গত সপ্তাহের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যৌথভাবে ইরানের প্রধান তিন পারমাণবিক স্থাপনা—ফোরদো, নাটাঞ্জ ও ইসফাহান—বোমা হামলা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, ওই স্থাপনাগুলো ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ হয়েছে। তবে জাতিসংঘের পরমাণু তদারকি সংস্থা আইএইএ এখনো নিশ্চিত নয় যে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র কী এবং ইরানের বিপুল পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম কোথায় আছে।
ধ্বংসস্তূপের মাঝে ধোঁয়াশা
আইএইএ মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি জানান, ফোরদোর ভেতরে স্থাপিত সংবেদনশীল সেন্ট্রিফিউজগুলো সম্ভবত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু ৯ টন সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম—এর মধ্যে ৬০% বিশুদ্ধতায় ৪০০ কেজি, যা প্রায় অস্ত্রোপযোগী পর্যায়—নষ্ট হয়েছে কি না, তা অনিশ্চিত। পশ্চিমা দেশগুলো এখন মরিয়া হয়ে এসব ইউরেনিয়ামের ভাগ্য অনুসন্ধান করছে।
উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়ামের ঝুঁকি
আইএইএর প্রচলিত মাপকাঠি অনুযায়ী, ৬০%-এ সমৃদ্ধ ৪০০ কেজি ইউরেনিয়ামকে ৯০%-এ উন্নীত করলে প্রায় নয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব। তাই এর একটি ছোট অংশও যদি অজানা জায়গায় থেকে যায়, তবে তা বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
ইউরেনিয়াম সরিয়ে নেওয়ার আভাস
গ্রোসি জানান, ১৩ জুনের প্রথম ইসরায়েলি হামলার দিনই ইরান তাকে জানিয়েছিল যে তারা ‘সরঞ্জাম ও উপাদান নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছে’। একটি পশ্চিমা কূটনীতিকের ভাষ্য, “ফোরদোর অধিকাংশ ইউরেনিয়াম হামলার কয়েক দিন আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, যেন তারা জানত কী আসছে।” স্যাটেলাইট ছবিতেও হামলার আগে ফোরদোর বাইরে ট্রাকের সারি দেখা গেছে, যা স্থানান্তরের ইঙ্গিত দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ গত বৃহস্পতিবার বলেন, এ ধরনের গোয়েন্দা তথ্য তাঁর জানা নেই। ট্রাম্পও দাবি করেন, “ওরা কিছুই সরায়নি; এত ভারী জিনিস নাড়ানো সহজ নয়।”
আইএইএর সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ
হামলার আগে পর্যন্ত আইএইএ নিয়মিতভাবে ইরানের সমৃদ্ধিকরণ স্থাপনাগুলোতে ক্যামেরা ও সেন্সরের মাধ্যমে ঘড়ি ধরে নজরদারি করত। এখন সেগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত; ভেতরে ঢুকতেও ঝুঁকি—অব্যবিস্ফোরিত বোমা ও ধ্বংসাবশেষ। এর মধ্যে ইরানি পার্লামেন্ট ক্ষুব্ধ হয়ে আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা ‘সাময়িক স্থগিত’ করার পক্ষে ভোট দিয়েছে। ফলে তদারকির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
ইরানের অবস্থান
তেহরান দাবি করছে, আইএইএ বোর্ডের সাম্প্রতিক এক প্রস্তাব ইরানকে ‘অবৈধ’ হামলার পথে ঠেলে দিয়েছে। তারা বারবার বলছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি কেবল শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্য—যা ট্রাম্প উপেক্ষা করেছিলেন—কথিত বোমা কর্মসূচির কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসামরিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে ৬০% সমৃদ্ধির প্রয়োজন হয় না।
পশ্চিমা উদ্বেগ ও ‘বিড়াল–ইঁদুর’ খেলা
আইএইএর সাবেক শীর্ষ পরিদর্শক অলি হেইনোনেন জানান, ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে নমুনা ও ধূলিকণা সংগ্রহ এবং পরিবেশগত বিশ্লেষণ—সব মিলিয়ে অনুসন্ধান হবে দীর্ঘ ও জটিল। “কিছু উপাদান ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যেতে পারে, আবার কিছু বোমার সময় হারিয়ে যেতে পারে,” বলেন তিনি। আরেক কূটনীতিক এই পরিস্থিতিকে ‘ইঁদুর–বেড়াল’ খেলায় তুলনা করেন, কারণ আইএইএ অতীতে অঘোষিত ইরানি স্থানে ইউরেনিয়াম কণার ব্যাখ্যা পায়নি।
পরিদর্শন কতটা কঠিন হবে
আইএইএর মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতিটি গ্রাম ইউরেনিয়াম হিসাবের বাইরে থাকতে পারে না। কিন্তু সংস্থার ‘হঠাৎ পরিদর্শন’ করার ক্ষমতা সীমিত; ঘোষিত স্থাপনার বাইরের জায়গায় ঢুকতে হলে ইরানের সম্মতি দরকার। এর মধ্যে ইরানের হাতে অতিরিক্ত সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে, যাদের অবস্থান আইএইএ জানে না। ফলে নতুন বা গোপন সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্র গড়ে তোলার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
নাটাঞ্জের উপরিভাগের স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু পাহাড়ের গভীরে ফোরদোর ক্ষয়ক্ষতি এখনো ধোঁয়াশা। কত পরিমাণ ইউরেনিয়াম নষ্ট হয়েছে আর কত হারিয়ে গেছে—আইএইএ এটি নির্ণয় না করা পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্ব নিশ্চিত হতে পারবে না। গ্রোসি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বোমা-বিধ্বস্ত এলাকায় কাজ করা দীর্ঘমেয়াদি এবং ঝুঁকিপূর্ণ; আলোয়ের সাথেই পরিদর্শকদের ধাওয়া করবে অজানা অনেক ছায়া। প্রশ্ন রয়ে গেছে: আন্তর্জাতিক তদারকি না ফিরলে এই ‘ইঁদুর–বেড়াল’ খেলা কোথায় গিয়ে থামবে?