয়েছিলেন। সেদিও যেমন আপানাকে ছাড়তে কেঁদে উঠেছিলো মন আজ  বারবার আপনার কথা মনে পড়ে কাঁদছে মন।  মনে পড়বে না কেন প্রিয় কবি!  আপনি যে মানবপ্রেমী কবি– বাংলা সাহিত্যে  সত্য ও সুন্দরের অন্যতম সেরা একজন  মানবতাবাদী  কবি আপনি–আপনার কবিজন্ম ধন্য; এ জন্য ধন্য যে জীবদ্দশাতেই আপনি লাভ করেছেন অগুণতি পাঠকের ঈর্ষাতুর ভালোবাসা। পাঠকের ভালোবাসাই তো একজন কবির অমূল্য অর্জন। বলুন তো কবি এ অর্জনের পেছনে কী এমন জাদুকরী শক্তি ছিল আপনার হাতে ?
বাংলা ভাষার একজন মহত্তম কবি হিসেবে  আপনি মানুষ ও মানবতার পতাকা উড়িয়েছেন স্বতন্ত্র মহিমায়। ঈর্ষণীয় নিষ্ঠা ও নিরলস  সাধনায় আমার কাছে  আপনি  অতুলীয়।  এর অন্তর্নিহিত রহস্যের মূলে কী ছিলো? যদি বলি  ভালোবাসা! হ্যাঁ,  মানুষ ও মাতৃভূমির  প্রতি আপনার গভীর মমতা আর অফুরান  ভালোবাসা। এই ভালোবাসাই তো আপনাকে বাংলাদেশের অন্যতম কবির মর্যাদা দিয়েছে। সে মর্যাদার আসন থেকে আপনাকে সহজে হটানো যাবে কি?
রাহমান ভাই!
আপনার অজস্র কবিতায়  নিরন্তর মানুষ ও মানবতার জয় গান গেয়েছেন কবি!  এখানে  তেমন একটি কবিতার কথা বলতে চাই। ‘এক ফোটা কেমন অনল’ গ্রন্থের ছোট্ট একটি সহজ সরল কবিতা– ‘পান্থজন’। এখন আপনার স্মরণে কিছু নেই,থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা পাঠকেরা কখনো ভুলিনি ।
মনে আছে, যখন প্রবলভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে  সাম্প্রদায়িকতার নাগিনী বিষদাঁত গজায়, ছোবল মারতে উদ্যত  ফণা তোলে তখন এ কবিতাটি লেখা হয়েছিল। একটি বিখ্যাত  দৈনিক কাগজের  সাময়িকীর পাতায় এটি প্রথম  প্রকাশিত হয়। কবিতাটির  অপূর্ব বাচন শৈলী  এবং এর চিরন্তন মর্মবাণী পাঠকের মন ছুঁয়ে,মানুষের মনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিকাশ ঘটায় ।   প্রায়শই  কবিতাটি পাঠ করি।  আজ আবার পড়লাম।  শুধু গরীব ও অনগ্রসর দেশে নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশে বর্তমানে সভ্যতা ও মানবতার চরম সংকট বিরাজমান।  জানি না, এই ভীতিকর মহামারি থেকে আমরা কবে  মুক্ত হতে পারবো ।  আজকের দিনে এ কবিতার প্রাসঙ্গিকতা আমাদেরকে একটি বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে শক্তি ও সাহস যোগাবে কি? এতে  অনেক পাঠকের মতো আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
মূলত এ বিবেচনা থেকেই পুরো  কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করছি–
” বহু পথ হেঁটে ওরা পাঁচজন গোধুলিতে
এসে বসে  প্রবীণ বৃক্ষের নিচে ক্লান্তি মুছে নিতে।
গাছের একটি পাখি শুধায় ওদের —
‘ বলতো তোমরা কারা?’ প্রশ্ন শুনে পান্থজন
ঝুঁকে পড়ে নিজের বোধের
কাছে ; বলে একজন, ” হিন্দুত্বের প্রতি আজন্ম আমার টান।”
দ্বিতীয় জনের কণ্ঠ বাঁশির মতন
বাজে, ‘ আমি বৌদ্ধ, হীনযান।’
এবং তৃতীয় জন বলে, ‘ আমি এক নিষ্ঠাবান বিনীত খ্রীষ্টান,’
চতুর্থ পথিক করে  উচ্চারণ, আমার ঈমান
করেছি অর্পণ আমি খোদার আরশে,
আমিতো মুসলমান। ‘
পঞ্চম পথিক খুব কৌতূহলবশে
কুড়িয়ে পতঙ্গ এক বলে স্মিত স্বরে, আমি মানব সন্তান। ‘
প্রিয় কবি!  একজন খাঁটি  মানবতাবাদী কবি বলে আপনার কলমে এরকম একটি চিরকালীন  সহজ সরল মহৎ কবিতার জন্ম হয়েছে । আমৃত্যু আপনি এধরনের অজস্র কবিতা লিখেছেন। নমস্য কবি! আপনার কাছে আমরা ও আমাদের মাতৃভাষা চিরঋণী।


৪.
স্বীকার করতেই হবে,  আজ  আপনি বেঁচে থাকলে অবশ্যই আরও কিছু কালজয়ী কবিতা পেতাম আমরা।
অকুণ্ঠ চিত্তে সবাই  স্বীকার করেন যে, শামসুর রাহমান এদেশের এক বিরল মধুর স্বভাবের কবি। আমিও  বলি, প্রিয় কবি!ব্যক্তিস্বার্থের ওপরে উঠে মানুষের  সহজাত  লোভ-লালসা, কাম-ক্রোধ, ঈর্ষা ইত্যাদি নেতিবাচক দোষ ত্রুটিকে দূরে  ঠেলে  আপনি ধীরে ধীরে  হয়ে গেলেন বিশুদ্ধ মনের  একজন নির্মল  চিত্তের  বিনয়ী মানুষ। অতুলনীয় মানবিক মূল্যবোধে অটুট থেকে আপনি আজীবন লড়াই করেছেন কথায় কলমে –শুদ্ধাচারী কুলীন  ঋষির মতো, চারপাশ থেকে বিবিধ – অপচ্ছায়া তাড়াতে চেয়েছেন নিরন্তর । জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছেন অশুভের বিরুদ্ধে।
আপনি মনেপ্রাণে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে মুক্তচিন্তা ও উদার  গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ব্যতীত সম্প্রীতির  সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। এর অভাবে একজন ব্যক্তির মানব জন্ম অসম্পূর্ণ  রয়ে যায় । কতবার কতখানে আপনার মুখে শুনেছি  সম্প্রীতি ছাড়া সমাজ ও ব্যক্তির জীবনে শান্তি আসে না। আপনি জানতেন যে, অগণতান্ত্রিক দূষিত পরিবেশ-পরিসরে  থাকতে থাকতে একটা দেশ ও তার জনগণ কী দুঃসহ দহন যাতনায় বিদ্ধ হয়ে ককিয়ে ওঠে; মানুষের জীবনে শান্তি বা স্বস্তি না থাকলে সামনে হাঁটা কষ্টদায়ক ।  আর কবি হলে তো কথাই নেই!

একজন কবিই পারেন  তাঁর আপন জাতি ও মাতৃভূমির ব্যথা বেদনাকে নিজ বুকে ধারণ করতে।  আপনি ভাগ্যবান বটে ; নিজের সমগ্র কবিজীবনে বহন করেছিলেন আপন দেশ-জাতি ও মানুষের মনের যন্ত্রণা  ও বেদনাকে।

আজ আপনাকে খুব বেশি করে মনে পড়ছে  রাহমান ভাই! আপনি নেই,  কিন্তু আপনার হাজার কবিতা আমাদেরকে শক্তি ও সাহস দিচ্ছে ;  সামনের দিকে এগিয়ে যাবার প্রেরণা যোগাচ্ছে ।  কেউ স্বীকার করুক বা না করুক আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি,  আপনার বহুবিধ  কবিতা পাঠে  সব বয়সী পাঠকেরা আনন্দ ও প্রেরণা  লাভ করেন, তাঁরা নিজের দেশটাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসার মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন । আগামী দিনেও সেই আনন্দ ও প্রেরণা লাভ করে আমাদের  তরুণ  প্রজন্ম দেশটাকে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ হবে, একটা  উন্নত বাংলাদেশ তৈরি করতে সক্ষম হবে।


৫.

কবি ও কবিতার দেশ বাংলাদেশ । প্রতিবছর ঝাঁকে ঝাঁকে, আঁকে বাঁকে বহু কবি আসছেন, আগামীতেও আসবেন। কিন্তু কতজন কালের মঞ্চে কালোত্তীর্ণ  জ্যোতি ছড়াবেন তা আমি জানি না; জানার প্রয়োজনও বোধ করি না।  তবে এটা জানি, মনে করি আপনিও আমাদের দুঃখিনী বর্ণমালার  একজন নশ্বরতা জয়ী অমর কবি। মৃত্যু আপনাকে কাল থেকে কালান্তরে পাঠকের মন থেকে হরণ করতে পারেনি,  আগামীতেও পারবে না।
বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের পরাধীন সোনার বাংলায়– আমাদের রক্তে রাঙা  অবহেলিত  জনপদে আপনার জন্ম হয়েছিল জরাজীর্ণ এক মলিন  শহরে, যাকে ঠিক নগর বলা যায় না। জন্মের পর এ শহর ঢাকায় আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে ; যৌবনকে স্বাগত জানিয়েছেন তুমুল  উদ্দামতা দিয়ে।  এ শহরের স্মৃতি নিয়ে আপনার একটি অসামান্য স্মৃতিগ্রন্থ রয়েছে — ‘স্মৃতির শহর’।
বৃটিশ ভারত ছেড়ে চলে গেলে  সবার মতো আপনিও একটা অশুভ শক্তির অধীন  স্বাধীন দেশ পেয়েছিলেন। সেই দেশে স্বাধীনতার নামে কী ঘটেছিলো তা আমার চেয়ে  আপনিই ভালো জানেন,  কবি! দেখতে না দেখতে   আপনি ও আপনার সঙ্গীরা  বুঝতে পেরেছিলেন যে, বৃটিশ চলে গেলেও পরাধীনতা যায়নি,  বরং আরও তীব্রভাবে সমাজের সর্বস্তরে শৃঙ্খল নিয়ে ঝাঁকিয়ে বসেছে।  শুরু হয় সেই শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রাম-লড়াই।  আপনি এ লড়াইয়ে একজন কলম সৈনিক হয়ে আমৃত্যু  লড়াই করেছেন। বিশেষ করে সেই  আন্দোলন-লড়াই কেন্দ্রিক আপনার অপূর্ব সব কবিতা পাঠ করে সবাই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। সেসব আজ ইতিহাস।

প্রিয় কবি!
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত  দীর্ঘ সময় পরিক্রমায় আপনি ছিলেন এক টালমাটাল সময়ের সরব  সাক্ষী– ক্ষতবিক্ষত সময়ের কলম চিত্রকর,   নান্দনিক  রূপকার । বেদনা ও নির্জনতা কখনো কখনো তীব্র বেগে লতিয়ে উঠেছে আপনার কবিতায়। পাঠক  আক্রান্ত হয় প্রবলভাবে। কবিতার একজন সামান্য পাঠক আমি  আপনাকে গভীরভাবে অনুভব করি। আপনার কবিতায় পাঠক  কখনো কখনো  মা ও মাতৃভূমির কান্নার হাহাকার খুঁজে; আমি কিন্তু   বারুদের  গন্ধ খুঁজে পায়। এ গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে  কাল রাতে আমি  স্বপ্নের   ভেতরে  ‘আসাদের শার্ট ‘ গায়ে রাজপথে নেমে যাই — জনতার ঢল নামে মিছিলে মিছিলে — গুলি চলে নির্বিচারে, রক্তে ভাসে রাজপথ, অলিগলি। লাশের ওপরে লাশ। এত লাশ! আপনার ‘ নিজ বাসভূমে’কাব্যের একটি বিখ্যাত কবিতা — রাজকাহিনী।  এ কবিতার অবিস্মরণীয় কয়েকটি পঙক্তি :–.
“এ লাশ আমরা রাগবো কোথায়?
তেমন যোগ্য সমাধি কই?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল সাগর- জল–
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই।
তাইতো রাখিনা এ লাশ আজ
মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই। ”
সন্তান হারানোর বেদনা মায়ের বুকে কত যে তীব্র হয়ে বাজে , তা শুধু  সে মা- ই জানের- যিনি হারিয়েছেন চোখের মণি বুকের ধন প্রিয় সন্তান। আপনিও জানেন কবি!  কারণ প্রিয় শিশু পুত্র মতিনের পানিতে ডুবে বেদনাদায়ক  অকাল মৃত্যু আপনি কখনো মেনে নিতে পারেননি;  আমৃত্যু পুত্রশোক  আপনাকে কাতর করেছে ; ব্যথার  আগুনে আপনাকে  পুড়িয়েছে। মতিনের প্রসঙ্গ এলে দেখেছি  আপনি কেমন বিষন্নতার অতলে হারিয়ে যেতেন অবচেতনে।
আমিও আজ বিষন্ন মনে আপনাকে  বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই প্রিয়  কবি! জেগে জেগে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি কয়েক দিন ধরে। এই দুঃসহ দুঃস্বপ্নে দেখি :  হঠাৎ একটা গুলি আমার খুলির মধ্যে  শকুনির  ঠোঁটের মতন বিঁধে গেলো।  মুণ্ডহীন আমি ; শূন্যতার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি, একা। চোখ বন্ধ, কিছুই দেখছি না।

ইতি–
আপনার স্নেহধন্য
এক অতি সাধারণ কবি।
১৭ আগস্ট ২০২৪