০৫:১৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৮০) চীন–ভারত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ায় উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা নীতি বিকৃত করার অভিযোগ বেইজিংয়ের ভারতের পানি সংকটের ছায়ায় পানীয় শিল্প: রাজস্থানে জল নিয়ে বাড়ছে ঝুঁকি ও অসন্তোষ প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩৪৭) আমির খসরুর আসন পরিবর্তন, তার আসনে মনোনয়ন পেলেন সাঈদ নোমান এনসিপি ছাড়লেন তাসনিম জারা থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ৭২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি চুক্তি সিলেটে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় নিষিদ্ধ বিড়িসহ যুবক গ্রেপ্তার একীভূত পাঁচ ব্যাংকের আমানত উত্তোলনে বিলম্ব, এ বছর অর্থ ছাড়ের সুযোগ নেই নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন: ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হিন্দু শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা, বাংলাদেশে সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৪৯)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:১১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৪
  • 87

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

সেই ছেঁচা হাত লইয়াই নানি মায়ের জন্য পিঠা তৈরি করিয়া আমাদের খাওয়াইলেন, মাকে খাওয়াইলেন, নানি কিছুই খাইলেন না। পরদিন হাতের ব্যাথায় নানির ঘোর জ্বর হইল। সেই জ্বরে তিন-চারদিন নানি কত কষ্ট পাইলেন কিন্তু সেজন্য একটুও আহা-উহু করিলেন না। আমরা কয়েকদিন পরে চলিয়া যাইব। আমাদিগকে যে নানি এটা-ওটা তৈরি করিয়া খাওয়াইতে পারিতেছেন না, ইহাই নানির সবচাইতে দুঃখ। মা কেবল নানির কাছটিতে বসিয়া থাকেন। নানি বলেন, “নারে রাঙাছুটু। তুই আর কয়দিনই বা আছিস। যা, পাড়ায় বেড়াইয়া আয়-ফেলিদের বাড়ি যা-গরীবুল্লা মাতবরের মেয়েকে দেখিয়া আয়।” মা কথা শুনেন না। নানির কাছটিতেই বসিয়া থাকেন। মা বোধহয় বুঝিতে পারিয়াছিলেন, এই অসুখ হইতে নানি আর সারিয়া উঠিবেন না। শেষ দিনে নানি আর কথা বলিতে পারিলেন না। কেবল চাহিয়া চাহিয়া মাকে দেখিতে লাগিলেন। আর দুটি চোখ হইতে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরিতে লাগিল। হয়তো বুঝিয়াছিলেন, নানি চলিয়া গেলে এই অভাগিনী মেয়েটিকে আদর করিবার আর কেহ থাকিবে না।

তখন বনের মাথায় রৌদ্র মাখাইয়া দিন-শেষের সূর্য অস্তপারের দিকে পা বাড়াইয়াছে। গাছের শাখায় পাখিগুলির গান নীরব হইয়া আসিতেছে। এমন সময় নানি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। ঝিনুকে করিয়া মা পানি লইয়া নানির মুখে দিতে গেলেন। পানি গড়াইয়া পড়িয়া গেল। চিৎকার করিয়া মা কাঁদিয়া উঠিলেন: “আমার এত আদরের মা আর ঘুম হইতে জাগিবে না। রাঙাছুটুর খবর লইতে আর এ-গাঁও হইতে ভিখারিণীদের কেহ গোবিন্দপুর পাঠাইবে না। আর কোনোদিন এ-গাঁও হইতে ঢ্যাপের মোয়া গোবিন্দপুর যাইবে না। মা। তুমি একবার চাহিয়া দেখ, তোমার যত্নের বুনানো সেই পুঁতির মালা এখনও আমি গলায় পরিয়া আছি। কেমন মানাইয়াছে আর একবার বলিয়া যাও।”

আমার মায়ের কান্দনে পাড়া-প্রতিবেশীরা মাকে বুঝাইতে আসিয়া নিজেরাই কাঁদিয়া বুক ভাসাইল। আজ ভাবিয়া বড়ই দুঃখ লাগে বিনা চিকিৎসায় আমার নানি মারা গেলেন। এখন সেপ্টিক হইলে কতরকমের ওষুধে তাহার নিরাময় করা যায়। তখনকার দিনে কি সামান্য অসুখে মানুষকে মৃত্যুবরণ করিতে হইত।

নানির ফাতেহা শেষ হইলে আমরা দেশে ফিরিলাম। আজ আর সোয়ারির সঙ্গে সঙ্গে মোকিমের বাড়ি পর্যন্ত নানি আসিলেন না। শুধু সেই তালগাছটা অবধি আসিয়া নানা চোখের পানি মুছিলেন।

নানি মরিয়া গেলে নানার একার সংসার চলে না। কে তাঁকে রাঁধিয়া দেয়? কে তার বারোমাসের বারো ফসলের তদ্বির-তালাশি করে? নানা নিজে হাল কৃষাণী করিতেন না। যা জমিজমা ছিল তাই বর্গা দিয়া যে ফসল পাইতেন একা আর কত খাইবেন? নানার সংসার বড়ই অগুছালো হইয়া পড়িল। পাড়া-পড়শির কথামতো একটি বিধবা মেয়েকে নানা নিকা করিয়া ঘরে আনিলেন।

প্রায় পাঁচ-ছয় মাস এই বিধবাটি নানার সংসার করিয়াছিল। তারপর নানার জমানো সমস্ত টাকা-পয়সা লইয়া একদিন গভীর রাত্রিকালে ঘরে আগুন দিয়া মেয়েটি পালাইয়া যায়। নানা একেবারে সর্বস্বান্ত হইলেন। এই খবর ভিখারিদের মারফত পাইয়া মা কত কাঁদিলেন।

 

চলবে…

জনপ্রিয় সংবাদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৮০)

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৪৯)

১১:০০:১১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৪

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

সেই ছেঁচা হাত লইয়াই নানি মায়ের জন্য পিঠা তৈরি করিয়া আমাদের খাওয়াইলেন, মাকে খাওয়াইলেন, নানি কিছুই খাইলেন না। পরদিন হাতের ব্যাথায় নানির ঘোর জ্বর হইল। সেই জ্বরে তিন-চারদিন নানি কত কষ্ট পাইলেন কিন্তু সেজন্য একটুও আহা-উহু করিলেন না। আমরা কয়েকদিন পরে চলিয়া যাইব। আমাদিগকে যে নানি এটা-ওটা তৈরি করিয়া খাওয়াইতে পারিতেছেন না, ইহাই নানির সবচাইতে দুঃখ। মা কেবল নানির কাছটিতে বসিয়া থাকেন। নানি বলেন, “নারে রাঙাছুটু। তুই আর কয়দিনই বা আছিস। যা, পাড়ায় বেড়াইয়া আয়-ফেলিদের বাড়ি যা-গরীবুল্লা মাতবরের মেয়েকে দেখিয়া আয়।” মা কথা শুনেন না। নানির কাছটিতেই বসিয়া থাকেন। মা বোধহয় বুঝিতে পারিয়াছিলেন, এই অসুখ হইতে নানি আর সারিয়া উঠিবেন না। শেষ দিনে নানি আর কথা বলিতে পারিলেন না। কেবল চাহিয়া চাহিয়া মাকে দেখিতে লাগিলেন। আর দুটি চোখ হইতে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরিতে লাগিল। হয়তো বুঝিয়াছিলেন, নানি চলিয়া গেলে এই অভাগিনী মেয়েটিকে আদর করিবার আর কেহ থাকিবে না।

তখন বনের মাথায় রৌদ্র মাখাইয়া দিন-শেষের সূর্য অস্তপারের দিকে পা বাড়াইয়াছে। গাছের শাখায় পাখিগুলির গান নীরব হইয়া আসিতেছে। এমন সময় নানি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। ঝিনুকে করিয়া মা পানি লইয়া নানির মুখে দিতে গেলেন। পানি গড়াইয়া পড়িয়া গেল। চিৎকার করিয়া মা কাঁদিয়া উঠিলেন: “আমার এত আদরের মা আর ঘুম হইতে জাগিবে না। রাঙাছুটুর খবর লইতে আর এ-গাঁও হইতে ভিখারিণীদের কেহ গোবিন্দপুর পাঠাইবে না। আর কোনোদিন এ-গাঁও হইতে ঢ্যাপের মোয়া গোবিন্দপুর যাইবে না। মা। তুমি একবার চাহিয়া দেখ, তোমার যত্নের বুনানো সেই পুঁতির মালা এখনও আমি গলায় পরিয়া আছি। কেমন মানাইয়াছে আর একবার বলিয়া যাও।”

আমার মায়ের কান্দনে পাড়া-প্রতিবেশীরা মাকে বুঝাইতে আসিয়া নিজেরাই কাঁদিয়া বুক ভাসাইল। আজ ভাবিয়া বড়ই দুঃখ লাগে বিনা চিকিৎসায় আমার নানি মারা গেলেন। এখন সেপ্টিক হইলে কতরকমের ওষুধে তাহার নিরাময় করা যায়। তখনকার দিনে কি সামান্য অসুখে মানুষকে মৃত্যুবরণ করিতে হইত।

নানির ফাতেহা শেষ হইলে আমরা দেশে ফিরিলাম। আজ আর সোয়ারির সঙ্গে সঙ্গে মোকিমের বাড়ি পর্যন্ত নানি আসিলেন না। শুধু সেই তালগাছটা অবধি আসিয়া নানা চোখের পানি মুছিলেন।

নানি মরিয়া গেলে নানার একার সংসার চলে না। কে তাঁকে রাঁধিয়া দেয়? কে তার বারোমাসের বারো ফসলের তদ্বির-তালাশি করে? নানা নিজে হাল কৃষাণী করিতেন না। যা জমিজমা ছিল তাই বর্গা দিয়া যে ফসল পাইতেন একা আর কত খাইবেন? নানার সংসার বড়ই অগুছালো হইয়া পড়িল। পাড়া-পড়শির কথামতো একটি বিধবা মেয়েকে নানা নিকা করিয়া ঘরে আনিলেন।

প্রায় পাঁচ-ছয় মাস এই বিধবাটি নানার সংসার করিয়াছিল। তারপর নানার জমানো সমস্ত টাকা-পয়সা লইয়া একদিন গভীর রাত্রিকালে ঘরে আগুন দিয়া মেয়েটি পালাইয়া যায়। নানা একেবারে সর্বস্বান্ত হইলেন। এই খবর ভিখারিদের মারফত পাইয়া মা কত কাঁদিলেন।

 

চলবে…