স্বদেশ রায়
ভারতের শক্তিশালী নেতা শুধু নয় এখনও অবধি ভারতের নানান প্রান্তের অতি সাধারণ মানুষ সে দেশের যে তিনজন নেতাকে চেনেন তাদের একজন ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে দেখেছি,সেখানে মানুষ তাদের দেশের বর্তমান নেতার নাম জানে না। এমনকি জওয়াহেরলাল নেহরু’র নামও জানে না। মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বোস ও ইন্দিরা গান্ধী এই তিন জন নেতার নাম শুধু তারা জানে। ইন্দিরা গান্ধী’র নাম জানার একটাই কারণ, তার নেতৃত্বে তাদের দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতেছিলো।
ভারতের এই ভারতরত্ন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক পর্যায়ে সে দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করে জরুরী আইন জারী করে নিজেকে স্বৈরাচারি শাসককে পরিণত করেছিলেন। যার বিপরীতে ভারতে প্রবল গণ বিস্ফোরণ হয়। সে ইতিহাস সকলের জানা। ইন্দিরা গান্ধী দ্রুত নির্বাচন দেন ও পরাজিতও হন। তাঁর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার পরে প্রথম অকংগ্রেসী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই অকংগ্রেসী সরকার প্রধানও আড়াই বছর মত সময়ে দুই বার পরিবর্তিত হয়। তাদের নির্ধারিত সময় পাঁচ বছর তারা পূর্ণ করতে পারেনি।
অথচ ওই সরকার প্রধান হিসেবে কংগ্রেসের বয়োবৃদ্ধ অশতিপর নেতা মোরারজি দেশাইকেই তারা নির্বাচিত করেছিলো। তিনি শুধু অশতিপর নেতা ছিলেন না তিনি অনেক ভালো আইনজীবি ও অভিজ্ঞ রাজনীতিকও ছিলেন।
তারপরেও তিনি তার শাসনামলে ভারতের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কোন পরিবর্তন আনতে পারেননি। অথচ জওয়াহেরলাল নেহরু’র শেষ সময় থেকেই বার বার দেশাই প্রধানমন্ত্রীর পদে যাবার জন্য যার পর নাই চেষ্টা করে চলতেন। দলের ভেতর ও দলের বাইরের লোকদেরও সহায়তা সব সময়ই তিনি চেয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে লেখা কিছু বইয়ে বলে, ওই সময়ে ভারতের শত্রু দেশ পাকিস্তান ও একটি বড় দেশের গোয়েন্দা সংস্থাও তাকে ওই পদে নেবার জন্য যথেষ্ট সহায়তা করে। অনেক অর্থ সহায়তাও করে। অবশ্য এগুলোর যে খুব জোরালে ডকুমেন্ট আছে তা নয়। তবে তিনি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পুরস্কার “ নিশানই পাকিস্তান” পান। যাহোক এসব বিষয় বাদ দিয়েও ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের দিকে যদি তাকানো হয় বা ছোট খাট একটা হিসাব যদি করা হয় তাহলে মোরারজি দেশাই তার নিজের প্রধানমন্ত্রীত্ব হবার স্বাদ পূরণ ও “ নিশানই পাকিস্তান” পদক ছাড়া ওই ভাবে ইতিহাসের পাতায় তার কোন অর্জন রেখে যেতে পারেননি। অথচ ওই সময়ে একটা জরুরী আইনের ভারত বা ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরাচারি ভারতের শাসনকাল পার হয়ে এসে ভারতের দরিদ্র জনগোষ্টির জন্য তাঁর অনেক কিছু করার ছিলো। কিন্তু তিনি তা করতে পারেননি। কেন পারেননি সে আলোচনায় পরে আসছি।
তার আগে ভারতীয় কংগ্রেস সরকারের প্রধান হিসেবে নেহরু পরিবারের বাইরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও এর আমলটাতে একটু চোখ রাখা যেতে পারে। নরসিমা রাও একজন সিজনড পলিটিশিয়ান ও লেখক। তার উপন্যাস, সমাজ, অর্থনীতিও রাজনৈতিক বিষয়ক বইগুলোর যতটুকু পড়েছি- তাতে অনেক সময় নিজের মতামতকে আমার জ্ঞানী বন্ধুবান্ধবদের বিপরীতে নিয়ে গিয়েছি। যদিও ক্ষুদ্র জ্ঞানে জওয়াহেরলাল নেহরুকে বিচার করা সম্ভব নয়। তারাপরেও মৌলিক লেখার দিক থেকে জওয়াহেরলাল নেহরু থেকে নরসীমা রাও এর লেখাগুলো বেশি মৌলিক বলে মনে হয়। তাছাড়া কেন যেন মনে হয়,জওয়াহেরলাল নেহরু ভারতবর্ষের সমাজ ও অর্থনীতির পরিবর্তন দেখেছেন ওয়েস্টার্ন চোখ দিয়ে। অন্যদিকে রাও দেখেছেন ভারতবর্ষের হাজার বছরের সংস্কৃতি, সভ্যতা ও মাটির চোখ দিয়ে। যাহোক, রাও কখনও দেশাই এর মতো প্রধানমন্ত্রী’র দৌঁড়ে ছিলেন না। তিনি তাঁর রাজনৈতিক, সামাজিক ও লেখক অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্টু ছিলেন। তাকে প্রধানমন্ত্রী হতে হয়েছিলো নেহরু পরিবারের উত্তরাধিকার প্রধানমন্ত্রী পদের নিশ্চিত প্রার্থী রাজীব গান্ধী নির্বাচন প্রচারকালে সুইসাইডাল বোমায় নিহত হবার ফলে।
নরসীমা রাও ছোট মেজরটি নিয়ে ক্ষমতা গ্রহন করার পরে তিনি কাজের প্রায়োরিটি হিসেবে গ্রহন করেন দরিদ্র ভারতকে একটি প্রকৃত অর্থনীতির ওপর দাঁড় করানো। তিনি তাঁর বন্ধু মনমোহন সিংহকে অর্থমন্ত্রী হতে রাজি করান এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনিই ভারতে প্রথম ওপেন অর্থনীতি বা বাজার অর্থনীতি গ্রহন করেন। ভারতের অর্থনীতি তার আগ অবধি যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও ক্যাপিটালইজমের একটা অবাস্তব ককটেল ছিলো- সেখান থেকে তিনিই প্রথম ভারতের অর্থনীতিকে প্রকৃত রেল লাইনে তোলেন। আজ যে ভারত তিন ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দিকে এগিয়ে চলেছে- ভবিষ্যতে ভারতীয় অর্থনীতির ইতিহাস বলবে, এর গোড়াপত্তনটি নরসীমা রাও এর হাত ধরেই হয়েছিলো। নরসীমা রাও মাত্র পাঁচ বছরই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দ্বিতীয়বার থাকার জন্যে তিনি কোন রাজনৈতিক কূট কৌশলের পথ নেননি। যার ফলে তাঁর শাসন শেষে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিরোধীরা অর্থাৎ অকংগ্রেসী সরকার ক্ষমতায় আসে। আর নরসীমা রাওকে নিয়ে সে দেশে খুব কোন মাতামাতিও নেই। অনেকটা আন সাং হিরো তিনি। শুধু মাত্র ভারতের সঠিক ইতিহাসের পাতায় থাকবে তাঁর অবদান যে- তিনি ভারতের অর্থনীতিকে সঠিক পথে নিয়ে এসেছিলেন; বা ভারতকে বড় অর্থনীতির ক্লাবে যাবার তিনিই রূপকার। কেন এই পার্থক্য হলো- দেশাই ও রাও এর মধ্যে। এ নিয়ে অনেক বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ আছে পন্ডিতদের। তবে আমাদের মত সাধারণ সাংবাদিকদের চোখে যা পড়ে তা হলো এই দুই সরকারের কাজের প্রায়োরিটি নির্ধারণে পার্থক্য।
ক্ষমতা গ্রহনের পরে মোরারজী দেশাই তাঁর কাজের প্রায়োরিটি হিসেবে গ্রহন করেন, ইন্দিরা গান্ধীকে বিচারের আওতায় আনা এবং সরকার ও আইন বিভাগকে ব্যবহার করে ইন্দিরা গান্ধীর দলকে কতটা নির্মূল করা যায়। আর সেটা এমন পর্যায়ে ছিলো যে, ঠিক তারিখ মনে নেই- তবে একদিন অল ইন্ডিয়া রেডিও’র খবরের প্রথম শিরোনাম ছিলো, “ প্রধানমন্ত্রী মোরারাজি দেশাই বলেছেন, আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে আরো বাইশটি মামলা দায়ের করা হবে” ।
অন্যদিকে নরসীমা রাও তার দলীয় প্রধান রাজীব গান্ধী হত্যাকান্ড’র বিচার দেশের স্বাভাবিক আইনের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কোনক্রমেই সেটাকে তিনি তার রাজনৈতকি এজেন্ডায় বা সরকার পরিচালনার এজেন্ডায় রাখেননি। এছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান ঠেকাতে তিনি সরকারী প্রসাশনে বা সরকারের কোন এজেন্ডায় আনেননি। সরকারের মূল এজেন্ডা হিসেবে তিনি রেখেছিলেন অর্থনীতিতে প্রকৃত ট্রেন লাইনে তোলার কাজ- যা আগেই উল্লেখ করেছি।
মোরাজজি দেশাই দুই বছরও ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। তারপরে ভারতের ক্ষমতায় আবার ফিরে আসেন ইন্দিরা গান্ধী। অন্যদিকে নরসীমা রাও স্বাভাবিক নিয়মে তার সাংবাবিধানিক সময় পার করেন। পরবর্তীতে বিরোধীরা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে। তবে তারা নরসীমা রাও এর অর্থনৈতিক নীতি থেকে এক চূলও সরেনি। এবং তারপরে আবার কংগ্রেস ও অকংগ্রেসী যত সরকার এসেছে সকলেই রাও এর অর্থনৈতিক নীতি’র পথেই চলে দরিদ্র ভারতকে ধীরে ধীরে বড় অর্থনীতির ক্লাবে নিয়ে যাচ্ছে।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.