০৮:২৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৪১)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০৩:৫৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪
  • 20

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

নিজেরাই তো পানের বরজ করিতে পারিত। কত পয়সা পাইত। বারোইদের মতো আটচালা ঘর করিতে পারিত। তারা পরের পানের বরে খাটিয়া মরে। একটা দুইটা তিনটা পাশাপাশি পানের বর। চারিদিক পাটখড়ির বেড়া। তারই ফাঁকে ফাঁকে সবুজ পাতা মেলিয়া পানগাছগুলি দেখা যায় যেন কতকগুলি শ্যামলা রঙের গ্রাম্য মেয়ে। সরু পাটখড়ির চিকের আড়াল হইতে উকি দিতেছে।
পান বড় হইলে বাড়ির বউরা যায়, মেয়েরা যায়, নরম তুলতুলে হাতে একটা একটা করিয়া বোঁটা হইতে পান ছেড়ে। সাবধান হইবে। আশেপাশের কচি পাতাগুলির গায়ে যেন আঘাত লাগে না। অতি আদরের সঙ্গে মেয়েরা পান পাতা তুলিয়া আনে। তারপর উঠানে বসিয়া পানের আকার অনুসারে পান সাজায়। বড় বড় দুইটা পানের মধ্যে একটা ছোট পান ঢুকাইয়া দেয়। এমনি করিয়া আশিটি পানে এক পণ। বরোই-বউরা কি চালাক। এক পণ পানের মধ্যে চল্লিশটি ছোট পান ঢুকাইয়া দেয়। বারোইরা হাটে যাইয়া পানগুলি এমনি মুন্সিয়ানার সঙ্গে উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখায় যাহাতে ক্রেতাদের চোখে শুধু বড় বড় পানগুলিই পড়ে। এই পানের জন্য আমার নানার দেশের নাম তাম্বুলখানা।
কত দেশে যায় তাম্বুলখানার পান। পদ্মানদী পার হইয়া ঢাকা যায়-পাবনা যায়। রেলগাড়ি চড়িয়া যায় রংপুর-দিনাজপুর আরও কত দেশে। কলিকাতাও হয়তো যায়। এমন মিঠা পান কোনো দেশে হয় না। জানি পদ্মাপারের ঢাকার জেলায় আছে ঢাকাই-পান-খুব বড় বড় পান। হইলে কি হইবে? খাইতে ঝাল, তার পাতা পাতলা। এমন না-পুরু না-পাতলা তাম্বুলখানার মিঠা পান যে খাইয়াছে সে কোনোদিন ভুলিবে না। বরোইদের বরে আছে সাঁচিপান। খাইতে এমন খোশবু বাহির হয় মুখ দিয়া। নতুন বউ বরের সঙ্গে প্রথম দেখা করিতে বাটা ভরিয়া সাঁচিপান লইয়া যায়। তাম্বুলখানার বরোইরা লেখাপড়া করিয়া বড় খেতাব পায় নাই। কিন্তু তাদের বংশানুক্রমিক মেহনতের ফলে তারা আজ দেশবিখ্যাত। এমনি কত গ্রাম বিখ্যাত হইয়া আছে এই মেহনতি মানুষের কর্মনৈপুণ্যে। চাঁদপুরের কামারেরা দা কাঁচি একবার গড়াইয়া দিলে জিন্দেগি কাটিয়া যাইবে। তিন দিনের পথ হইতে লোক আসে তাহাদের ঘরে দা কাঁচি গড়াইতে। কেশবনগরের দই যে খাইয়াছে আর ভুলিবে না। এমনি কত গ্রাম কতরকমের কাজের জন্য বিখ্যাত হইয়া আছে।
ওদিকে গল্প করা শেষ হইয়াছে। বেলা ডুবুডুবু। রাঙাছুটু এবার বাড়ি ফিরিবে। বাড়ি হইতে বাহির হইবার পর মায়ের পাড়া-বেড়ানির দল ক্রমেই ব্যাড়িতেছিল- ও-বাড়ির ফেলি, সে-বাড়ির সাজু, রাঙা-বস্তু, রূপবানী আরও কত মেয়ে আসিয়া মায়ের দলে মিশিয়াছিল। এখন মা বাড়ি ফিরিতেছেন। মায়ের সঙ্গীরা যার যার বাড়ির কাছে আসিয়া বিদায় লয়। মা যেন আসমানের চাঁদ। একটি একটি করিয়া তারাগুলি এখন মাকে ছাড়িয়া যাইতেছে, কিন্তু মায়ের মন আজ ভরপুর আনন্দে। ও-বাড়ি সে-বাড়ি ছাড়াইয়া মা নানাবাড়িতে ঢুকিলেন। নানি তখন ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ দিয়াছেন।
এমনি করিয়া কোথা দিয়া বারো-তেরোদিন কাটিয়া গেল টেরও পাইলাম না। প্রতিদিন সমানে গরীবুল্লা মাতবরের পুকুরে গোসল করা হইতেছে। প্রতিদিন বিকালে মা পাড়া বেড়াইতে বাহির হইতেছেন। আর নানি সারাদিন বসিয়া মা যে যে পিঠা পছন্দ করে সেই সেই পিঠা বানাইয়া, মা যে যে খাবার পছন্দ করে সেই সেই খাবার তৈরি করিয়া মাকে সাধিয়া সাধিয়া খাওয়াইতেছেন।

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৪১)

১১:০৩:৫৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

নিজেরাই তো পানের বরজ করিতে পারিত। কত পয়সা পাইত। বারোইদের মতো আটচালা ঘর করিতে পারিত। তারা পরের পানের বরে খাটিয়া মরে। একটা দুইটা তিনটা পাশাপাশি পানের বর। চারিদিক পাটখড়ির বেড়া। তারই ফাঁকে ফাঁকে সবুজ পাতা মেলিয়া পানগাছগুলি দেখা যায় যেন কতকগুলি শ্যামলা রঙের গ্রাম্য মেয়ে। সরু পাটখড়ির চিকের আড়াল হইতে উকি দিতেছে।
পান বড় হইলে বাড়ির বউরা যায়, মেয়েরা যায়, নরম তুলতুলে হাতে একটা একটা করিয়া বোঁটা হইতে পান ছেড়ে। সাবধান হইবে। আশেপাশের কচি পাতাগুলির গায়ে যেন আঘাত লাগে না। অতি আদরের সঙ্গে মেয়েরা পান পাতা তুলিয়া আনে। তারপর উঠানে বসিয়া পানের আকার অনুসারে পান সাজায়। বড় বড় দুইটা পানের মধ্যে একটা ছোট পান ঢুকাইয়া দেয়। এমনি করিয়া আশিটি পানে এক পণ। বরোই-বউরা কি চালাক। এক পণ পানের মধ্যে চল্লিশটি ছোট পান ঢুকাইয়া দেয়। বারোইরা হাটে যাইয়া পানগুলি এমনি মুন্সিয়ানার সঙ্গে উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখায় যাহাতে ক্রেতাদের চোখে শুধু বড় বড় পানগুলিই পড়ে। এই পানের জন্য আমার নানার দেশের নাম তাম্বুলখানা।
কত দেশে যায় তাম্বুলখানার পান। পদ্মানদী পার হইয়া ঢাকা যায়-পাবনা যায়। রেলগাড়ি চড়িয়া যায় রংপুর-দিনাজপুর আরও কত দেশে। কলিকাতাও হয়তো যায়। এমন মিঠা পান কোনো দেশে হয় না। জানি পদ্মাপারের ঢাকার জেলায় আছে ঢাকাই-পান-খুব বড় বড় পান। হইলে কি হইবে? খাইতে ঝাল, তার পাতা পাতলা। এমন না-পুরু না-পাতলা তাম্বুলখানার মিঠা পান যে খাইয়াছে সে কোনোদিন ভুলিবে না। বরোইদের বরে আছে সাঁচিপান। খাইতে এমন খোশবু বাহির হয় মুখ দিয়া। নতুন বউ বরের সঙ্গে প্রথম দেখা করিতে বাটা ভরিয়া সাঁচিপান লইয়া যায়। তাম্বুলখানার বরোইরা লেখাপড়া করিয়া বড় খেতাব পায় নাই। কিন্তু তাদের বংশানুক্রমিক মেহনতের ফলে তারা আজ দেশবিখ্যাত। এমনি কত গ্রাম বিখ্যাত হইয়া আছে এই মেহনতি মানুষের কর্মনৈপুণ্যে। চাঁদপুরের কামারেরা দা কাঁচি একবার গড়াইয়া দিলে জিন্দেগি কাটিয়া যাইবে। তিন দিনের পথ হইতে লোক আসে তাহাদের ঘরে দা কাঁচি গড়াইতে। কেশবনগরের দই যে খাইয়াছে আর ভুলিবে না। এমনি কত গ্রাম কতরকমের কাজের জন্য বিখ্যাত হইয়া আছে।
ওদিকে গল্প করা শেষ হইয়াছে। বেলা ডুবুডুবু। রাঙাছুটু এবার বাড়ি ফিরিবে। বাড়ি হইতে বাহির হইবার পর মায়ের পাড়া-বেড়ানির দল ক্রমেই ব্যাড়িতেছিল- ও-বাড়ির ফেলি, সে-বাড়ির সাজু, রাঙা-বস্তু, রূপবানী আরও কত মেয়ে আসিয়া মায়ের দলে মিশিয়াছিল। এখন মা বাড়ি ফিরিতেছেন। মায়ের সঙ্গীরা যার যার বাড়ির কাছে আসিয়া বিদায় লয়। মা যেন আসমানের চাঁদ। একটি একটি করিয়া তারাগুলি এখন মাকে ছাড়িয়া যাইতেছে, কিন্তু মায়ের মন আজ ভরপুর আনন্দে। ও-বাড়ি সে-বাড়ি ছাড়াইয়া মা নানাবাড়িতে ঢুকিলেন। নানি তখন ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ দিয়াছেন।
এমনি করিয়া কোথা দিয়া বারো-তেরোদিন কাটিয়া গেল টেরও পাইলাম না। প্রতিদিন সমানে গরীবুল্লা মাতবরের পুকুরে গোসল করা হইতেছে। প্রতিদিন বিকালে মা পাড়া বেড়াইতে বাহির হইতেছেন। আর নানি সারাদিন বসিয়া মা যে যে পিঠা পছন্দ করে সেই সেই পিঠা বানাইয়া, মা যে যে খাবার পছন্দ করে সেই সেই খাবার তৈরি করিয়া মাকে সাধিয়া সাধিয়া খাওয়াইতেছেন।

চলবে…