মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য
সেই বয়সে জামার মধ্যে সবচাইতে যে বড় আকর্ষণের বস্তু পকেট, যাহার মধ্যে কুল, কাঁচা পেয়ারা, আমের কুশি প্রভৃতি বালক-বয়সের কত মহার্ঘ সম্পত্তিগুলি রক্ষিত করা যাইত, সেই পকেট খলিফাপট্টির তৈরি জামাগুলিতে থাকিত না।
যদিবা কোনো কোনো জামায় থাকিত, তাহা এত ছোট যে দুই চারিটি পাকা কুল ভরিতেই পূর্ণ হইয়া যাইত। কিন্তু আমাদের জামা-কাপড় বাজান বরাবরই খলিফাপট্টি হইতে কিনিতেন। সেখানে যাইয়া বাজান আমাকে ইচ্ছামতো রঙের জামা নির্বাচন করিতে দিতেন। কিন্তু কিছুতেই আমি মনমতো রঙের জামা ঠিক করিতে পারিতাম না। এ রং যদি পছন্দ হয় অপর রং আমাকে আকর্ষণ করে। খলিফাপট্রির সবগুলি দোকান ঘুরিয়া ঘুরিয়া জামার ছিট পছন্দ করি কিন্তু আমার অবস্থা হয় যেন বাঁশবনে যাইয়া ডোম কানা। লাল, নীল, হলুদ কত রঙের জামা খলিফারা বান্ডিল খুলিয়া দেখায়। শুধু কি রং?
এক এক রঙের উপর আবার নানারকমের ছিট। তাহার ভিতরে মনের মতনটি খুঁজিয়া পাওয়া কি সহজ? আমার এই রং নির্বাচনে দেরি দেখিয়া বাজান বিরক্ত হইতেন না। তিনি নিজের পছন্দমতো কোনো রং নির্বাচন করিয়াও আমার ঘাড়ে চাপাইয়া দিতেন না, যাহা আমি আমার ছেলেদের বেলায় প্রায়ই করিয়া থাকি। স্কুলে যাইবার আগে জামা নির্বাচন করিতে পারিলাম না বলিয়া স্কুলের ছুটির পরে আবার তিনি আমাকে সঙ্গে করিয়া খলিফাপট্টিতে যাইতেন। তখন আবার ঘুরিয়া ঘুরিয়া জামার ছিট ও রং পছন্দ করিতাম।
কোনোটি পছন্দ হইলে তাহা গায়ে দিয়া এদিক-ওদিক চাহিতাম। মনের ভাব এই-সকলে দেখুন, নতুন জামা গায়ে দিয়া আমাকে কেমন দেখাইতেছে। বাজান তাঁর পকেট হইতে সিকি আধুলিগুলি বাহির করিয়া দুই তিনবার গনিয়া গনিয়া খলিফার হাতে জামার দাম তুলিয়া দিতেন, তখন নতুন জামা পরার সমস্ত আনন্দ আমার মন হইতে উবিয়া যাইত। বাজানকে বলিতাম, “এ জামাটার দাম যখন বেশি, ওই অল্পদামের জামাটাই নাহয় লই।” বাজান বলিতেন, “নারে, ওটা যখন তোর পছন্দ হইয়াছে ওটাই তুই পর।”
নতুন জামা পরিয়া পুরাতন ছেঁড়া জামাটা বগলে করিয়া নাচিতে নাচিতে বাড়ি ফিরিতাম। সামান্য কিছু খাইয়াই পাড়ায় বাহির হইতাম সকলকে নতুন জামা দেখাইতে। পাড়ার কেহ কেহ আমার জামার কাপড় ধরিয়া পরীক্ষা করিত, তার দাম জিজ্ঞাসা করিত, তখন আমার বড়ই আনন্দ হইত। নতুন কাপড়ের সোঁদা সোঁদা গন্ধটি আমার বড় ভালো লাগিত। রাত্রে শুইবার সময় জামাটি বুকের মধ্যে লইয়া সেই গন্ধ শুঁকিতে শুঁকিতে ঘুমাইয়া পড়িতাম। আজও নতুন জামা পরিতে আমার বেশ ভালো লাগে। নতুন কাপড়ের গন্ধটি আমাকে সেই বালককালে লইয়া যায়।
চলবে…
Sarakhon Report 



















