১০:২৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫
চীনের মুনশট এআই: সীমিত চিপ ব্যবহার করেও মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে পাল্লা পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি-১২৩) মালয়েশিয়ার এআই বুম দেশটিকে জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যতে আটকে দিতে পারে জুলাই জাতীয় সনদ: ভোটের দিনই গণভোট করার চিন্তা সরকারের, থাকবে একাধিক প্রশ্ন শারজাহ বইমেলায় কবিতার মাধ্যমে মানসিক শান্তি—‘পয়ট্রি ফার্মেসি’ অনন্য উদ্যোগ ১,০০০ বছর পুরনো পবিত্র কুরআনের দুর্লভ অনুলিপি পিনাট বাটারের তুলনায় আরও পুষ্টিকর ও বহুমুখী বাদাম বাটার প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩২২) গুগল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিস্টমাস আইল্যান্ডে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডেটা সেন্টার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা জাপানে উপকূলীয় ভূমির ক্ষয়জনিত কারণে সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম ক্ষতিগ্রস্ত

এয়ার গান

  • Sarakhon Report
  • ০৭:০৭:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪
  • 57

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

হাবুল নাকি পাস করেছে ফার্স্ট হয়ে। কথাটা শুনে গর্বে তার বুকটা তো ফুলে উঠলো দশ হাত। হাওয়ার ওপর ভর করে সে ফিরে এল বাড়িতে ধীরে ধীরে। বিপুল আনন্দে সারা রাত্রি তার ভালরকম ঘুমই হল না। মাকে কথাটা বলতে মা মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, “সুখী হও-বড় হও বাবা!’

সত্যি, তার এই দীর্ঘদিনের খাটুনি সার্থক হয়েচে। বাড়ির লোকের চোখ এড়িয়ে কত রাত্রি জেগে সে বই পড়ে গেছে, তার পড়ার বই একাগ্রচিত্তে। আজ তার পরিণতি ওর প্রথম হওয়া। সকলে তো কথাটা শুনে বিশ্বাসই করতে চায় না। স্কুলের ছেলেরা তো প্রথমে হেসে উড়িয়েই দিয়েছিল একেবারে। সারাদিন যে আড্ডা মেরে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, সে এত উন্নতি করলে কি করে? তবু হাবুল ফার্স্ট হল-

শীতের ঠাণ্ডা বাতাস বইছে ঝির ঝির্ করে। হাবুলের ঘুম ভেঙে গেল; ধড়মড় করে উঠে বসলো। মনে পড়ল গতকালের ঘটনা-তার প্রথম হবার কথা। তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল ঘরের বাইরে। হাবুল গিয়ে দাঁড়াল তার ছোট-কাকার ঘরের দরজায়। ছোট- কাকা তখন ঘুমুচ্চেন নাক ডাকিয়ে লেপের মধ্যে। হাবুল ডাকল, ‘ছোট কাকা-ছোট-কাকা!’ ছোটকাকার ঘুম ভাঙলো। তিনি দু-হাত দিয়ে চোখ রগড়ে উত্তর দিলেন, ‘কি রে হাবুল!’

হাবুল বললে, ‘কাকা, আমি ফার্স্ট হয়েচি।”

এমন সময় এই সকালে টুনু এসে হাজির হয়। যে হাবুলের কথা শুনে তীব্র প্রতিবাদ করলে, ‘কক্ষনো না ছোট-কাকা!’

হাবুল রুখে উঠলো, ‘তুই জানিস টুনু!’ টুনুও দমে না. একটুও, ‘ইস। উনি আবার ফার্স্ট হবেন? তবে যদি টোকেন, সে কথা আলাদা।’

হাবুলের রাগ চড়ে গেল। সে ঠাস করে টুনুর কচিগালে একটা চড় মেরে বললে, ‘বাবা সাক্ষী। কাল রাত্রে হেড-মাস্টার মশায় বললেন, জানিস সে-কথা? সকাল বেলা এসেচেন চালাকি কর্তে।’


“হাবুল ধীরে ধীরে চলে গেল ছাতের ‘চিলকুঠরি’র ভেতর। সেখান থেকে লক্ষ্য করলে পাশের বাড়ির আঙিনায়-বসা একটা কাককে। কাকও সঙ্গে সঙ্গে উড়ে পালিয়ে গেল তাকে বিদ্রূপ করে হয়তো। হাজার হোক, কাক বড় ধূর্ত প্রাণী”


টুনু গালে হাত বুলোতে থাকে বেদনায়। ছোট-কাকা বললেন, ‘ছিঃ, মারলি কেন রে ওকে?’

দেখলে তো কি হিংসুটে।’

‘ ‘এ রকম চড় তোমার গালেও পড়বে অখন।’ কথার শেষে টুনু ছল ছল চক্ষে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

খানিকক্ষণ পর হাবুল বললে, ‘ছোট-কাকা, তুমি বলেছিলে, ফার্স্ট হলে আমাকে একটা এয়ার গান কিনে দেবে।’

‘ও!’ এতক্ষণ পর ছোট-কাকার আট মাস আগেকার প্রতিশ্রুতি মনে পড়ে গেল। বললেন, ‘বেশ বেশ, কাল কিনে দেবো।’ ‘কাল না-আজই।’

ঠিক আটমাস আগে হাবুল একদিন ওর ক্লাসফ্রেন্ড ভুলোদের বাড়িতে দেখেছিল তার একটা এয়ার গান। হাবুলেরও একটা এয়ার গান কিনবার ভারি শখ হল। কথাটা তার ছোটকাকাকে বলতে তিনি বললেন ‘ফার্স্ট হলে এয়ার গান তোকে প্রাইজ দেবো।’ হাবুল উঠে-পড়ে লেগে গেল প্রথম হবার জন্যে এবং প্রথম হল যথাসময়ে।

সেদিনই সে একটা এয়ার গান কিনে আনলে। তারপর সকাল সকাল খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ করে এয়ার গান হাতে ঝুলিয়ে বাড়িময় খুঁজতে লাগলো শিকার। কোথাও বসেছে একটা অসহায় চড়াই কিংবা পায়রা। তাকে লক্ষ করে এয়ার গানে আওয়াজ হল ফট্ ফট্ শব্দে। পাখি উড়ে পালালো অক্ষত শরীরে আর গুলি বেরিয়ে গেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে, পাখির দশ হাত তফাত দিয়ে প্রায়।

হতাশ হয়ে ও ফিরে এল হাত-ঠিক করবার জন্যে, যাতে সে পুনরায় না লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ঘরের দরজার চৌকাঠে বসে, ও লক্ষ্য করলে দেওয়ালে টাঙানো একটা বিলিতি ক্যালেন্ডারে ছবির মুখ। অনেকক্ষণ পর তার এয়ার গান থেকে শব্দ বেরুল ফট্ করে-গুলিও ছুটে চল ছবিতে একটা ছেলের ঠিক মুখের পানে। তারপর আওয়াজ হল ঝন্ঝন-ঝন্। ভয়ে হাবুলের মুখ হয়ে গেল পাংশু। সে দৌড়ে গেল। দেখলে মেঝেতে ছড়ানো অগুনতি কাচের টুকরো। আস্তে আস্তে ক্যালেন্ডারটা তুলে ধরতে দেখলে, দেওয়ালে কালী ঠাকুরের একখানা পট ফ্রেম দিয়ে মুড়ে কাচ দিয়ে ঢাকা। ছবিখানাকে ক্যালেন্ডারটা ঢেকে ছিল এতক্ষণ। লোহার গুলির ঘায়ে ভঙ্গুর কাচই গেছে একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে। বুকের ভেতরটা তার ছ্যাঁৎ করে উঠলো আতঙ্কে। চোখের সামনে লক লক করতে লাগলো কালী ঠাকুরের দীর্ঘ জিভ। ভয়ে ও ভাবনায় সে মুষড়ে রইলো অনেকক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে পরিষ্কার করে ফেললে কাচগুলো। মা জানলে তো এক্ষুনি রসাতল করে ফেলবেন।

তখন মধ্যাহ্ন প্রায়। হাবুল ধীরে ধীরে চলে গেল ছাতের ‘চিলকুঠরি’র ভেতর। সেখান থেকে লক্ষ্য করলে পাশের বাড়ির আঙিনায়-বসা একটা কাককে। কাকও সঙ্গে সঙ্গে উড়ে পালিয়ে গেল তাকে বিদ্রূপ করে হয়তো। হাজার হোক, কাক বড় ধূর্ত প্রাণী।

নিচে যেতে হাবুলের আর সাহস হচ্ছে না। টুপ করে বন্দুকটা কাঁধে নিয়ে একটা চটের উপর বসে থাকে জানলা দিয়ে দূরের পানে তাকিয়ে। কাক কিংবা পায়রা কিংবা চড়াই এলে, ও গুলি ছুড়ে মারবে তাকে। চুপ করে বসে থাকতে থাকতে ও সামনের বাড়ির ট্রাঙ্কটাকে লক্ষ্য করে ফেলে। গুলির আঘাতে ট্রাঙ্কটাও বেজে ওঠে ঝন্ ঝন্ ঝন্।


”কি ছেলে রে তুই? বাঁদরে তোর হাত থেকে এয়ার গানটা নিয়ে গেল? অমন খাসা জিনিসটা, ন-টাকা দশ আনা দাম!”


মনে আবার আনন্দ ফিরে আসে। হ্যাঁ, তার হাত অনেকটা ভাল হয়েছে। আবার সে লক্ষ্য করে পাঁচিলের ওপরের একটা ফুল গাছের টবে। সেটায় আওয়াজ হয় খট্ করে।

আনন্দ ওর বেড়ে যায় চতুর্গুণ। বন্দুকটা নেড়েচেড়ে ভাল করে পরীক্ষা করে। হ্যাঁ, একদিন ও বড় বন্দুকও ছুঁড়তে পারবে নিশ্চয়। এই হল তার সূচনা। বড় হলে সে চলে যাবে আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে মঙ্গো পার্কের মত। অসংখ্য জন্তু-জানোয়ার শিকার করে, ও দেখাবে ওর শৌর্য-বিক্রম। বাঙালী ভীরু নয়-বীরের জাতি-ও তা প্রমাণ করবে। খবরের কাগজের পাতায় পাতায় ওর ফটো ছাপানো হবে। ও দাঁড়িয়ে থাকবে হাফ প্যান্ট পরে বন্দুক হাতে, আর পায়ের কাছে পড়ে থাকবে বিরাটকায় হিংস্র জন্তুর নিহত দেহটা। পুলকে ওর হৃদয় ভরে গেল এখনই। কৃষ্ণ মহাদেশের গভীর অরণ্য থেকে বেরিয়ে আসবে ‘নষ-খাদক জাতি সভ্য মানুষের গন্ধে, ও তাদের দেখে ভয় পাবে না একটুও। বরং ওর বন্দুক ছুঁড়ে দেবে গুড়ুম- গুড়ুম-গুড়ুম। শিক্ষা হয়ে যাবে তাদের রীতিমত। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকবে কতকগুলো ইতস্তত ভূমিতে। আর সবাই পালিয়ে যাবে এই আশ্চর্য কল দেখে। নিরীহ হাবুল এখনই যে নিষ্ঠুর শিকারী হয়ে উঠলো সম্পূর্ণরূপে! রক্ত-প্রবাহ চঞ্চল হয়ে উঠলো ওর ধমনীতে ধমনীতে। ও পায়চারি করতে লাগলো ঘরের ভেতর এয়ার গানটা হাতে ঝুলিয়ে আফ্রিকার রোমাঞ্চকর অ্যাভেঞ্চারের স্বপ্নে বিভোর হয়ে। অক্ষয় অমর হয়ে থাকবে ও ইতিহাসের পাতায়। নেপোলিয়ন কিংবা নেলসনের চেয়ে ও কোন অংশে হেয় নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে নেপোলিয়ন নাকি পেছনে হাত দিয়ে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকতেন আর পাশ দিয়ে শন্ শন করে গুলি চলে গেলেও তিনি গ্রাহ্য করতেন। আদৌ। ঠিক সেই ভঙ্গিমায় সেই স্বর্গীয় বীরের অনুকরণে ও দাঁড়িয়ে রইলো ঘরের মধ্যে জানলার পানে মুখ করে।

কিন্তু ও কি? সামনের বাড়ির ট্রাঙ্কের ওপর একটা বাঁদর যে? তাই এত কাক ডেকে উঠছে অবিশ্রান্ত, তাদের বিকট রব তার কানে যায় নি এতক্ষণ। কারণ সে কলকাতা ছেড়ে এযাবৎ আফ্রিকার গভীর অরণ্যে পড়ে ছিল শিকারের খোঁজে। ওর বুকের ভেতরটা যেন দুর দুর করে উঠলো। ও ওর বন্দুকটা একবার ভাল করে দেখে নিলে বাঁদরটা বেশ বড় এবং হৃষ্টপুষ্ট। আর ওদিকে বাঁদরটা ঝুপ্ করে হাবুলের ঘরের দরজার কাছে এসে উপস্থিত হল। বীর পুরুষের কাঁপুনি শুরু হয়, রীতিমত হাঁটুতে-হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগে যায়, নেলসনের ও নেপোলিয়নের মত। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বাঁদরটার পানে। ঘরের এক পাশে ছিল একছড়া বড় বড় চাঁপা কলা। বাঁদরটা একপা একপা করে এগিয়ে আসে সেই কলার দিকে বাঁদর নাকি কলা খেতে বড় ভালবাসে। হাবুলের সামনে এই নিদারুণ ডাকাতি ঘটে যায়! সে আর দেখতে পারে না, মরীয়া হয়ে, তার সমস্ত শক্তি একত্র করে দাঁড়ায় কলা ও বাঁদরের মাঝখানে জন্তুটাকে এয়ার গান দিয়ে লক্ষ্য করে। এয়ার গানের ঘোড়া দিলে টিপে; কিন্তু তাতে গুলি পোরা ছিল না একটাও। সুতরাং বাঁদরের ক্ষতি হয় না আদৌ। পরন্তু তার রাগ বেড়ে যায় এই বাধা দেওয়ার জন্যে। সে ত্বরিতে এসে হাবুলের গালে মারলো একটা বিরাশি সিক্কার চড়। বেচারার মাথা ঘুরতে থাকে বন্ বন্ করে। নেপোলিয়ন গালে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। এয়ার গান পড়ে থাকে তার পদতলে। বাঁদরটাও সুযোগ বুঝে এয়ার গানটা নিয়ে উধাও হয় পাশের নিমগাছের ডালে। হাবুলও প্রাণপণে চিৎকার করে ওঠে বাঁদরের এই বেয়াদপি দেখে। মনে পড়ে টুনুর গালের ব্যথা আর কালীর ছবির কাচ ভাঙার কথা? তার চিৎকার শুনে ছুটে আসেন মা, দাদা, ছোট-কাকা, মায় টুনু। হৈচৈ পড়ে যায়, ‘কি হয়েচে রে হাবুল? কি হয়েছে?

নিরুত্তর হাবুল করুণ নয়নে তাকিয়ে থাকে পলাতক বাঁদরের পানে। টুনু তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘ওই দেখ ছোট-কাকা, ছোড়দার এয়ার গান বাঁদরের হাতে।’

‘কি ছেলে রে তুই? বাঁদরে তোর হাত থেকে এয়ার গানটা নিয়ে গেল? অমন খাসা জিনিসটা, ন-টাকা দশ আনা দাম!

আর হাবুল? সে অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকে নিষ্ঠুর অপমানে ও পরাজয়ে হৃদয় ভারাক্রান্ত করে।

জনপ্রিয় সংবাদ

চীনের মুনশট এআই: সীমিত চিপ ব্যবহার করেও মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে পাল্লা

এয়ার গান

০৭:০৭:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

হাবুল নাকি পাস করেছে ফার্স্ট হয়ে। কথাটা শুনে গর্বে তার বুকটা তো ফুলে উঠলো দশ হাত। হাওয়ার ওপর ভর করে সে ফিরে এল বাড়িতে ধীরে ধীরে। বিপুল আনন্দে সারা রাত্রি তার ভালরকম ঘুমই হল না। মাকে কথাটা বলতে মা মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, “সুখী হও-বড় হও বাবা!’

সত্যি, তার এই দীর্ঘদিনের খাটুনি সার্থক হয়েচে। বাড়ির লোকের চোখ এড়িয়ে কত রাত্রি জেগে সে বই পড়ে গেছে, তার পড়ার বই একাগ্রচিত্তে। আজ তার পরিণতি ওর প্রথম হওয়া। সকলে তো কথাটা শুনে বিশ্বাসই করতে চায় না। স্কুলের ছেলেরা তো প্রথমে হেসে উড়িয়েই দিয়েছিল একেবারে। সারাদিন যে আড্ডা মেরে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, সে এত উন্নতি করলে কি করে? তবু হাবুল ফার্স্ট হল-

শীতের ঠাণ্ডা বাতাস বইছে ঝির ঝির্ করে। হাবুলের ঘুম ভেঙে গেল; ধড়মড় করে উঠে বসলো। মনে পড়ল গতকালের ঘটনা-তার প্রথম হবার কথা। তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল ঘরের বাইরে। হাবুল গিয়ে দাঁড়াল তার ছোট-কাকার ঘরের দরজায়। ছোট- কাকা তখন ঘুমুচ্চেন নাক ডাকিয়ে লেপের মধ্যে। হাবুল ডাকল, ‘ছোট কাকা-ছোট-কাকা!’ ছোটকাকার ঘুম ভাঙলো। তিনি দু-হাত দিয়ে চোখ রগড়ে উত্তর দিলেন, ‘কি রে হাবুল!’

হাবুল বললে, ‘কাকা, আমি ফার্স্ট হয়েচি।”

এমন সময় এই সকালে টুনু এসে হাজির হয়। যে হাবুলের কথা শুনে তীব্র প্রতিবাদ করলে, ‘কক্ষনো না ছোট-কাকা!’

হাবুল রুখে উঠলো, ‘তুই জানিস টুনু!’ টুনুও দমে না. একটুও, ‘ইস। উনি আবার ফার্স্ট হবেন? তবে যদি টোকেন, সে কথা আলাদা।’

হাবুলের রাগ চড়ে গেল। সে ঠাস করে টুনুর কচিগালে একটা চড় মেরে বললে, ‘বাবা সাক্ষী। কাল রাত্রে হেড-মাস্টার মশায় বললেন, জানিস সে-কথা? সকাল বেলা এসেচেন চালাকি কর্তে।’


“হাবুল ধীরে ধীরে চলে গেল ছাতের ‘চিলকুঠরি’র ভেতর। সেখান থেকে লক্ষ্য করলে পাশের বাড়ির আঙিনায়-বসা একটা কাককে। কাকও সঙ্গে সঙ্গে উড়ে পালিয়ে গেল তাকে বিদ্রূপ করে হয়তো। হাজার হোক, কাক বড় ধূর্ত প্রাণী”


টুনু গালে হাত বুলোতে থাকে বেদনায়। ছোট-কাকা বললেন, ‘ছিঃ, মারলি কেন রে ওকে?’

দেখলে তো কি হিংসুটে।’

‘ ‘এ রকম চড় তোমার গালেও পড়বে অখন।’ কথার শেষে টুনু ছল ছল চক্ষে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

খানিকক্ষণ পর হাবুল বললে, ‘ছোট-কাকা, তুমি বলেছিলে, ফার্স্ট হলে আমাকে একটা এয়ার গান কিনে দেবে।’

‘ও!’ এতক্ষণ পর ছোট-কাকার আট মাস আগেকার প্রতিশ্রুতি মনে পড়ে গেল। বললেন, ‘বেশ বেশ, কাল কিনে দেবো।’ ‘কাল না-আজই।’

ঠিক আটমাস আগে হাবুল একদিন ওর ক্লাসফ্রেন্ড ভুলোদের বাড়িতে দেখেছিল তার একটা এয়ার গান। হাবুলেরও একটা এয়ার গান কিনবার ভারি শখ হল। কথাটা তার ছোটকাকাকে বলতে তিনি বললেন ‘ফার্স্ট হলে এয়ার গান তোকে প্রাইজ দেবো।’ হাবুল উঠে-পড়ে লেগে গেল প্রথম হবার জন্যে এবং প্রথম হল যথাসময়ে।

সেদিনই সে একটা এয়ার গান কিনে আনলে। তারপর সকাল সকাল খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ করে এয়ার গান হাতে ঝুলিয়ে বাড়িময় খুঁজতে লাগলো শিকার। কোথাও বসেছে একটা অসহায় চড়াই কিংবা পায়রা। তাকে লক্ষ করে এয়ার গানে আওয়াজ হল ফট্ ফট্ শব্দে। পাখি উড়ে পালালো অক্ষত শরীরে আর গুলি বেরিয়ে গেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে, পাখির দশ হাত তফাত দিয়ে প্রায়।

হতাশ হয়ে ও ফিরে এল হাত-ঠিক করবার জন্যে, যাতে সে পুনরায় না লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ঘরের দরজার চৌকাঠে বসে, ও লক্ষ্য করলে দেওয়ালে টাঙানো একটা বিলিতি ক্যালেন্ডারে ছবির মুখ। অনেকক্ষণ পর তার এয়ার গান থেকে শব্দ বেরুল ফট্ করে-গুলিও ছুটে চল ছবিতে একটা ছেলের ঠিক মুখের পানে। তারপর আওয়াজ হল ঝন্ঝন-ঝন্। ভয়ে হাবুলের মুখ হয়ে গেল পাংশু। সে দৌড়ে গেল। দেখলে মেঝেতে ছড়ানো অগুনতি কাচের টুকরো। আস্তে আস্তে ক্যালেন্ডারটা তুলে ধরতে দেখলে, দেওয়ালে কালী ঠাকুরের একখানা পট ফ্রেম দিয়ে মুড়ে কাচ দিয়ে ঢাকা। ছবিখানাকে ক্যালেন্ডারটা ঢেকে ছিল এতক্ষণ। লোহার গুলির ঘায়ে ভঙ্গুর কাচই গেছে একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে। বুকের ভেতরটা তার ছ্যাঁৎ করে উঠলো আতঙ্কে। চোখের সামনে লক লক করতে লাগলো কালী ঠাকুরের দীর্ঘ জিভ। ভয়ে ও ভাবনায় সে মুষড়ে রইলো অনেকক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে পরিষ্কার করে ফেললে কাচগুলো। মা জানলে তো এক্ষুনি রসাতল করে ফেলবেন।

তখন মধ্যাহ্ন প্রায়। হাবুল ধীরে ধীরে চলে গেল ছাতের ‘চিলকুঠরি’র ভেতর। সেখান থেকে লক্ষ্য করলে পাশের বাড়ির আঙিনায়-বসা একটা কাককে। কাকও সঙ্গে সঙ্গে উড়ে পালিয়ে গেল তাকে বিদ্রূপ করে হয়তো। হাজার হোক, কাক বড় ধূর্ত প্রাণী।

নিচে যেতে হাবুলের আর সাহস হচ্ছে না। টুপ করে বন্দুকটা কাঁধে নিয়ে একটা চটের উপর বসে থাকে জানলা দিয়ে দূরের পানে তাকিয়ে। কাক কিংবা পায়রা কিংবা চড়াই এলে, ও গুলি ছুড়ে মারবে তাকে। চুপ করে বসে থাকতে থাকতে ও সামনের বাড়ির ট্রাঙ্কটাকে লক্ষ্য করে ফেলে। গুলির আঘাতে ট্রাঙ্কটাও বেজে ওঠে ঝন্ ঝন্ ঝন্।


”কি ছেলে রে তুই? বাঁদরে তোর হাত থেকে এয়ার গানটা নিয়ে গেল? অমন খাসা জিনিসটা, ন-টাকা দশ আনা দাম!”


মনে আবার আনন্দ ফিরে আসে। হ্যাঁ, তার হাত অনেকটা ভাল হয়েছে। আবার সে লক্ষ্য করে পাঁচিলের ওপরের একটা ফুল গাছের টবে। সেটায় আওয়াজ হয় খট্ করে।

আনন্দ ওর বেড়ে যায় চতুর্গুণ। বন্দুকটা নেড়েচেড়ে ভাল করে পরীক্ষা করে। হ্যাঁ, একদিন ও বড় বন্দুকও ছুঁড়তে পারবে নিশ্চয়। এই হল তার সূচনা। বড় হলে সে চলে যাবে আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে মঙ্গো পার্কের মত। অসংখ্য জন্তু-জানোয়ার শিকার করে, ও দেখাবে ওর শৌর্য-বিক্রম। বাঙালী ভীরু নয়-বীরের জাতি-ও তা প্রমাণ করবে। খবরের কাগজের পাতায় পাতায় ওর ফটো ছাপানো হবে। ও দাঁড়িয়ে থাকবে হাফ প্যান্ট পরে বন্দুক হাতে, আর পায়ের কাছে পড়ে থাকবে বিরাটকায় হিংস্র জন্তুর নিহত দেহটা। পুলকে ওর হৃদয় ভরে গেল এখনই। কৃষ্ণ মহাদেশের গভীর অরণ্য থেকে বেরিয়ে আসবে ‘নষ-খাদক জাতি সভ্য মানুষের গন্ধে, ও তাদের দেখে ভয় পাবে না একটুও। বরং ওর বন্দুক ছুঁড়ে দেবে গুড়ুম- গুড়ুম-গুড়ুম। শিক্ষা হয়ে যাবে তাদের রীতিমত। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকবে কতকগুলো ইতস্তত ভূমিতে। আর সবাই পালিয়ে যাবে এই আশ্চর্য কল দেখে। নিরীহ হাবুল এখনই যে নিষ্ঠুর শিকারী হয়ে উঠলো সম্পূর্ণরূপে! রক্ত-প্রবাহ চঞ্চল হয়ে উঠলো ওর ধমনীতে ধমনীতে। ও পায়চারি করতে লাগলো ঘরের ভেতর এয়ার গানটা হাতে ঝুলিয়ে আফ্রিকার রোমাঞ্চকর অ্যাভেঞ্চারের স্বপ্নে বিভোর হয়ে। অক্ষয় অমর হয়ে থাকবে ও ইতিহাসের পাতায়। নেপোলিয়ন কিংবা নেলসনের চেয়ে ও কোন অংশে হেয় নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে নেপোলিয়ন নাকি পেছনে হাত দিয়ে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকতেন আর পাশ দিয়ে শন্ শন করে গুলি চলে গেলেও তিনি গ্রাহ্য করতেন। আদৌ। ঠিক সেই ভঙ্গিমায় সেই স্বর্গীয় বীরের অনুকরণে ও দাঁড়িয়ে রইলো ঘরের মধ্যে জানলার পানে মুখ করে।

কিন্তু ও কি? সামনের বাড়ির ট্রাঙ্কের ওপর একটা বাঁদর যে? তাই এত কাক ডেকে উঠছে অবিশ্রান্ত, তাদের বিকট রব তার কানে যায় নি এতক্ষণ। কারণ সে কলকাতা ছেড়ে এযাবৎ আফ্রিকার গভীর অরণ্যে পড়ে ছিল শিকারের খোঁজে। ওর বুকের ভেতরটা যেন দুর দুর করে উঠলো। ও ওর বন্দুকটা একবার ভাল করে দেখে নিলে বাঁদরটা বেশ বড় এবং হৃষ্টপুষ্ট। আর ওদিকে বাঁদরটা ঝুপ্ করে হাবুলের ঘরের দরজার কাছে এসে উপস্থিত হল। বীর পুরুষের কাঁপুনি শুরু হয়, রীতিমত হাঁটুতে-হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগে যায়, নেলসনের ও নেপোলিয়নের মত। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বাঁদরটার পানে। ঘরের এক পাশে ছিল একছড়া বড় বড় চাঁপা কলা। বাঁদরটা একপা একপা করে এগিয়ে আসে সেই কলার দিকে বাঁদর নাকি কলা খেতে বড় ভালবাসে। হাবুলের সামনে এই নিদারুণ ডাকাতি ঘটে যায়! সে আর দেখতে পারে না, মরীয়া হয়ে, তার সমস্ত শক্তি একত্র করে দাঁড়ায় কলা ও বাঁদরের মাঝখানে জন্তুটাকে এয়ার গান দিয়ে লক্ষ্য করে। এয়ার গানের ঘোড়া দিলে টিপে; কিন্তু তাতে গুলি পোরা ছিল না একটাও। সুতরাং বাঁদরের ক্ষতি হয় না আদৌ। পরন্তু তার রাগ বেড়ে যায় এই বাধা দেওয়ার জন্যে। সে ত্বরিতে এসে হাবুলের গালে মারলো একটা বিরাশি সিক্কার চড়। বেচারার মাথা ঘুরতে থাকে বন্ বন্ করে। নেপোলিয়ন গালে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। এয়ার গান পড়ে থাকে তার পদতলে। বাঁদরটাও সুযোগ বুঝে এয়ার গানটা নিয়ে উধাও হয় পাশের নিমগাছের ডালে। হাবুলও প্রাণপণে চিৎকার করে ওঠে বাঁদরের এই বেয়াদপি দেখে। মনে পড়ে টুনুর গালের ব্যথা আর কালীর ছবির কাচ ভাঙার কথা? তার চিৎকার শুনে ছুটে আসেন মা, দাদা, ছোট-কাকা, মায় টুনু। হৈচৈ পড়ে যায়, ‘কি হয়েচে রে হাবুল? কি হয়েছে?

নিরুত্তর হাবুল করুণ নয়নে তাকিয়ে থাকে পলাতক বাঁদরের পানে। টুনু তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘ওই দেখ ছোট-কাকা, ছোড়দার এয়ার গান বাঁদরের হাতে।’

‘কি ছেলে রে তুই? বাঁদরে তোর হাত থেকে এয়ার গানটা নিয়ে গেল? অমন খাসা জিনিসটা, ন-টাকা দশ আনা দাম!

আর হাবুল? সে অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকে নিষ্ঠুর অপমানে ও পরাজয়ে হৃদয় ভারাক্রান্ত করে।