সারাক্ষণ ডেস্ক
দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু সহিষ্ণুতায় সক্ষম করে তোলা এবং তাদের সম্পৃক্ত করে দুরযোগ-পরবর্তী পুনবাসন ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। বক্তারা বলেন, আগস্টের বন্যায় আক্রান্ত মানুষের সহায়তায় তরুণ শিক্ষার্থী, স্বেচ্ছাসেবক, স্থানীয় জনসাধারণ এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে সাড়া দিয়েছে, তা ছিল অভাবনীয়। তবে বৰ্তমানে কুমিল্লা ও নোয়াখালীর জলাবদ্ধতা দূর করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যত দ্রুত সম্ভব এই জলাবদ্ধতা দূর করে সেখানে জীবন ও জীবিকা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পদপে নেওয়া প্রয়োজন।
ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বন্যা আক্রান্ত প্রায় ৩ লাখ সদস্যকে বীজ, সার, মাছের পোনা বিতরণসহ বিভিন্ন সহায়তা দিয়েছে।
ব্র্যাকের পক্ষ থেকে আয়োজিত ‘বন্যা-পরবর্তী পুনরুদ্ধার এবং পুনবাসন প্রচেষ্টায় করণীয় বিষয়ক বহুপক্ষীয় আলোচনা’ অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। গতকাল বুধবার ১৬ই অক্টোবর ২০২৪ তারিখে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতের অংশীজনেরা তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সম্ভাব্য সমাধান এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য পুনরুদ্ধার ও পুনবাসনে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টার বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন। আলোচনার মূল লক্ষ্য ছিল বন্যার মতো দুরযোগময় পরিস্থিতিতে পুনবাসন ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের চ্যালেঞ্জ, সম্ভাব্য সমাধান এবং এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় করমপন্থা নির্ধারণ।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি দুরযোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, বীর প্রতীক বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য্যের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। এই সমস্যাকে একটি দুরযোগ হিসেবে চিনিত করে তিনি জানান, বেকারত্বের হার ৫০ শতাংশের বেশি, এমন ৭৫টি উপজেলায় ৭৫ হাজার পরিবারকে ৩ বছর মেয়াদে মাসিক ১ হাজার টাকা খাদ্য সহায়তা এবং ২ হাজার টাকা জীবিকা সহায়তা দেওয়ার কর্যুপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এই খাতে খরচ হবে মোট ৮১৯ কোটি টাকা। তার মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি আগের চেয়ে অনেক দ্রুত হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন উপদেষ্টা ফারুক ই আজম।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ও সঞ্চালক, ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক বন্যায় পুনবাসনের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলো সামনে এসেছে, তার মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষি খাত, অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানুষের জীবন-জীবিকা উল্লেখযোগ্য। এই বন্যায় পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতির একটি অন্যতম কারণ। যেকোনো দুযোগে আগাম সতর্কতাব্যবস্থাটি আরও জোরদার করা প্রয়োজন। বন্যায় দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ের এনজিওগুলো কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে, সেগুলোও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তবর্ষে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ বলেন, পুনবাসনের ক্ষেত্রে আমাদের এখন তিনটি বিষয়ে নজর দেয়া প্রয়োজন। প্রথমত, সমন্বয় তথ্য শেয়ার করার মাধ্যমে যেন সবাই সহয়তা পায়। দ্বিতীয়ত অৰ্থ বরাদ্দ রাস্তা মেরামত ও পুনঃনির্মাণ, বাঁধ মেরামত এবং জলাবদ্ধতা দূর করতে আরো অর প্রয়োজন। তৃতীয়ত, কৃষককে নগদ সহায়তা দিতে হবে এবং এই কাজগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে হবে যেন আসছে শীতে বোরো ধান ও সবজি চাষে কোন সমস্যা না হয়।
দুরুযোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান, এনডিসি বলেন, বন্যার শুরুতেই মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনের একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন এবং এই লক্ এনজিওসহ সংশ্লিষ্ট সব সেক্টরের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। সেই কমিটির মাধ্যমে পুনর্বাসনের কাজ চলছে। এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. সাইদুর রহমান বলেন, বন্যা মোকাবিলায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে এনজিও ব্যুরোর পক্ষ থেকে সব ধরনের অনুমোদন প্রদানের কাজগুলো করা হয়েছে। এমনকি তা কণিকভাবে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। বন্যা মোকাবিলায় এনজিওর ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি বলেন, যেসব জেলায় সরকারের পক্ েপূর্ণাঙ্গ জনবল দিয়ে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না, সেখানে এনজিওরা জনবল দিয়ে সহায়তা করেছে।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি’র নিবাহী ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দ্দ্দিন বলেন, বৈষম্য দূর করতে হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। কক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের সঞ্চয় থেকে স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র অর্থায়ন করলে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী সেই সুবিধা নিতে পারবে। দুরযোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, সড়কের পাশে অবৈধ স্থাপনার কারণে পানি প্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
ব্র্যাকের দুরযোগ ঝুঁকি হ্রাস ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. লিয়াকত আলী অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. নজরুল ইসলাম, অরথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ড. আহমেদ উল্লাহ এফসিএমএ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ঢাকা বিভাগ) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শরীফ হোসেন, সড়ক ও মহাসড়ক অধিদপ্তরের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জিকরুল হাসান, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এহতেশামুল রাসেল খান, ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির ঊর্ধ্বতন পরিচালক অরিঞ্জয় ধর প্রমুখ। এ ছাড়া বন্যা উপদ্রুত এলাকার জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ এবং স্থানীয় এনজিও প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক মৌটুসী কবীর, কেএএম মোরশেদ এবং ড. মো. আকরামুল ইসলাম। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা ড. মোঃ জাফর উদ্দীন।
ভারি বৃষ্টিপাত এবং পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা অঞ্চল থেকে আসা উজানের পানি প্রবাহের কারণে আগস্ট মাসে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল বন্যাকবলিত হয়। এই বন্যায় ১১টি জেলায় ৫৮ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে ৭৮ হাজার ৩৬২ জন গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী নারী, ৭২ হাজার ৪৬৭ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ২০ লাখ ৩৬ হাজার শিশু এবং ৪৭ হাজার বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন। মারা গেছেন ৭১ জন। এ ছাড়া বন্যায় ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৪২৫টি বাড়ি, ১৫ হাজার ৫১১ কিলোমিটার রাস্তা, ৩ লাখ ২১ হাজার ৮৮৮টি পানির উস, ৫ লাখ ২৮ হাজার ১৩৯টি ল্যাট্রিন এবং ২ হাজার ৮১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।