০৩:১২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫

দুর্গা-মহিষাসুরের যুদ্ধের ভিন্ন যে কাহিনীতে বিশ্বাস করেন অসুরের বংশধরেরা

  • Sarakhon Report
  • ০২:১৯:৩০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪
  • 21

ভারতের অনেক আদিবাসী বহুল এলাকায় মহিষাসুরের মূর্তি বসিয়ে 'অসুর স্মরণ' অনুষ্ঠান করা হচ্ছে

অমিতাভ ভট্টশালী

“আমি যখন প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গে যাই একটা কর্মসূচীতে, সেখানে আমি গেছি শুনে অনেক মানুষ আমাকে শুধু দেখতেই চলে এসেছিলেন। আমি কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম, বুঝতেই পারছিলাম না যে কেন সবাই আমাকে দেখতে আসছে!”

তার সেই ‘অবাক’ হওয়া অবস্থাটা কেটেছিল তাকে দেখতে আসা মানুষজনের প্রশ্নে।

“তারা আমাকে দেখে বলেছিলেন যে আরে আপনাকে এরকম দেখতে, আমাদের তো মনে হয়েছিল যে মাথায় শিঙ থাকবে, বড় বড় দাঁত থাকবে!” হাসতে হাসতে কথাগুলো বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অনিল অসুর।

হিন্দু বাঙালীদের সবথেকে বড় উৎসব দুর্গাপুজোর সময়ে যে মহিষাসুরের মূর্তি দেখা যায় দেবী দুর্গার পায়ের নিচে, সেই মহিষাসুরের সঙ্গে চেহারার মিল খুঁজতে গিয়েছিলেন ওই মানুষরা।

সেই মানুষজনকে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “আরে আমি তো মানুষ! কে বলেছে যে অসুরদের মাথায় শিং থাকে, বড় বড় দাঁত থাকে!

মি. অসুর বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আসলে মানুষের মনে ওরকমই একটা ছবি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে যে আমরা খলনায়ক, আমাদের ওইরকম দানবের মতো দেখতে। যারা মহিষাসুর সহ আমাদের পূর্বপুরুষদের পরাজিত করে আমাদের জমি-জঙ্গল দখল করে নিয়েছে, মানুষের মনে অসুর সম্পর্কে এরকম ধারণাটা তারাই তৈরি করেছে। কিন্তু সেটা তো আসলে আর্য-অনার্যদের লড়াইতে আমাদের ছলচাতুরী করে পরাজিত করার কাহিনী।”

এই উপজাতির সদস্য এবং নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন যে হিন্দু বাঙালীদের দুর্গাপুজোয় যে মহিষাসুর বধের কাহিনী রয়েছে, তিনি এই অসুর উপজাতিরই পূর্বপুরুষ, মহা-বিক্রমশালী এক আদিবাসী রাজা ছিলেন।

তবে হিন্দু পুরাণ বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মধ্যে আবার দুর্গাপূজোর কাহিনী আদৌ আর্য-অনার্যদের লড়াই কী না, তা নিয়ে মতভেদ আছে।

জ্যোতিরাও ফুলে অথবা বি আর আম্বেদকরের মতো দলিত-আদিবাসী শ্রেণির দৃষ্টিকোণ থেকে যারা ইতিহাস বিশ্লেষণ করেন, তারা এই কাহিনীকে আর্য-অনার্যদের মধ্যে লড়াই বললেও হিন্দু শাস্ত্রের পণ্ডিতরা তা মানেন না।

অনিল অসুর

দুর্গাপুজো ও অসুর

অনিল অসুর সেই ‘অসুর’ তপশীলি উপজাতির মানুষ। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার আর ঝাড়খণ্ডে তপশীলি উপজাতিদের যে সরকারি তালিকা আছে, তার মধ্যে প্রথম নামটিই এই অসুর উপজাতির।

ঝাড়খণ্ডের গুমলা জেলায় থাকেন অনিল অসুর। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, সিপিআইয়ের সদস্য। দুবার বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থীও হয়েছিলেন।

তারা পেশাগত ভাবে পাথর গলিয়ে লোহা বার করার কাজ করে থাকেন। সেই প্রাচীন পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে রক্ষা করেন তারা। তবে অনেক অসুরই অন্যান্য পেশাও বেছে নিয়েছেন এখন।

“যেমন আমার বাবা তো স্কুল শিক্ষক ছিলেন। বাবার কথায় মনে পড়ল, একবার দুর্গাপুজোর সময়ে আমার মা পুজো দিতে যাচ্ছিলেন, বাবা কিছুটা স্বগতোক্তি করেই বলেছিলেন, ‘হুঁঃ, চলল আমাদের পূর্বজদের হত্যাকারিণীকে পুজো দিতে!’, অর্থাৎ আমাদের সম্প্রদায় এখনও বিশ্বাস করে যে দুর্গা আমাদের পূর্বপুরুষ মহিষাসুরকে হত্যা করেছিলেন। এরপর থেকে আর কখনও আমার মা দুর্গাপুজো দিতেন না।”

“আমরা মহিষাসুরেরও পুজো করি না। তার কোনও বিগ্রহ বা প্রতিকৃতি অসুর পরিবারে থাকে না। আমরা শুধু মনে মনে তাকে প্রণাম জানাই, স্মরণ করি। তবে এখন আদিবাসী সমাজ দুর্গাপুজোর সময়ে যে অসুর পুজো বা অসুর স্মরণ করছেন, সেগুলো একটা পৃথক সামাজিক আন্দোলনের অংশ। এই সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে আর্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটা পাল্টা আখ্যান তৈরি হচ্ছে,” বলছিলেন অনিল অসুর।

দুর্গা ও মহিষাসুরের যুদ্ধ, ১২৭৫ খ্রীষ্টাব্দের হাতে আঁকা ছবি – রাজস্থানের বিকানের থেকে সংগৃহীত

মহিষাসুর বধের ‘পাল্টা আখ্যান’

হিন্দু পুরাণে যেমন মহিষাসুর আর দেবী দুর্গার যুদ্ধের কাহিনী আছে, আদিবাসী লোকগাথাতেও সেই কাহিনী রয়েছে, কিন্তু দুটি কাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বিপরীত।

হিন্দু পুরাণের গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন বলছিলেন “মহিষাসুর ছিলেন অত্যন্ত বলশালী এবং প্রজাবৎসল এক রাজা। আদিবাসীদের প্রচলিত লোকগাথা অনুযায়ী এক গৌরবর্ণা নারীকে দিয়ে তাদের রাজাকে হত্যা করা হয়েছিল।”

“এক গৌরবর্ণা নারীই যে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন, তা হিন্দু পুরাণেও আছে। দেবী দুর্গার যে প্রতিমা গড়া হয়, সেখানে দুর্গা গৌরবর্ণা, টিকলো নাক, যেগুলি আর্যদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য। দুর্গার আরেক নাম সেজন্যই গৌরী। অন্যদিকে মহিষাসুরের যে মূর্তি গড়া হয় দুর্গাপূজায়, সেখান তার গায়ের রঙ কালো, কোঁকড়ানো চুল, পুরু ঠোঁট। এগুলো সবই অনার্যদের বৈশিষ্ট্য,” ব্যাখ্যা করছিলেন তথ্যচিত্র নির্মাতা সুমিত চৌধুরী।

তিনি মহিষাসুর সহ ভারতের আদিবাসীদের উৎস সন্ধানে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন।

মি. উদ্দীপন আরও বলছিলেন যে আর্যরা ভারতে আসার পরে তারা কোনোভাবেই মহিষাসুরকে পরাজিত করতে পারছিল না। তাই তারা একটা কৌশল নেন। একজন নারীকে তারা ব্যবহার করেন মহিষাসুরকে বধ করার জন্য।

“রাজা মহিষাসুরের সময়ে নারীদের অত্যন্ত সম্মান দেওয়া হত। একজন রাজা কোনও নারীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন না, বা তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না, এরকমটাই ধারণা ছিল আর্যদের। তাই তারা এক নারীকে এই কাজে ব্যবহার করেছিলেন বলেই আদিবাসী সমাজ বিশ্বাস করে,” বলছিলেন হিন্দু পুরাণ গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন।

তার কথায় দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের কাহিনী আসলে আর্য-অনার্যদের লড়াইয়ের কাহিনী। এই একই কথা বলেছেন অনিল অসুরও।

শরদিন্দু উদ্দীপন অবশ্য দলিতদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুরাণের গবেষণা করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে উনবিংশ শতকে প্রথম পৌরাণিক কাহিনীগুলির বিশ্লেষণ ও সমালোচনামূলক পর্যালোচনা করেছিলেন সামাজিক কর্মকর্তা ও ইতিহাসবিদ জ্যোতিরাও ফুলে।

হিন্দুদের অবতার ও দেবদেবীদের আলোকে তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন ভারতের আদিবাসীদের লোকগাথা ও ইতিহাস।

তারপরে মি. ফুলের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান ভারতের সংবিধান রচয়িতা বি. আর. আম্বেদকর।

পুরাণ ও লোককথার ওপরে ভিত্তি করে তিনি আর্য ও অনার্যদের সংঘাতকে বিশ্লেষণ করেছিলেন।

তার লেখাতেই প্রথম বলা হয় দানব, রাক্ষস, দৈত্য, কিন্নর, নাগ, যক্ষ এরা সব মিলে যে অসুর সম্প্রদায়, তারা আসলে মানুষই ছিলেন। তিনিই প্রথম এই অসুর সম্প্রদায়ের লড়াইয়ের ইতিহাস তুলে ধরেন।

তামিলনাডুর মহাবলিপুরমে মহিষাসুরমর্দিনী গুহায় দেবী দুর্গা ও মহিষাসুরের যুদ্ধে খোদাই করা ভাস্কর্য, খ্রষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর নিদর্শন

হিন্দু শাস্ত্রে যা পাওয়া যায়

অন্যদিকে হিন্দুরা মহিষাসুরকে একজন অশুভ শক্তির প্রতিভূ হিসাবে দেখেন।

হিন্দু শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ও পশ্চিমবঙ্গ বৈদিক অ্যাকাডেমির প্রধান নবকুমার ভট্টাচার্য বলছিলেন যে আর্য-অনার্যদের লড়াইয়ের যে তত্ত্ব, সেটা কিন্তু আগে শোনা যায় নি।

“বেদ, পুরাণ, উপনিষদে ছড়িয়ে রয়েছে দুর্গাপুজোর কাহিনী। আবার বেদের মধ্যেই এটাও আছে যে অসুর মানেই খারাপ, তা কিন্তু নয়। মহিষাসুর বধের কাহিনী আমরা দেখি, সেটা কিন্তু পুরো অসুর সম্প্রদায়কে বধের ঘটনা নয়। এটা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির লড়াইয়ের ইতিহাস।”

”পুরাণে তো আমরা ভাল অসুরও দেখতে পাই, যেমন ময়দানব। তিনিও তো অসুরই ছিলেন, কিন্তু হিন্দুরা কারিগরি বিদ্যার দেবতা বলে যাকে পুজো করেন, সেই বিশ্বকর্মার পরেই স্থান ছিল এই অসুর ময়দানবের। তিনি কারিগরি বিদ্যায়, নির্মাণের ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষ ছিলেন।”

“তাই অসুর মানে সেসময়ের একজন অতি শক্তিশালী ব্যক্তি, একটা কু-ভাবনা। সেরকম তো এখনও আছে। আবার দুর্গাপুজোয় কিন্তু মহিষাসুরকেও পুজো করা হয়। তার মধ্যেও তো প্রাণ আছে,” বলছিলেন মি. ভট্টাচার্য।

চণ্ডী এবং কালিকাপুরাণ উদ্ধৃত করে নবকুমার ভট্টাচার্য বলছিলেন, “যখন মহিষাসুর মারা যাচ্ছেন, তখন তিনি দেবী দুর্গার কাছে আত্মসমর্পণ করছেন। তার মধ্যে কোনও পাপবোধ ছিল বলেই তো সে আত্মসমর্পণ করে বলছে যে আমি যেন তোমার সঙ্গে থাকতে পারি, তোমার সঙ্গেই পুজো পাই। তার মধ্যে যে সংশোধনের ভাবনাটা এসেছে, তার জন্যই তাকে পুজো করা হচ্ছে।“

তিনি এও বলছিলেন যে দুর্গাপুজোর নানা নিয়মরীতির মধ্যেই কিন্তু আদিবাসী সমাজের অনেক প্রথা আজও চালু আছে – যেমন নবপত্রিকার পুজো। সেটা তো আদতে আদিবাসীদের প্রকৃতি পুজো। আবার তামসিক পদ্ধতিতে যে দুর্গাপুজো হয়, সেটা তো কিরাত, শবরদের পুজো। তারা তো আদিবাসীই।

অসুর স্মরণ অনুষ্ঠানে আদিবাসীদের নাচ

আদিবাসীদের অসুর স্মরণ যেভাবে

পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী সমাজ বলছে, দুর্গাপুজো হয় যে সময়ে, সেটা তাদের কাছে দাসাই মাস। সেই মাসের ষষ্ঠী, সপ্তমী থেকেই শুরু হয় শোক পালন। দাসাই, ভুয়াং এগুলো চলতে থাকে পাড়ায় পাড়ায়। আর দশমীর দিন হয় বড় অনুষ্ঠান।

গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন অনেক জায়গায় অসুর স্মরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন।

তিনি বলছিলেন, “কোথাও অরন্ধন পালন করা হয়, কোথাও জানলা-দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকেন আদিবাসীরা, যাতে দুর্গাপূজার যে উৎসব, সেই মন্ত্র বা ঢাকের শব্দ যাতে তাদের কানে না যায়।

“দুর্গাপূজার এই সময়ে তারা অশৌচ পালন করেন এবং ভুয়াং বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নাচ হয়। দাসাই নাচ করেন তারা, যেখানে পুরুষরা নারী যোদ্ধার ছদ্মবেশ ধারণ করে কান্নার সুরে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘোরেন। তাদের গানটা এরকম : ‘ওকার এদম ভুয়াং এদম জনম লেনা রে, ওকার এদম ভুয়াং এদম বছর লেনা রে’,” বলছিলেন শরদিন্দু উদ্দীপন।

তারা ‘বিন্দি বা মাকড়সাকে বলে, ‘ও বিন্দি, তোমরা কি কেউ আমার রাজাকে দেখেছ? আমাদের রাজাকে কোনও এক গৌরবর্ণা নারী চুরি করে নিয়ে গেছে’,” আদিবাসী সমাজের লোকগাথা বিশ্লেষণ করে বলছিলেন শরদিন্দু উদ্দীপন।

এবছর অসুর স্মরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সাড়ে সাত হাজার জায়গায়।

তবে এইভাবে যে শোক পালন অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে, তার সঙ্গে চিরাচরিত প্রথায় শোক পালনের একটা ফারাক আছে বলে মনে করেন মহিষাসুর গবেষক প্রমোদ রঞ্জন।

মি. রঞ্জন ভারতের নানা জায়গায় ঘুরে মহিষাসুর সম্বন্ধীয় ঐতিহাসিক প্রমাণ যোগাড় করেছেন।

“তফাৎটা হল যে চিরাচরিত প্রথায় যেভাবে শোক পালন হত, তার ভিত্তি ছিল লোকগাথা আর এখন যেটা হচ্ছে সেটা একটা ইতিবাচক সাংস্কৃতিক রাজনীতি। যেটা একদিকে মনু-বাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আদিবাসী সমাজের রুখে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা অন্যদিকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস,” বলছিলেন মি. রঞ্জন।

খাজুরাহোর মন্দিরে মহিষাসুরের মূর্তি

মহিষাসুরের ইতিহাস

গবেষকদের মতে মহিষাসুর সংক্রান্ত যে লোকগাথা রয়েছে, তা প্রায় তিন হাজার বছর পুরনো, যখন আর্যরা ভারতবর্ষে আসেননি।

মহিষাসুর সম্বন্ধীয় লোকগাথা গোটা দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই পাওয়া যায়। উত্তর ভারত থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্য, বর্তমানের নেপাল – বাংলাদেশেরও নানা জায়গায়।

মহিষাসুর গবেষক প্রমোদ রঞ্জনের কথায়, “বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এই অসুর জাতির ইতিহাস আর্যদের পূর্ববর্তী যুগের ইতিহাস। আমরা যেমন মহিষাসুরকে খুঁজে পেয়েছি বর্তমান উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখন্ডে, আবার এখনকার যে মহীশুর বা মাইসোর শহর, সেই অঞ্চলেও মহিষাসুরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আবার খাজুরাহোর যে বিশ্বখ্যাত মন্দির, সেখানেও মহিষাসুরের মূর্তি পেয়েছি আমরা। অর্থাৎ শুধু যে লোকগাথায় মহিষাসুর আছেন, তা নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও খুঁজে পেয়েছি আমরা।”

‘অসুর’ নামের যে জনজাতি, তারা ছাড়াও ভারতের আদিমতম আদিবাসী বলে পরিচিত ছত্তিশগড়ের গোন্ড সম্প্রদায়ের মধ্যেও মহিষাসুরের লোকগাথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত বলে জানাচ্ছিলেন মি. রঞ্জন।

তার কাছে কতগুলি ছবি আসে ২০১৪ সালে, যেগুলি ছিল উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখন্ড এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মহিষাসুরের কয়েকটি প্রত্ন নিদর্শনের ছবি।

প্রমোদ রঞ্জন সেই সময়ে দিল্লির ফরোয়ার্ড প্রেস নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা, যারা মূলত দলিত সম্প্রদায়ের সাহিত্য নিয়ে কাজ করে, সেটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।

তার মধ্যে এমন একটি ছবি ছিল, যেটি ভারত সরকারের আর্কিওলজিকাল সার্ভের সংরক্ষিত একটি নিদর্শন, যার নাম মহিষাসুর স্মারক।

উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ডে এই মন্দিরে মহিষাসুরের পুজো হয়

যেভাবে পাওয়া গেল মহিষাসুর স্মারক

প্রমোদ রঞ্জনের কথায়, “শুধুমাত্র ওই কয়েকটি ছবি সম্বল করে আমি এবং আমার এক সহকর্মী ট্রেনে চেপে দিল্লি থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে মাহোবা রেল স্টেশনে নেমেছিলাম এক রাতে। স্টেশনের আশেপাশে অনেককে দেখিয়েছিলাম ছবিগুলো। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি যে ওই জায়গাগুলো কোথায়।”

দিন দুয়েক পরে তারা খুঁজে পেয়েছিলেন মহিষাসুর স্মারক।

“একজন আমাদের পাঠায় কুলাপাহাড় নামের এক জায়গায়, কিন্তু সেখানেও কিছু পাইনি আমরা। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে কুলাপাহাড় থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে চাউকা নামের একটা জায়গার কথা বলে একজন। সেখানে পৌঁছিয়ে আমরা নিশ্চিত হলাম যে সঠিক জায়গায় এসেছি। পুরাতত্ত্ব বিভাগের একটি বোর্ড দেখতে পেলাম,” বলছিলেন প্রমোদ রঞ্জন।

ওই স্মারকটি ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষণ করে রেখেছে। পরে মি. রঞ্জনের এক প্রশ্নের জবাবে পুরাতত্ত্ব বিভাগ জানায় যে ওই স্মারকটি একাদশ শতকের।

দিন দুয়েক পরে মাহোবায় ফিরে এসে কাছাকাছি মহিষাসুরের আরও নিদর্শন খুঁজতে থাকেন তারা।

গোখর পাহাড়ে আলাপ হওয়া এক সাধুর কাছে তাঁরা জানতে পারেন যে ওই অঞ্চলে মহিষাসুর ব্যাপকভাবে পূজিত হন। কোথাও ভৈঁসাসুর, কোথাও মাইকাসুর আবার কোথাও মহিষাসুর নামে তাঁর পূজো দেন দলিত শ্রেণীর যাদব আর পাল বংশীয় মানুষ। মহিষাসুরকে তাঁরা গরু, মোষের মতো গৃহপালিত পশুর রক্ষাকর্তা বলে মনে করেন।

মি. রঞ্জন বলছেন, গ্রামগুলিতে মহিষাসুরের মন্দির থাকে না, তবে বাঁধানো চাতাল মতো একটা জায়গায় পূজা করেন স্থানীয় মানুষ।

আবার খাজুরাহোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটেও তিনি মহিষাসুরের মূর্তি দেখতে পেয়েছেন।

সব নিদর্শনগুলি দেখে প্রমোদ রঞ্জনের মত হল, “মহিষাসুর নানা যুগেই ছড়িয়ে ছিলেন। তাই এটা সম্ভবত কোনও এক ব্যক্তি নন, এটা একটা উপাধি। যার পরম্পরা দক্ষিণ এশিয়ার নানা এলাকায় ছড়িয়ে আছে। যে পরম্পরা হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে আসছেন আদিবাসীরা।”

[এই প্রতিবেদনের কিছু অংশ নেওয়া হয়েছে মহিষাসুর ও তার বংশধরদের নিয়ে চার বছর আগে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে।]

বিবিসি নিউজ বাংলা, কলকাতা

দুর্গা-মহিষাসুরের যুদ্ধের ভিন্ন যে কাহিনীতে বিশ্বাস করেন অসুরের বংশধরেরা

০২:১৯:৩০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪

অমিতাভ ভট্টশালী

“আমি যখন প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গে যাই একটা কর্মসূচীতে, সেখানে আমি গেছি শুনে অনেক মানুষ আমাকে শুধু দেখতেই চলে এসেছিলেন। আমি কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম, বুঝতেই পারছিলাম না যে কেন সবাই আমাকে দেখতে আসছে!”

তার সেই ‘অবাক’ হওয়া অবস্থাটা কেটেছিল তাকে দেখতে আসা মানুষজনের প্রশ্নে।

“তারা আমাকে দেখে বলেছিলেন যে আরে আপনাকে এরকম দেখতে, আমাদের তো মনে হয়েছিল যে মাথায় শিঙ থাকবে, বড় বড় দাঁত থাকবে!” হাসতে হাসতে কথাগুলো বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অনিল অসুর।

হিন্দু বাঙালীদের সবথেকে বড় উৎসব দুর্গাপুজোর সময়ে যে মহিষাসুরের মূর্তি দেখা যায় দেবী দুর্গার পায়ের নিচে, সেই মহিষাসুরের সঙ্গে চেহারার মিল খুঁজতে গিয়েছিলেন ওই মানুষরা।

সেই মানুষজনকে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “আরে আমি তো মানুষ! কে বলেছে যে অসুরদের মাথায় শিং থাকে, বড় বড় দাঁত থাকে!

মি. অসুর বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আসলে মানুষের মনে ওরকমই একটা ছবি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে যে আমরা খলনায়ক, আমাদের ওইরকম দানবের মতো দেখতে। যারা মহিষাসুর সহ আমাদের পূর্বপুরুষদের পরাজিত করে আমাদের জমি-জঙ্গল দখল করে নিয়েছে, মানুষের মনে অসুর সম্পর্কে এরকম ধারণাটা তারাই তৈরি করেছে। কিন্তু সেটা তো আসলে আর্য-অনার্যদের লড়াইতে আমাদের ছলচাতুরী করে পরাজিত করার কাহিনী।”

এই উপজাতির সদস্য এবং নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন যে হিন্দু বাঙালীদের দুর্গাপুজোয় যে মহিষাসুর বধের কাহিনী রয়েছে, তিনি এই অসুর উপজাতিরই পূর্বপুরুষ, মহা-বিক্রমশালী এক আদিবাসী রাজা ছিলেন।

তবে হিন্দু পুরাণ বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মধ্যে আবার দুর্গাপূজোর কাহিনী আদৌ আর্য-অনার্যদের লড়াই কী না, তা নিয়ে মতভেদ আছে।

জ্যোতিরাও ফুলে অথবা বি আর আম্বেদকরের মতো দলিত-আদিবাসী শ্রেণির দৃষ্টিকোণ থেকে যারা ইতিহাস বিশ্লেষণ করেন, তারা এই কাহিনীকে আর্য-অনার্যদের মধ্যে লড়াই বললেও হিন্দু শাস্ত্রের পণ্ডিতরা তা মানেন না।

অনিল অসুর

দুর্গাপুজো ও অসুর

অনিল অসুর সেই ‘অসুর’ তপশীলি উপজাতির মানুষ। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার আর ঝাড়খণ্ডে তপশীলি উপজাতিদের যে সরকারি তালিকা আছে, তার মধ্যে প্রথম নামটিই এই অসুর উপজাতির।

ঝাড়খণ্ডের গুমলা জেলায় থাকেন অনিল অসুর। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, সিপিআইয়ের সদস্য। দুবার বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থীও হয়েছিলেন।

তারা পেশাগত ভাবে পাথর গলিয়ে লোহা বার করার কাজ করে থাকেন। সেই প্রাচীন পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে রক্ষা করেন তারা। তবে অনেক অসুরই অন্যান্য পেশাও বেছে নিয়েছেন এখন।

“যেমন আমার বাবা তো স্কুল শিক্ষক ছিলেন। বাবার কথায় মনে পড়ল, একবার দুর্গাপুজোর সময়ে আমার মা পুজো দিতে যাচ্ছিলেন, বাবা কিছুটা স্বগতোক্তি করেই বলেছিলেন, ‘হুঁঃ, চলল আমাদের পূর্বজদের হত্যাকারিণীকে পুজো দিতে!’, অর্থাৎ আমাদের সম্প্রদায় এখনও বিশ্বাস করে যে দুর্গা আমাদের পূর্বপুরুষ মহিষাসুরকে হত্যা করেছিলেন। এরপর থেকে আর কখনও আমার মা দুর্গাপুজো দিতেন না।”

“আমরা মহিষাসুরেরও পুজো করি না। তার কোনও বিগ্রহ বা প্রতিকৃতি অসুর পরিবারে থাকে না। আমরা শুধু মনে মনে তাকে প্রণাম জানাই, স্মরণ করি। তবে এখন আদিবাসী সমাজ দুর্গাপুজোর সময়ে যে অসুর পুজো বা অসুর স্মরণ করছেন, সেগুলো একটা পৃথক সামাজিক আন্দোলনের অংশ। এই সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে আর্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটা পাল্টা আখ্যান তৈরি হচ্ছে,” বলছিলেন অনিল অসুর।

দুর্গা ও মহিষাসুরের যুদ্ধ, ১২৭৫ খ্রীষ্টাব্দের হাতে আঁকা ছবি – রাজস্থানের বিকানের থেকে সংগৃহীত

মহিষাসুর বধের ‘পাল্টা আখ্যান’

হিন্দু পুরাণে যেমন মহিষাসুর আর দেবী দুর্গার যুদ্ধের কাহিনী আছে, আদিবাসী লোকগাথাতেও সেই কাহিনী রয়েছে, কিন্তু দুটি কাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বিপরীত।

হিন্দু পুরাণের গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন বলছিলেন “মহিষাসুর ছিলেন অত্যন্ত বলশালী এবং প্রজাবৎসল এক রাজা। আদিবাসীদের প্রচলিত লোকগাথা অনুযায়ী এক গৌরবর্ণা নারীকে দিয়ে তাদের রাজাকে হত্যা করা হয়েছিল।”

“এক গৌরবর্ণা নারীই যে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন, তা হিন্দু পুরাণেও আছে। দেবী দুর্গার যে প্রতিমা গড়া হয়, সেখানে দুর্গা গৌরবর্ণা, টিকলো নাক, যেগুলি আর্যদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য। দুর্গার আরেক নাম সেজন্যই গৌরী। অন্যদিকে মহিষাসুরের যে মূর্তি গড়া হয় দুর্গাপূজায়, সেখান তার গায়ের রঙ কালো, কোঁকড়ানো চুল, পুরু ঠোঁট। এগুলো সবই অনার্যদের বৈশিষ্ট্য,” ব্যাখ্যা করছিলেন তথ্যচিত্র নির্মাতা সুমিত চৌধুরী।

তিনি মহিষাসুর সহ ভারতের আদিবাসীদের উৎস সন্ধানে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন।

মি. উদ্দীপন আরও বলছিলেন যে আর্যরা ভারতে আসার পরে তারা কোনোভাবেই মহিষাসুরকে পরাজিত করতে পারছিল না। তাই তারা একটা কৌশল নেন। একজন নারীকে তারা ব্যবহার করেন মহিষাসুরকে বধ করার জন্য।

“রাজা মহিষাসুরের সময়ে নারীদের অত্যন্ত সম্মান দেওয়া হত। একজন রাজা কোনও নারীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন না, বা তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না, এরকমটাই ধারণা ছিল আর্যদের। তাই তারা এক নারীকে এই কাজে ব্যবহার করেছিলেন বলেই আদিবাসী সমাজ বিশ্বাস করে,” বলছিলেন হিন্দু পুরাণ গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন।

তার কথায় দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের কাহিনী আসলে আর্য-অনার্যদের লড়াইয়ের কাহিনী। এই একই কথা বলেছেন অনিল অসুরও।

শরদিন্দু উদ্দীপন অবশ্য দলিতদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুরাণের গবেষণা করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে উনবিংশ শতকে প্রথম পৌরাণিক কাহিনীগুলির বিশ্লেষণ ও সমালোচনামূলক পর্যালোচনা করেছিলেন সামাজিক কর্মকর্তা ও ইতিহাসবিদ জ্যোতিরাও ফুলে।

হিন্দুদের অবতার ও দেবদেবীদের আলোকে তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন ভারতের আদিবাসীদের লোকগাথা ও ইতিহাস।

তারপরে মি. ফুলের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান ভারতের সংবিধান রচয়িতা বি. আর. আম্বেদকর।

পুরাণ ও লোককথার ওপরে ভিত্তি করে তিনি আর্য ও অনার্যদের সংঘাতকে বিশ্লেষণ করেছিলেন।

তার লেখাতেই প্রথম বলা হয় দানব, রাক্ষস, দৈত্য, কিন্নর, নাগ, যক্ষ এরা সব মিলে যে অসুর সম্প্রদায়, তারা আসলে মানুষই ছিলেন। তিনিই প্রথম এই অসুর সম্প্রদায়ের লড়াইয়ের ইতিহাস তুলে ধরেন।

তামিলনাডুর মহাবলিপুরমে মহিষাসুরমর্দিনী গুহায় দেবী দুর্গা ও মহিষাসুরের যুদ্ধে খোদাই করা ভাস্কর্য, খ্রষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর নিদর্শন

হিন্দু শাস্ত্রে যা পাওয়া যায়

অন্যদিকে হিন্দুরা মহিষাসুরকে একজন অশুভ শক্তির প্রতিভূ হিসাবে দেখেন।

হিন্দু শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ও পশ্চিমবঙ্গ বৈদিক অ্যাকাডেমির প্রধান নবকুমার ভট্টাচার্য বলছিলেন যে আর্য-অনার্যদের লড়াইয়ের যে তত্ত্ব, সেটা কিন্তু আগে শোনা যায় নি।

“বেদ, পুরাণ, উপনিষদে ছড়িয়ে রয়েছে দুর্গাপুজোর কাহিনী। আবার বেদের মধ্যেই এটাও আছে যে অসুর মানেই খারাপ, তা কিন্তু নয়। মহিষাসুর বধের কাহিনী আমরা দেখি, সেটা কিন্তু পুরো অসুর সম্প্রদায়কে বধের ঘটনা নয়। এটা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির লড়াইয়ের ইতিহাস।”

”পুরাণে তো আমরা ভাল অসুরও দেখতে পাই, যেমন ময়দানব। তিনিও তো অসুরই ছিলেন, কিন্তু হিন্দুরা কারিগরি বিদ্যার দেবতা বলে যাকে পুজো করেন, সেই বিশ্বকর্মার পরেই স্থান ছিল এই অসুর ময়দানবের। তিনি কারিগরি বিদ্যায়, নির্মাণের ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষ ছিলেন।”

“তাই অসুর মানে সেসময়ের একজন অতি শক্তিশালী ব্যক্তি, একটা কু-ভাবনা। সেরকম তো এখনও আছে। আবার দুর্গাপুজোয় কিন্তু মহিষাসুরকেও পুজো করা হয়। তার মধ্যেও তো প্রাণ আছে,” বলছিলেন মি. ভট্টাচার্য।

চণ্ডী এবং কালিকাপুরাণ উদ্ধৃত করে নবকুমার ভট্টাচার্য বলছিলেন, “যখন মহিষাসুর মারা যাচ্ছেন, তখন তিনি দেবী দুর্গার কাছে আত্মসমর্পণ করছেন। তার মধ্যে কোনও পাপবোধ ছিল বলেই তো সে আত্মসমর্পণ করে বলছে যে আমি যেন তোমার সঙ্গে থাকতে পারি, তোমার সঙ্গেই পুজো পাই। তার মধ্যে যে সংশোধনের ভাবনাটা এসেছে, তার জন্যই তাকে পুজো করা হচ্ছে।“

তিনি এও বলছিলেন যে দুর্গাপুজোর নানা নিয়মরীতির মধ্যেই কিন্তু আদিবাসী সমাজের অনেক প্রথা আজও চালু আছে – যেমন নবপত্রিকার পুজো। সেটা তো আদতে আদিবাসীদের প্রকৃতি পুজো। আবার তামসিক পদ্ধতিতে যে দুর্গাপুজো হয়, সেটা তো কিরাত, শবরদের পুজো। তারা তো আদিবাসীই।

অসুর স্মরণ অনুষ্ঠানে আদিবাসীদের নাচ

আদিবাসীদের অসুর স্মরণ যেভাবে

পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী সমাজ বলছে, দুর্গাপুজো হয় যে সময়ে, সেটা তাদের কাছে দাসাই মাস। সেই মাসের ষষ্ঠী, সপ্তমী থেকেই শুরু হয় শোক পালন। দাসাই, ভুয়াং এগুলো চলতে থাকে পাড়ায় পাড়ায়। আর দশমীর দিন হয় বড় অনুষ্ঠান।

গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন অনেক জায়গায় অসুর স্মরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন।

তিনি বলছিলেন, “কোথাও অরন্ধন পালন করা হয়, কোথাও জানলা-দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকেন আদিবাসীরা, যাতে দুর্গাপূজার যে উৎসব, সেই মন্ত্র বা ঢাকের শব্দ যাতে তাদের কানে না যায়।

“দুর্গাপূজার এই সময়ে তারা অশৌচ পালন করেন এবং ভুয়াং বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নাচ হয়। দাসাই নাচ করেন তারা, যেখানে পুরুষরা নারী যোদ্ধার ছদ্মবেশ ধারণ করে কান্নার সুরে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘোরেন। তাদের গানটা এরকম : ‘ওকার এদম ভুয়াং এদম জনম লেনা রে, ওকার এদম ভুয়াং এদম বছর লেনা রে’,” বলছিলেন শরদিন্দু উদ্দীপন।

তারা ‘বিন্দি বা মাকড়সাকে বলে, ‘ও বিন্দি, তোমরা কি কেউ আমার রাজাকে দেখেছ? আমাদের রাজাকে কোনও এক গৌরবর্ণা নারী চুরি করে নিয়ে গেছে’,” আদিবাসী সমাজের লোকগাথা বিশ্লেষণ করে বলছিলেন শরদিন্দু উদ্দীপন।

এবছর অসুর স্মরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সাড়ে সাত হাজার জায়গায়।

তবে এইভাবে যে শোক পালন অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে, তার সঙ্গে চিরাচরিত প্রথায় শোক পালনের একটা ফারাক আছে বলে মনে করেন মহিষাসুর গবেষক প্রমোদ রঞ্জন।

মি. রঞ্জন ভারতের নানা জায়গায় ঘুরে মহিষাসুর সম্বন্ধীয় ঐতিহাসিক প্রমাণ যোগাড় করেছেন।

“তফাৎটা হল যে চিরাচরিত প্রথায় যেভাবে শোক পালন হত, তার ভিত্তি ছিল লোকগাথা আর এখন যেটা হচ্ছে সেটা একটা ইতিবাচক সাংস্কৃতিক রাজনীতি। যেটা একদিকে মনু-বাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আদিবাসী সমাজের রুখে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা অন্যদিকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস,” বলছিলেন মি. রঞ্জন।

খাজুরাহোর মন্দিরে মহিষাসুরের মূর্তি

মহিষাসুরের ইতিহাস

গবেষকদের মতে মহিষাসুর সংক্রান্ত যে লোকগাথা রয়েছে, তা প্রায় তিন হাজার বছর পুরনো, যখন আর্যরা ভারতবর্ষে আসেননি।

মহিষাসুর সম্বন্ধীয় লোকগাথা গোটা দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই পাওয়া যায়। উত্তর ভারত থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্য, বর্তমানের নেপাল – বাংলাদেশেরও নানা জায়গায়।

মহিষাসুর গবেষক প্রমোদ রঞ্জনের কথায়, “বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এই অসুর জাতির ইতিহাস আর্যদের পূর্ববর্তী যুগের ইতিহাস। আমরা যেমন মহিষাসুরকে খুঁজে পেয়েছি বর্তমান উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখন্ডে, আবার এখনকার যে মহীশুর বা মাইসোর শহর, সেই অঞ্চলেও মহিষাসুরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আবার খাজুরাহোর যে বিশ্বখ্যাত মন্দির, সেখানেও মহিষাসুরের মূর্তি পেয়েছি আমরা। অর্থাৎ শুধু যে লোকগাথায় মহিষাসুর আছেন, তা নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও খুঁজে পেয়েছি আমরা।”

‘অসুর’ নামের যে জনজাতি, তারা ছাড়াও ভারতের আদিমতম আদিবাসী বলে পরিচিত ছত্তিশগড়ের গোন্ড সম্প্রদায়ের মধ্যেও মহিষাসুরের লোকগাথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত বলে জানাচ্ছিলেন মি. রঞ্জন।

তার কাছে কতগুলি ছবি আসে ২০১৪ সালে, যেগুলি ছিল উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখন্ড এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মহিষাসুরের কয়েকটি প্রত্ন নিদর্শনের ছবি।

প্রমোদ রঞ্জন সেই সময়ে দিল্লির ফরোয়ার্ড প্রেস নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা, যারা মূলত দলিত সম্প্রদায়ের সাহিত্য নিয়ে কাজ করে, সেটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।

তার মধ্যে এমন একটি ছবি ছিল, যেটি ভারত সরকারের আর্কিওলজিকাল সার্ভের সংরক্ষিত একটি নিদর্শন, যার নাম মহিষাসুর স্মারক।

উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ডে এই মন্দিরে মহিষাসুরের পুজো হয়

যেভাবে পাওয়া গেল মহিষাসুর স্মারক

প্রমোদ রঞ্জনের কথায়, “শুধুমাত্র ওই কয়েকটি ছবি সম্বল করে আমি এবং আমার এক সহকর্মী ট্রেনে চেপে দিল্লি থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে মাহোবা রেল স্টেশনে নেমেছিলাম এক রাতে। স্টেশনের আশেপাশে অনেককে দেখিয়েছিলাম ছবিগুলো। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি যে ওই জায়গাগুলো কোথায়।”

দিন দুয়েক পরে তারা খুঁজে পেয়েছিলেন মহিষাসুর স্মারক।

“একজন আমাদের পাঠায় কুলাপাহাড় নামের এক জায়গায়, কিন্তু সেখানেও কিছু পাইনি আমরা। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে কুলাপাহাড় থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে চাউকা নামের একটা জায়গার কথা বলে একজন। সেখানে পৌঁছিয়ে আমরা নিশ্চিত হলাম যে সঠিক জায়গায় এসেছি। পুরাতত্ত্ব বিভাগের একটি বোর্ড দেখতে পেলাম,” বলছিলেন প্রমোদ রঞ্জন।

ওই স্মারকটি ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষণ করে রেখেছে। পরে মি. রঞ্জনের এক প্রশ্নের জবাবে পুরাতত্ত্ব বিভাগ জানায় যে ওই স্মারকটি একাদশ শতকের।

দিন দুয়েক পরে মাহোবায় ফিরে এসে কাছাকাছি মহিষাসুরের আরও নিদর্শন খুঁজতে থাকেন তারা।

গোখর পাহাড়ে আলাপ হওয়া এক সাধুর কাছে তাঁরা জানতে পারেন যে ওই অঞ্চলে মহিষাসুর ব্যাপকভাবে পূজিত হন। কোথাও ভৈঁসাসুর, কোথাও মাইকাসুর আবার কোথাও মহিষাসুর নামে তাঁর পূজো দেন দলিত শ্রেণীর যাদব আর পাল বংশীয় মানুষ। মহিষাসুরকে তাঁরা গরু, মোষের মতো গৃহপালিত পশুর রক্ষাকর্তা বলে মনে করেন।

মি. রঞ্জন বলছেন, গ্রামগুলিতে মহিষাসুরের মন্দির থাকে না, তবে বাঁধানো চাতাল মতো একটা জায়গায় পূজা করেন স্থানীয় মানুষ।

আবার খাজুরাহোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটেও তিনি মহিষাসুরের মূর্তি দেখতে পেয়েছেন।

সব নিদর্শনগুলি দেখে প্রমোদ রঞ্জনের মত হল, “মহিষাসুর নানা যুগেই ছড়িয়ে ছিলেন। তাই এটা সম্ভবত কোনও এক ব্যক্তি নন, এটা একটা উপাধি। যার পরম্পরা দক্ষিণ এশিয়ার নানা এলাকায় ছড়িয়ে আছে। যে পরম্পরা হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে আসছেন আদিবাসীরা।”

[এই প্রতিবেদনের কিছু অংশ নেওয়া হয়েছে মহিষাসুর ও তার বংশধরদের নিয়ে চার বছর আগে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে।]

বিবিসি নিউজ বাংলা, কলকাতা