শিবলী আহম্মেদ সুজন
সাপ ও কুসংস্কার
‘অন্ধকার গর্তে থাকে
অন্ধ সরীসৃপ,
নাহি জানে আপনার ললাট প্রদীপ।
তেমনি আঁধারে আছে এই অন্ধ দেশ’…
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সম্ভবত সাপ-সম্পর্কিত নানা ধরনের ভীতিপ্রদ, চমকপ্রদ, সত্য-মিথ্যা গল্প শোনার অভিজ্ঞতা আমাদের শুরু হয় দাদি-নানির কোল থেকে।
কিংবা আমরা যারা গাঁয়ে-গঞ্জে বড় হয়েছি, তাদের বেলায় দাদা-নানার দীর্ঘ গ্রামীণ জীবনের ব্যক্তিগত বহু অভিজ্ঞতা ইত্যাদি এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট রসদ জুগিয়েছে।
রাতবিরাতে গ্রামের অন্ধকার পথে চলতে-ফিরতে গিয়ে কালেভদ্রে দু-একজন যে সাপের মুখোমুখি হয়েছে, এদের কবল থেকে থেকে রক্ষা পেয়েছে অথবা ছোবলের শিকার হয়েছে-এমন ঘটনা খুব বিরল কিছু নয়।
গভীর বনে গরিব কাঠুরে খড়ি-লাকড়ি সংগ্রহ করতে গিয়ে সাপের দংশনে প্রাণ হারিয়েছে-এজাতীয় কিছু ঘটনাই কালক্রমে গ্রামের আকর্ষণীয় কাহিনিতে রূপ নেয়।
সেই কাহিনি ঘিরে তৈরি হয় আরও সব মুখরোচক গল্প, উপাখ্যান, কিংবদন্তি। তা ছাড়া আছে হাটে-বাজারে সাপুড়ে বা বেদেদের নানা ধরনের ছলচাতুরী ও ব্যবসায়িক অপপ্রচারণা।
সাপুড়ে, ওঝা ও বেদেরা তাদের ব্যবসার খাতিরেই সাপ- সম্পর্কিত বহু রহস্যঘন ঘটনার অবতারণা করে থাকে। চালিয়ে যায় নানা ধরনের টোটকা অভিজ্ঞানসম্মত অসম্ভব সব চিকিৎসা। মাওলানা-মুনশিরাও
পুরোনো মসজিদ-জুমাঘরের দেয়ালের ফাটল বা চালের নিচের মাচাংয়ে বসবাসকারী সাপ, তক্ষক, গুই নিয়ে গল্প-গুজব ছড়ায়।
এদের জিন-পরি বা তাদের পালিত দোসর বলে আখ্যায়িত করে। সব মিলিয়ে আমাদের মধ্যে সাপ নিয়ে বহু কুসংস্কার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথা বলা অতিশয়োক্তি হবে না যে, সাপকে কেন্দ্র করে যত কুসংস্কার বা মিথ্যাচার রচিত হয়েছে, সমগোত্রীয় অন্য কোনো প্রাণীর বেলায় ততটা ঘটেনি। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। সাপের বিশেষ আকৃতি, ভীতিসঞ্চারী ত্বরিত চলার ভঙ্গি এবং এদের মৃত্যুভয়াল বিষক্রিয়া আমাদের মন-মানসকে সহজেই আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
অন্যদিকে, এদের বিচিত্র স্বভাব-আচার ও শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ না পাওয়ায় প্রচলিত কুসংস্কারগুলো আরও রহস্যঘন ও মুখরোচক হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে।
Leave a Reply