০৭:৪১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

রুক্সি – মণীশ রায়

  • Sarakhon Report
  • ০৭:০০:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪
  • 18
মণীশ রায়
পোশাকি নাম মোসাম্মৎ রোখসানা বেগম। বন্ধুমহলে শুধুই রুক্সি। আর্ট কলেজের একদা দুর্দান্ত স্মার্ট এক ছাত্রী। কেবল বন্ধু-বান্ধবই নয়, পরপর কবছরের জুনিয়র ছাত্র-ছাত্রী পর্যন্ত, এরকম বেপরোয়া আবেদনময়ীকে পারলে চ্যুইংগাম মনে করে জাবর কাটে প্রতিদিন, এমনি মনমোহিনী ছিলেন তিনি। কলেজ চত্ত্বরে তাঁর এই উপস্থিতি ছিল চকমকি পাথরের মতো। একই সঙ্গে উজ্জ্বল ও ক্ষুরধার, তাঁকে কি ভোলা যায়?
এখনকার বয়স? পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই। সামনাসামনি হলে বড়জোর চল্লিশ। অতি যত্ন ও সতর্কতা বজায় রাখায় ত্বক এখনও সর্ষে ফুলের মতো উজ্জ্বল ও মাখনের মতো পেলব। দৃষ্টিতে কৌতূহল আর হাসিতে চড়ুইর মতো চঞ্চল এক মাদকতা। সব মিলেমিশে যৌবনের অস্ফুট ছটা এখনও শরীর ছাড়েনি। যেন কাউকে সামনে পেলে এক্ষুণি মৌমাছির মতো ঢলে পড়বেন।
রুক্সি থাকেন কানাডার টরেন্টো শহরে। হুয়াইট-কলার চাকরি তাঁর। একই সঙ্গে মৌজ-মাস্তিতে ভরা বেহিসাবী স্বাধীন জীবন-যাপনে অভ্যন্ত। কথা ও চলাফেলায় রাখ-ঢাক নেই। তাই এদেশীয় দমবন্ধ আলখেল্লায় ঢাকা প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে নেই তেমন কোন যোগাযোগ।
রুক্সির বন্ধু-বান্ধব একেবারে হাতে গোনা কজন। সেই যে আর্ট কলেজে থাকতে যে-জন কাছাকাছি ছিলেন, এখনও তেমনই রয়েছে। সময়ের সঙ্গে পরিচিতির ব্যাপকতা বাড়লেও কেবল বাড়েনি বুকের সঙ্গে আগলে রাখার, যা খুশি বলা ও ভাবার মতো বন্ধু-সংখ্যা।
রুক্সির এরকম বিরল বন্ধুদের একজন হলেন বিশিষ্ট চারুশিল্পী অধ্যাপক আলমগীর হোসেন। এখনও নিজের ভেতরে কোন মানসিক উচাটন বা চাপ দেখা দিলে তিনি পুরনো বান্ধবী রুক্সিকে টরেন্টোয় রিং দেন; ভরাট গলায় বলে ওঠেন,’ দোস্ত, হাছা কইতাছি, মিছা কতা না। এখন অব্দি তোর মতন এমন একখান মাইয়া চোখে পড়ে নাইক্কা। কলেজ ক্যাম্পাসে যৌবনের ত্রাস ছড়ানো একটা পাগলি বেড়াল ছিলি তুই। হাছা কইরা কইতাছি রুক্সি, তোয়াজ না।’
‘শালা ফোর টুয়েন্টি। এক নম্বর না, তুই হলি আমার দুই নম্বরি স্তাবক! আসল জায়গায় দিমু একটা। যা ফোট্।’ বলে খিলখিল করে হাসিতে ভেঙে পড়েন রুক্সি। এ বয়সেও এসব কথা শুনতে ওর বেশ লাগে। ভেতরটা ফুরফুরে হয়ে যায় আনন্দে ও গর্বে। নিমেষে নেশার মতো এক ঘোর ছড়িয়ে যায় শরীরে ও মনে।
আলমগীর উত্তর দেন, হাছা কতার ভাত নাই দেখতাছি। বিশ্বাস করলি না তো? সত্যি বলছি। আর্ট কলেজের অধ্যাপক হয়েই বলছি, তোর মতন বেদেনি কিসিমের একটা মেয়েই দেখি না আজকাল। সব যেন মাশরুম বনে গেছে। চোখে পড়লেই কেমন একটা স্যাঁতস্যাঁতে অনুভূতি হয় মনে। তোর মতন বুনো গন্ধটা আর পাইনা। কান পাকড়াইয়া কইতাছি, হাছা বাত। একটা বাতও মিছা না।’
‘তুই তো তখন আড্ডার ছলে আমার বুকের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতি। ভুলে গেলি? ঠিক কিনা, ক?’ গলায় ইয়ার্কী।
‘সোহরাওয়ার্দি পার্কের আড্ডার কথা মনে আছে তোর?’ কথা ঘুরাতে চান আলমগীর। মুখ লুকাবার ছাতা খুঁজে পান না হাতের কাছে। ধরা পড়ায় লজ্জা পান তলে তলে, এখনও!
কঠোর নিয়মে বাঁধা অধ্যাপকের চোখে ভাসে সেই সময়। লুকিয়ে চুরিয়ে বান্ধবীর বুকের দিকে তাকিয়ে থাকার ব্যাপারটা মিথ্যে নয়। এসব কি বলার কথা, বিশেষ করে পড়ন্ত বয়সে এসে? নিজেকে অসভ্য লাগে। ভেতরে একটা চোর-চোর ফিলিং হয়। বিশ্রী সে অনুভূতি। সুযোগ পেলে রুক্সি প্রায়ই একথা বলে ওকে জব্দ করতে চান। তিনি তখন আর কথা বলতে পারেস না। আড়ষ্টতা চেপে বসে।
‘থাকবে না? ওই পার্কেই তো তুই আর সাব্বির মিলে আমারে দিয়া গাঁজাভরা সিগারেটে টান দেয়ালি আর আমারে নেশায় মজিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দুজন মিলে আমার বুক দেখতি। শালা বানচোত পুরুষবন্ধু আমার। সবগুলো এক।’
‘যাঃ। এসব তোর মনগড়া কথা। পুরুষগুলোকে বেকায়দায় ফেলার ফন্দি। পারিসও তুই।’ নিজের কাছে নিজেকে কেমন যেন বেআক্কেল লাগে। লুকনোর মরিয়া চেষ্টা বান্ধবীর কাছে।
‘মনগড়া? হোস্টেলে গিয়ে কবার গণ-বাথরুমে ঢুকতি তাও সাব্বির বলে দিতো আমায়।’ বলে ফের খিলখিল করে হেসে ওঠেন রুক্সি। আলমগীরের মতো গুণী-জ্ঞানী সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন এক অধ্যাপককে এমন বিটলা রকমের বেকায়দায় ফেলতে পেওে রুক্সির আনন্দ যেন আর ধরে না।
‘তুই কি এগুলো ভেবে মজা পাস আজকাল? এগুলোও পারভারশন। বুঝিস?’ বলতে চাননি; তবু নিজেকে বাঁচাবার অন্তিম এক চেষ্টা অধ্যাপকের।
‘চিরকালই যৌনতা আমার পছন্দের বিষয়। স্বামীর প্রাচুর্য, সন্তানের অর্জন, স্ত্রীর সৌন্দর্য নিয়ে খুল্লামখুল্লা কথা বলতে পারলে কেন যৌনতা নয়? সবাই সেদিকে ছুটছি অথচ কেউ কিছু বলি না আমাদের সমাজে। সিক্রেট লাইফ বলে দাদ-বিখাউজের মতন লুকিয়ে রাখি জামার তলায়। আশ্চর্য!’
‘আগে তো এসব বলিস নি কখনও?’
‘বললে কী করতি? তোর আর সাব্বিরের মতন ভীতুর ডিম দিয়ে কিছু কি হতো সেসময় বল? ‘কী হবে’, ‘কে, কি ভাববে’ চিন্তা করতে করতেই তো তোদের যৌবন শেষ, যৌনতার কবরখানা সেখানে। শোন, এখন বয়স হয়েছে না? সব যৌন হতাশা কেবল ঠোঁটে জমা হচ্ছে। ঠোঁটই এখন একমাত্র যৌনযন্ত্র, বুঝলি?’ বলেই ফের হাসির ফোয়ারা।
আলমগীরের রুচিবোধ বারবার করে হোঁচট খাচ্ছে এসব কথায়। বডি-শেমিং এর মতো রীতিমতো অসভ্যতা বলে মনে হচ্ছে এগুলো। কারো শারীরিক গঠন কিংবা মানসিক দুর্বলতা নিয়ে কথা বলা কি ঠিক?
রুক্সির যে মাঝে মাঝে কি হয়? জিন-পরি পাওয়া মানুষের মতো লাগে কখনও, একদম পাল্টে যান তখন। মুখে কোন লাগামই থাকে না। সরকারি কলের অবিরল ধারার মতো যা খুশি তা শুধু বলেই যাচ্ছেন। আবার অন্যসময় ‘তাড়াতাড়ি বল্’ বলে একই মহিলার গুরুগম্ভীর বিপরীত আচরণ, দুচারটা কথা ছাড়া আর কিছুই যেন বলার নেই, অদ্ভুত মানুষ তখন তিনি!
তা সত্ত্বেও রুক্সির সঙ্গেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে, আড্ডা দিতে আঁইচাই করে আলমগীরের মন। বিস্মৃতপ্রায় প্রিয় গানের কলি হঠাৎ রাস্তার মোড়ে কানে ভেসে এলে যেমন সুখ হয়, তেমনিভাবে রুক্সি জাগিয়ে দেয় ওকে। এ বয়সে প্রাণ খুলে হাসা ও কথা বলা যে কী মধুর একান্ত অভিজ্ঞতা তা কেবল তিনিই বুঝতে পারেন।
এসব ফোনকল বেশিরভাগ রাতের বেলাতেই হয়। তখন কুসুমী ওর পাশে মড়াকাঠের মতন শুয়ে থাকে। দুজনই ওরা আদি ঢাকাইয়া। রুস্তম সর্দারের নাতনি ওর স্ত্রী কুসুমী। আলমগীর ওদের পুরনো ঢাকার পাতলা লেনের বাড়িতে জায়গীর থেকে আর্ট কলেজে পড়ালেখা
সেরে সেখানকার অধ্যাপক হয়েছেন।
ওদের কোন সন্তান নেই। তবে অনেকগুলো পোষ্য কুকুর-বিড়াল রয়েছে ছাদের উপর। ওদের দেখভাল করেই সময় কাটে একরোখ মেজাজী কুসুমীর।
মাঝে মাঝে কুসুমী ওকে বলে, ‘রাইতের বেলায় সব থুইয়া কার লগে কথা কও অত? কানাডার ওই চাইর বিয়াওলি মাগিটা না?’
‘দিন-দিন রুক্সিটা কেমন য্যান বদলাইয়া যাইতাছে। বুঝবার পারতাছি না।’ এমন এক ভাব ওর কথার সুরে ভেসে বেড়ায় যে মনে হবে রুক্সিকে তিনি বুঝি দুদিন হল চেনেন। নিজেকে নিরপেক্ষ-নির্দোষ এক মনোবিজ্ঞিানীর মতো পেশ করেন স্ত্রীর কাছে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল হিসাবে এই অভিনয়টুকু তিনি ভালোই রপ্ত করে নিয়েছেন দাম্পত্যে। খুশিতে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ান মাঝে মাঝে।
‘বারো ভাতারি মাগিগো শেষ বয়সে এই রকমই অয়। নিজের চক্ষে ঘুম আহে না, মাগি অহন তুমার লগে কথা কইয়া তুমার ঘুমটা বরবাদ করবার চায়। আহ ফোন ছাইড়া?’ তাড়া দেয় স্বামীর চেয়ে দশ বছরের ছোট এসএসসি ফেল কুসুমী। চোখে অনন্ত ঘুমের আবেশ।
আলমগীর মোবাইল ফোনটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বিছানায় এসে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন। চেহারা জুড়ে তেতো ওষুধ সেবনের অভিনয় ছড়িয়ে রাখলেও মনে মনে তিনি হা-হা করে হাসছেন। এসময় পুরনো দিনের কথা খুব মনে পড়ে। কীরকম মুখর ছিল সেসব আড্ডা। যত মনে পড়ে তত আনন্দের ফাগ ছড়িয়ে পড়ে অন্তরে। কখনও হাসি পায়, কখনও লজ্জায় কুণ্ঠিত হয়ে পড়েন। অথচ এসবের কোন মূল্যই নেই কুসুমীর কাছে। সে তার বাপদাদার গর্বে আটখানা। কিছু হলেই ‘আমার বাপে কইতো’ বলে শুরু করে দেবে এক বিশাল কাহিনি। এর না আছে ভাব, না আছে ভালোবাসা। তবু সে বলে ছাড়বেই। বিরক্তিকর সব। ইচ্ছে হয় সব ছেড়েছুড়ে নতুন করে জীবন রচনা করতে। কিন্তু তা বোধ করি এ জীবনে আর সম্ভব হবে না। ঝুরিবটের মতো সবকিছু সেঁধিয়ে গেছে অভ্যেসের গভীরে।
ওপাশে রুক্সির একই দশা। নিজেকে উজাড় করে কথা বলার আরামটাই আলাদা। প্রিয় যোগ-ব্যায়ামের মতো এ বয়সে বড় স্বস্তি মিলে তাতে। এজন্য ফেলে আসা কৈশোর-যৌবনের স্মৃতিগুলো ভুলভুলাইয়া রহস্য হয়ে ধরা দেয় ওর কাছে। সেগুলো নিজের পোড় খাওয়া দৃষ্টির আতশকাচের নিচে রেখে পরখ করার আলাদা একটা মজা রয়েছে। অতল বিনোদনের খনি হয়ে ওঠে স্মৃতিগুলো।
বিছানায় মুনিম নামের ওর চারনম্বর পুরুষটা বেদম নাক ডাকছে। এককালে অশ্বডিম্ব প্রসবকারী প্রকৌশালীর চাকরি করতো এক কোম্পানিতে। এখন সব ছেড়েছুড়ে বউর রোজগারে ভাগ বসাচ্ছে। রাত করে পানাহার সেরে দেরিতে শুতে যাওয়ার অভ্যেস লোকটার। সাদা বাঁদরের মতো চেহারাসুরত, কেবল লাফায়। এটা করবো, ওটা দেবো আসলে জীবনে কিছুই করতে পারেনি এই অপদার্থ প্রকৌশলীটি। রুক্সি ওকে বিয়ের আগে ভেবেছিলো, ওর সঙ্গে বিয়েটা হলে নিরাপত্তা জুটবে সারাজীবন। আগের বিদেশী স্বামীর মতো রাস্তার কিনারে পাভের সামনে ওকে ফেলে রেখে পালাবে না। তার উপর নিজের দেশের মানুষ, বুয়েটের এককালের মেধাবী ছাত্র। কিন্তু বছর পাঁচেক পর টের পেলেন, এ একটা বোকাচোদা, এর সঙ্গে শোয়া পর্যন্ত যায় না এক বিছানায়। কটু একধরনের গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসে ওর। চরম বিরক্তিকর, দিনদিন টরেন্টোর শীতের মতন এর তীব্রতা কেবল বাড়ছে। চার নম্বর এই স্বামী-রত্নটিকে, রুক্সি ভাবছেন , সামনের বছরই টা-টা বাই-বাই করে দেবেন। কতো আর চিল্লাবেন? এ বয়সে কি কেউ কারো অভ্যেসে বদল আনতে পারে?
এ পর্যন্ত চার স্বামীর সঙ্গে রুক্সির সংসার হয়েছে। শুরুতে প্রতিবার প্রচণ্ড এক মানসিক উত্তেজনা। কিছুদিন আবেগের জলকেলি; তারপর যেই-সেই। সেই পুরনো বৈচিত্রহীন একঘেয়েমি ওকে পেয়ে বসে। অবসাদ কোন এক অশুভ প্রেতাত্মার মতো ঢুকে পড়ে ভেতরে। ধীরে ধীরে বিষে পরিণত হয় সম্পর্ক। তখন ‘শুয়োরের বাচ্চা চলে গেলে বাঁচি’ ধরনের অথর্ব এক মানসিকতা ওকে গ্রাস করে নেয়। তখন যে- কদিন সম্পর্কটি টিকে থাকে তা কেবলই সহ্যশক্তির জোরে, অন্যকিছু নয়। দশবছরের ছোট মুনিমের অবস্থান এখন সেই পর্যয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। মৃত সম্পর্ক বড় সাংঘাতিক, বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেই রুক্সিকে গিলে খাবে। অবসাদ-অতৃপ্তি আর মৃত্যুচিন্তা ওকে যে কোথায় নিয়ে যাবে, ভাবলেই শরীর শিউরে ওঠে বারবার।
ঠিক তখনই বাড়ির কথা বড় মনে পড়ে যায়। হাত-পা ছড়িয়ে নারকেল-সুপারির চেনা হাওয়া-রোদ্দুরে ভেসে বেড়াতে মন চায়। প্রবাসে বাস করে-করে ভেতরে ফাঙ্গাস জমে গেলেই এসব মনে হয়। প্রায়ই বৃক্ষের নিবিড় ছায়া আর নদীতটের মায়া ফুপিয়ে ওঠে ওর ভেতর। কিন্তু কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়ালেও ক্লান্তি চলে আসে একসময়। মনে হয়, নিবিড় প্রকৃতির ধারে তো একজন সুখময় পুরুষের সাক্ষাৎ মিলবার কথা। তিনি কই? তিনি তো ওর অপহৃত সময়, ভুলভালাইয়া রহস্যের হাতছানি, একেই তো নিরন্তর খুঁজে চলেছেন তিনি। হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েও যেন কোথায় পালিয়ে যেতে চান। কিভাবে ধরা দেবেন ওর সুখময়? এ ভাবনা থেকেই একসময় হতাশা ভর করে। ‘কিছু ভালো লাগে না’-র মতো কদিন ভেতরে কামড়াকামড়ি চলার পর নিজের দেশের টিকিট কাটতে নিসপিস করে স্বদেশ-অনুরাগী রুক্সির মন!
সেখানে ফিরেও দেখেছেন রুক্সি। প্রথম প্রথম কানাডা থেকে প্লেনে চেপে বসলেই মনে হতো, ওর যত বন্ধু-পরিজন সবাই বুঝি ওর ফিরবার কথা শুনে ওকে ঘিরে সাঁওতালদের মতো যূথবদ্ধ হয়ে নাচতে শুরু করবে আনন্দে। এতো টান, এতো ভালোবাসা কোথায় রাখবে সে? বহিঃপ্রকাশ তো ঘটবেই। কিন্তু বাস্তবে ঢাকার যানজট, নোংরা আর মানুষের বদ্ধ মানসিকতায় ওর শ্বাসকষ্ট কেবল বাড়তেই শুরু করে। সুখের নামগন্ধ নেই। ডাক্তারের কাছ থেকে চেয়ে মুঠোভরতি বড়ি গিলে খেয়েও জান বাঁচে না। শেষ আশ্রয় ওর পিতা। তিনিও মুখের উপর বলে দেন তুই কোনদিনও আমাদের ছিলি না। এখন কেনো?’
‘আমি থাকতে চাই আপনাদের সঙ্গে।’ কণ্ঠের বলিষ্ঠতা দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান রুক্সি। কিন্তু সবই বৃথা। কেননা আব্বাহুজুর ধারাপাতের নামতা আগেই মুখস্থ করে রেখেছেন। সামনে দাঁড়াতেই বমি করার মতো উগড়ে দিচ্ছেন সব।
‘তুই পুরো পরিবারটিকেই ধ্বংস করে ছাড়বি। জেনেশুনে আমি এ সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। কেউ রাজি হবে না তোর সঙ্গে একত্রে থাকতে। হোটেলে আছিস, হোটেলে থাক। বিদেশে আছিস, বিদেশেই থাক। দেশে স্থায়ী হয়ে আর ঝামেলা বাড়াস না। আমি না হয় তোর হোটেল ভাড়াটা মিটিয়ে দেবো। আর আমার পরিবারের কারো যদি তোর সঙ্গে দেখার ইচ্ছে হয় তো দেখা করে আসবে। এখন তুই যাঃ।’ নির্লিপ্ত, উদাসীন কণ্ঠ রুক্সির আব্বাজানের। চোখে ভাসে সব।
আম্মা নেই। বুড়ো বাবার হাতেও এখন আর কোন ক্ষমতা গচ্ছিত নেই। সবকিছুর উপর এখন দুই ছেলে আর এক কন্যার একচ্ছত্র আধিপত্য; সবুজ গাছপালায় ঘেরা লক্ষ্মীবাজারের বাংলো বাড়িটি ডেভালপার দিয়ে ভেঙেচুরে ছয়তলা দুটো বাড়ি বানিয়ে এখন সুখভোগ করছে সবাই, শুধু রুক্সির অস্তিত্ব বাষ্প হয়ে উবে গেছে ওদের স্মৃতি থেকে। আব্বা এখন শুধু নিমিত্ত, মুখোমুখি ওদের যা বলতে শরম লাগে, আব্বাকে দিয়ে কঠোর ভাষায় তা-ই বলিয়ে নিয়ে অপরাধবোধ থেকে ওরা নিস্তার পেতে চায়। বিনিময়ে বুড়োর নিরাপত্তা আর খাওয়া-দাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় ওরা। তাই ওদের মন-যুগানো চাকর বনে গেছেন তিনি।
একসময়ের পরাক্রমশালী দারোগা আব্বার এখন হাত চলে না, পা যখন-তখন হোঁচট খায়, মুখের কথায় দিন-কাল ভুল হয়। তবু মেয়েকে স্থান দেবেন না এ বাড়িতে। এর থেকে বেরোতে পারলেন কই? একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস চাপে রুক্সি।
মাঝে মাঝে রুক্সির মনে হয়, ওর নিজের বেপরোয়া একগুয়েমি এসবের জন্য দায়ি। তিনি কখনও কোনদিন আব্বার পছন্দের পুরনো ছকে পা ফেলে ধেই-ধেই নাচতে চাননি। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী রুক্সি বিয়ে করেননি; আর্ট কলেজের ডিগ্রি নিয়ে একবছরের মাথায় হুট-হাট এক খ্রীস্টান ছেলেকে বিয়ে করে ফেললেন তিনি। দারোগা সাহেবের ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল জামাই হবেন পুলিশের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। সারাজীবন বড় কর্মকর্তাদের আদেশ-নির্দেশে দারোগা সাহেবের জীবন ফালা ফালা হয়েছে। মেয়েকে লগ্নী করে সেই হতাশা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন তিনি। মেয়ে তা হতে দেননি। এ আঘাত সহ্য করা কি সহজ ব্যাপার পুরুষ পিতার পক্ষে?
রুক্সির মা একথা ওকে জানাতেই তিনি উত্তর দিলেন,’ পুলিশ? রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে যে এদেশে পাঁচ টাকা ঘুষ খেতেও লজ্জা পায় না তাদের কাউকে বিয়ে করবো আমি?’
‘তুই কি আর কনস্টেবল বিয়ে করবি? তুই তো বিসিএস কর্মকর্তারে শাদি করবি। তোর আব্বার মুখটা এতো বড় হবে।’
ওই ব্যাটাও হিস্যা পায়। বুঝলা?’ ‘
‘তোর বাবারে দেহস না তুই? সে তো চুল থেইকা নখ পর্যন্ত পুরা সৎ মানুষ। সবাই একরহম না।’
‘না, আব্বা সাধুপুরুষ। তোমরার মতন সব বউর কাছেই স্বামী হল পৃথিবীর সেরা সৎ মানুষ। সংসারে কত খরচ হয় আর আব্বা কত বেতন পান, এই তফাতটা এখনও বোঝ না? নাকি জৌলুশের কাচের ঘর ভেঙে পড়বে ভেবে বালুর ভেতর মুখ লুকিয়ে রাখো, আম্মা?
সেই মেয়েকে দারোগা বাপ কিভাবে কাছে টেনে নেবেন? তিনি হলেন প্রথাবিরোধী তসলিমা নাসরিনের শিষ্যা; তাঁর মতো মুসলমানের কন্যা হয়েও অবিরাম ‘কি, কেন’ প্রশ্নবাণে ঘরের সবাইকে আহত করলে কে রুক্সিকে ভালো বলবে? বইর পাতার বাইরে এধরনের বেগম রোকেয়াকে কে পছন্দ করে বাস্তবের সংসারে?
সবই জানেন রুক্সি, বোঝেনও। তবু এসব করেই তিনি মজা লুটে বেড়ান এ সংসারে। ছোটবেলা থেকে চলতি প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অন্যকে ঘায়েল করায় দারুণ মজা পান তিনি। সেজন্য অনেকেই ওকে দেখতে পারে না। হয়তো শত্রু ভাবে। রুক্সি এসব তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নিজের আনন্দে মজে থাকেন।
এভাবে বাপের বাড়ির সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করে তিনি হামলে পড়েন আর্ট-কলেজের একদা বন্ধুদের উপর। কোন উদ্দেশ্য নেই, কোন তাড়াও নেই। শুধু খুঁজে খুঁজে তিনি সব পুরনোদের বের করে তাদের সঙ্গে দেখা করেন।
ইদানীং ওর মনে এক অদ্ভুত ইচ্ছে জেগেছে। ঠিক ইচ্ছেও নয়। লিউ টলস্টয়ের গল্পের মতন এক প্রশ্ন, কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ভেতর কে বেশি সুখি? আলমগীর, সাব্বির, সুলতানা নাকি সে নিজে? নিজের জগতে এ পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত কে সুখ ও স্বস্তি নিয়ে বেঁচে রয়েছে জানার ইচ্ছে জাগে মনে।
ঢাকায় পা রাখার পর প্রথমেই যার নাম মনে পড়ে যায় সে অবশ্যই অধ্যাপক আলমগীর। ডাক নাম রুকু। আদি ঢাকাইয়া। ওর চেহারায় একটা হারামিপনা রয়েছে। হারামিপনা? আদর করে ওকে বরং বুনো রুকু বলাটাই মানায় ভালো। সবকিছু নিয়ে তিনি মন্ড বানাতে
জানেন, হেসে উড়িয়ে দিতে জানেন কঠিন সব সমস্যা আর ঠাট্টা-মশকরা আর শ্লেষ মিশিয়ে সব সম্পর্ককেই গ্যাসের বেলুন বানিয়ে
আকাশে উড়িয়ে দিতে পারেন। ওর আঁকার হাতও সেরকম। সুন্দরী নারী সেখানে কুঞ্চুরির মুখ করে বসে থাকে। পুরুষ আর বাঁদরের মুখ মিলেমিশে থাকে ওর ক্যানভাসে। সবুজ প্রকৃতির ভেতর লুকিয়ে থাকে ড্রাগনের গনগনে মুখ। নিষ্ঠুরতা আর নম্রতা, সৌন্দর্য ও বিকৃতি আলিঙ্গন করে শুয়ে থাকে ওর আঁকাজোকায়।
রুক্সি ওকে রিং দেয় আমি এখন ঢাকায়।’
কথা শেষ হবার আগেই চিল্লিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে রুকু, এক্ষুণি চলে আসছি। তোপখানার সেই হোটেলটা তো? জিনিস রাখিস কিন্তু। আমি তন্দুরি চিকেন নিয়ে আসছি সঙ্গে করে।’ প্রতিবার এভাবেই প্রকাশ করে নিজেকে।
খুব হল্লা জমে আলমগীরের সঙ্গে। এক পর্যায়ে হাত জোড় করে আলমগীর বলে ওঠে, ‘একটা কথা কমু?’
‘ক না। একটা ক্যালা, পঞ্চাশটা কইয়া ফেলা।’
‘কথাটা মিছা না। আমি লুকিয়ে তোর স্তন ঠিকই দেখতাম। নেশার মতো হয়ে গেছিল সেটা। দেখার ওই আনন্দটা এখন আর খুঁইজ্যা পাই না রে। কসম। ‘বলে সোফা থেকে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। পুরনো নিষিদ্ধ স্মৃতি নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকেন।
‘ক্যান, তোর বউ কুসুমীরটা দেখস না?’
‘ওইটা তো বাস্তব। হাতের কাছের আমপাতা জামপাতা। মজা নাই। অহন তো ওই সময়ও নাই। অহন আমি গাছপাথর। খালি ভাইবা মজা লই। ‘বলে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করে দেন তিনি।
রুক্সি পুরুষ মানুষের এরকম কান্নায় খুব অভ্যন্ত। ওর দুই নম্বর স্বামী ভারতীয় হোটেল ব্যবসায়ী এস. মাথুর এভাবে কান্না করত। হুলো বেড়ালের মতো চেহারা ছিল তার। সহজে মেয়েরা ওর কাছে ঘেঁষতে চাইত না। পটাপটি তো দূর কি বাত। তবু এসব কান্নাকাটির কারিগরি কৌশল খাটিয়েই রুক্সির মন জয় করে নিয়েছিল। আগের মাড়োয়ারি বউর অবহেলা-অত্যাচারের করুণ গল্প শুনিয়ে কিভাবে যেন ওকে পটিয়ে ফেললো। আসলে মাথুরের উপর রাগ করতে পারতেন না তিনি। রেগে গেলে ওকে খুশি করার জন্য গিফটের বন্যায় ভাসিয়ে দিত। শুধু একটাই দোষ ছিল, প্রচণ্ড ছেলেপ্রীতি। বিয়ের অনেকদিন পর রুক্সি সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। সেজন্যই ওকে ডিভোর্স দিতে হল।
আলমগীরের দিকে তাকিয়ে রুক্সির পুরনো স্বামীর কথা মনে পড়ে যায়। আসলে কাউকে করুণা করতে শুরু হলে তার সঙ্গে আর যাই হোক, এক ছাদের নিচে বসবাস করা যায় না। খুবই দুর্বিসহ লাগে।
রুক্সি আচমকা বলে ওঠেন, আমাকে নিয়ে কুসুমীর কাছে যাবি এখন? একটু দেখা করে আসতাম। বক্সিবাজারের ভিলা টাইপের তোদের বাড়িটা খুব টানে আমায়। চল যাই? শাদি-শুদা মানুষ তুই, আমার লগে কি?’
সঙ্গে সঙ্গে আলমগীর গম্ভীর হয়ে গেলেন। বিস্ফারিত চোখ নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন ওর দিকে। গ্লাসে চুমুক দেন ঘনঘন। তারপর বলে ওঠেন, সম্ভব না দোস্তো। সম্ভব না।’
‘কেনো?’
‘কুসুমি অহন আগের মতন নাই। আমার থেইক্যা আগ্রহ তার কাইট্টা গেছে। অহন হে আল্লা-মাবুদ, খানাদানা আর পোলা-মাইয়া নাতিপুতির তত্ত্বতালাশ লইয়া আছে। আমারে লইয়া ভাবনের সময় কই?’
‘তাতে আমার কি?’
‘সেজন্যই সম্ভব না। সম্ভব না।’
কথা শুনে রুক্সির মাথা গরম হতে শুরু করে। ফের সে প্রশ্ন করেন, কেনো?’
‘সেটা বলা সম্ভব না।’ বলেই তিনি বসা থেকে উঠে হনহন করে বাইরে বেরিয়ে যায়। আর ফিরে আসেননি। ঢাকায় আরও কদিন ছিলেন রুক্সি। কিন্তু আলমগীর আর ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। টেলিফোন করলেও তিনি কেটে দিয়েছেন। পরে অবশ্য টরেন্টোতে ফিরে আসার পর ওর সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়েছে কয়েককবার। কিন্তু সেই প্রাণটা আর নেই। কেমন শীতল হয়ে পড়েছে ওদের সম্পর্কটি।
সাব্বিরকেও রিং দিয়েছেন রুক্সি। আর্ট কলেজের আরেক দোস্ত ওর। ফোনটা পেয়ে তিনি ফিসফিস করে বললেন, আমি রিং ব্যাক দিচ্ছি। মিটিং নিয়ে ব্যস্ত দোস্ত।’
কিন্তু সেই রিং আর ফেরত আসে না। ভীষণ রাগ হচ্ছিলো তখন রুক্সির। ওদের সঙ্গে দেখা করবেন বলে ছুটে এসেছেন এদেশে আর ওরা এখন মিটিংএর দোহাই দিচ্ছেন? ‘শালা বানচোত’ বলে একটা গালি দিয়ে ওঠেন আপনমনে।
বিকালের পর সাব্বিরের রিং এল। রুক্সির একবার মনে হল ফোনটা ধরবে না। কিন্তু না ধরেই বা উপায় কি? ঢাকা এখন ওর কাছে বিদেশ-বিভুঁই। স্রেফ কৌতূহলের খপ্পরে পড়ে বারবার ছুটে চলে আসেন তিনি। হোটেলে বসে বসে কি করবেন সারাদিন? যাদের খবর নিতে এসেছেন, তারাই যদি দেখা না দেয়, তো একা-একা বেরিয়ে পড়ে কোথায় যাবেন রুক্সি?
অগত্যা তীব্র জেদে ফোনটা ধরে বলে উঠলেন, ব্যাটা হারামি, আমি সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে হোটেলে বসে আছি আর তুমি বালের মিটিং মারাও বানচোত?’ ঢেলে দেন ভেতরকার যত উম্মা। পুরুষদের গালিগালাজের এই স্টাইলটা তিনি ওদের থেকেই রপ্ত করে নিয়েছেন। পুরুষদের ঘায়েল করতে চাইলে ওদেরই মতন করে রুখে দাঁড়াতে হয়। নইলে দমতে চায় না সহজে।
‘সরি ফ্রেন্ড। আমি রাস্তায়। আধ ঘণ্টার ভেতর চলে আসতেছি। আলমগীর বলেছে তুই এসে গেছিস। আমার চকোলেট আনছিস তো?’ সাব্বির মদ্যপান কিংবা সিগারেট কোনটাতেই আসক্ত নন। একেবারে সাত্ত্বিক তিনি। তিনি মজে রয়েছেন সংসারে বউ আর একামাত্র মেয়ে তনিমা ওর কাছে সব। প্রচুর টাকা পয়সা। সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে আপৎকালে বিদেশ থেকে চাউল-ডাল এনে মুনাফা করা ওর মূল বাণিজ্য। রুক্সির ধারণা, আর্ট কলেজে যাঁরা ওর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁদের ভেতর সবচেয়ে সুখি মানুষ এই সাব্বির। সেভাবেই ওকে মেপে এসেছেন এদ্দিন।
কিন্তু ভুল ভাঙলো যখন সাব্বির চকোলেট না খেয়ে পেগের পর পেগ হুইস্কি মারতে শুরু করে দেয় ওর হোটেল কক্ষে এসে।
‘কি ব্যাপার। টেলিফোনে বললি পর্যন্ত চকোলেট রাখতে। আর এখন ফ্রিজ থেকে বোতল নিয়ে নিজেই বসে গেলি?’
সাব্বির কিছু বললেন না। চুপচাপ চুমুক দিতে থাকেন গ্লাসে। রুক্সি রীতিমতো বিস্মিত ও বিরক্ত। কেউ তার নিজের চরিত্র থেকে অন্যত্র সরে এলে ওর খুব রাগ হয়। রুক্সির কাছে সাব্বির হল একজন সুখি মানুষের নমুনা। অথচ ওর এখন এমন ভাব যে মনে হবে সাব্বির এক অতৃপ্ত আত্মা। রুক্সির ভেতর কৌতূহল ভাতের বলক হয়ে ফুটছে। আসলে ব্যাপারটা কি?
সহসা এসময় কাঁদতে শুরু করে দেন সাব্বির। মনে হচ্ছে সিনেপ্লেক্সে এক সিনেমা দেখতে এসে রুক্সির চোখের সামনে অন্য সিনেমা শুরু হয়ে গেছে।
রুক্সি ভালো করে তাকান সাব্বিরের দিকে। অভিজ্ঞ চোখ খুঁজে ফিরে অজানা তথ্য-উপাত্ত। সহসা চমকে উঠেন তিনি আবিষ্কার করেন সাব্বিরের চেহারার পরতে পরতে একেবারে অন্যকিছুর ছায়া। যা কখনও ভাবেননি, সাব্বির যেন ঠিক ত-ই।
সাব্বির বেঁটেখাটো গাট্টাগোট্টা গড়নের পুরুষ। শিলপাটার মতন ছড়ানো পেশীবহুল মুখমণ্ডল। সেখানে প্রেম-ভালোবাসা বা শিল্পবোধের কোন ছোঁয়া নেই। আগেও এরকম কিছুর অস্তিত্ব ছিল না।
রুক্সি এককালে বলতেন, ‘তুই তো একটা টিয়াপাখিও আঁকতে পারিস না। আর্ট কলেজে ফর্তি হলি কেন?’ সাব্বির কোনকথা না বলে হাসতেন কেবল। কারণ ওর কাছে এর কোন জুৎসই উত্তর জানা ছিল না তখন। কিন্তু সেই শিল্পবোধহীন সাব্বির বাস্তবজীবনে সফল ব্যবসায়ী হবার পর ফোনে প্রায়ই রুক্সিকে জানাতেন,’ জানিস, আমার কারণে এখন অনেক অজানা শিল্পীর আর্ট পীস বিক্রি হয়। গুলশানে আমার তিনটি গ্যালারি, জানিস তুই?’ আত্মগর্বে টসটস করত কণ্ঠ। সেই মানুষটাই রুক্সির চোখের সামনে লোভ, হিংসা আর কেড়ে খাওয়ার ফন্দিফিকির জানা এক পুরুষ! সত্যিকার সুখী মানুষের কি এতগুলো জিহ্বা একসঙ্গে লকলক করে? আর্ট কলেজের পুরনো সাব্বির কি তবে মৃত?
রুক্সির চোখের সামনে সাব্বির। কখনও পেট চেপে ধরে, কখনও গালের দুপাশ দুই হাতের তালু রেখে ভেউ ভেউ করছেন, দেখেশুনে রুক্সির তো বেঢপ মনে হবেই। ভেতরের বিস্ময়বোধ কাটিয়ে বার বার করে রুক্সি শুধু প্রশ্ন করছেন আসলে তোর কী হইছে? এইরকম করছিস কেন? তুই তো সবচেয়ে ক্লিন মানুষ ছিলি আমাদের ভেতর। সহজ সরল অমায়িক ধরন। সুযোগ পেলে হেল্প করিস, ছুটে যাস অন্যের বিপদে। এ কি কম কথা সুখি হওয়ার?’ মুখে এসব বললেও তলে তলে ওর শিকারী দৃষ্টি ঠিকই জিরক্স কপির মতো সাব্বিরকে পরখ করতে থাকে।
‘নারে। তোরা যা ভাবিস আমি তা নই। আমি আর্ট জানি না বলে আর্ট গ্যালারি খুলেছি। নিজের অপারগতা লুকানোর জন্য। আমি ভীষণ লোভী; আমি সুলতানাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রেপ করেছি হলে নিয়ে। তুই জানিস তা? আমি তোকেও হলের রুমে নিতে চেয়েছিলাম। সুযোগ পাইনি।’
‘কি সব বলছিস? মাথা ঠিক আছে? সুলতানাকে তুই ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে রেপ করেছিস? এটা বিশ্বাস করতে হবে আমাকে? তোর মতন সাবমিসিভ একটা পোলা সুলতানার মতন দজ্জাল মেয়েকে গেইথা ফেললি? পাগল?’
‘বিশ্বাস করিস না? করবি কিভাবে? আমার বউ গিনি পর্যন্ত ফালতু বলে উড়িয়ে দেয়। ওর ধারণা, আমি নাকি নিজের শভিনিজম তৃপ্ত করছি তাতে। সাইকোলজির ছাত্রী তো!’
‘আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।’
‘সুলতানাকে ডাকতে পারবি এখন? ডাক? প্রমাণ হয়ে যাবে সামনাসামনি।’
‘ডাকবো?’
‘শিউর। আমার কথা বলবি না। খবদার। আরেকটা কথা। ওর বিয়ের রাতেও ওকে আমি নিতে চেয়েছি। প্রস্তাব শুনে সে আমার দিকে জুতা ছুড়ে মেরেছে।’
‘ব্ল‍্যাকমেলিং? মাই গড! তুই তো একটা বিস্ট। নো নো। তোর বউর ধারণাই ঠিক। তুই এরকম হতেই পারিস না। একটা নিরীহ গোবেচারা ভদ্র আর্ট অনুরক্ত যুবক কিভাবে রেপিস্ট হয়? ইমপসিবল। আমি এক্ষুণি সুলতানাকে ডাকছি।’
উত্তেজনায় রুক্সি একটা ইন্ডিয়ান বিয়ার মেরে দিলেন। তাও ওর চোখ থেকে বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। এর ভেতর তিনি সুলতানাকে রিং দিয়ে বসলেন, তাড়াতাড়ি আয়।’
‘তুই? কোথায়?”
‘তোপখানায়।’
‘কি বলিস?’
‘হ্যা। তুই?’
‘আমি ছোট ছেলের কলেজে।’
‘বিজ্ঞাপনী সংস্থায় যে চাকরি করতি তা কি ছেড়ে দিয়েছিস?’
‘কবে। সংসার আর চাকরি দুটো একসঙ্গে রাখা মুশকিল। আর এখন বায়োজিদের তো ম্যালা ইনকাম। রিয়েল এস্টেট কোম্পানিটা তো ও দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। এনিওয়ে, কোথায় আসবো?’
‘এসএমএস করছি, চলে আয়।’
‘শোন বেশিক্ষণ বসতে পারবো না রে। ছেলেকে কলেজে রেখে এসেছি। ছুটি হবার আগে ফিরতে হবে।’
‘আয় না।’
ঘণ্টাখানেকের ভেতর চলে এলেন সুলতানা। ওর ভালো নাম নার্গিস সুলতানা। অসম্ভব প্রাণবন্ত আর গল্পপ্রিয় মানুষ তিনি। যেখানে-সেখানে যখন-তখন গল্প তৈরি করতে ওস্তাদ। ‘জানিস, পার্কের যে পাগলটা আছে না, মজনু না কি নাম, বস্তা আর ছাল-বাকল পরে হাঁটে, ওই বেটা কিন্তু ছ্যাকা কেইস। জানিস মহিলা কে?’ সবাই কৌতূহল নিয়ে হয়তো তাকালেন ওর দিকে। তিনি তখন ভাব নেবেন। আঙুল দিয়ে চুলের জট খুলবেন, মাথায় হাত বুলাবেন। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কাটানোর পর ফিক করে হেসে হয়তো বলে উঠবেন যুঁই
ম্যাডাম।’ যুঁই ম্যাডাম হলেন ওদের কলেজের সবচাইতে সুন্দরী মোহময়ী শিক্ষিকা। যখন করিডোর দিয়ে হেঁটে যান তখন জুঁই ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে দেন চারপাশে। পিছন থেকে সাব্বির মুঠোর ভেতর বাতাস কয়েদ করে বলে ওঠেন,’ জুঁই ম্যাডাম। আহা!’ সেই ম্যাডামের সঙ্গে পার্কের পাগলের সম্পর্ক?
এ নিয়ে কল্পনা-জল্পনা করেই সময় কেটে যেতো ওদের। তখন থেকে পাগলের দাম বেড়ে গেল। না চাইতেই পাগলকে ওরা সাহায্য করতে থাকেন। একজন অরেকজনকে লুকিয়ে রোজ ভালো-ভালো খাবার-দাবার দেন। সোহা নামের এক ধনীর কন্যা ছিলেন ওদের ক্লাসমেট, শুনে সে-ও তোয়াজ করতে থাকেন পাগলকে। রুক্সি শুনেছেন, সে নাকি মালিবাগের নতুন হওয়া আড়ং থেকে কিনে পাঞ্জাবি উপহার দিয়েছিলেন পাগলাকে।
অনেক পরে সুলতানা ফিকফিক করে হেসে ওদের বলেছেন,’ গুল মারছিলাম। তোরা তো এসব অবাস্তব খুব খাস। তাই।’ এরকম ঘটনা ওর অনেক রয়েছে। একবার টরেন্টোতে থাকাকালীন রিং দিলেন সুলতানা। কিছুতেই দুজনের ভেতর কথা আর জমছে না। মাথুরকে নিয়ে রুক্সির ভীষণ মন খারাপ। হাতিটাকে সামাল দিতে পারছে না সে। রীতিমতো হতাশায় ভুগছেন। সহসা সুলতানা বলে উঠলেন,’ দোন্তো, একটা কথা শুনছিস?’
‘কি?’
‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফ নাকি আমাদের নায়িকা ববিতার প্রেমে পড়েছিলেন একসময়? চিঠিগুলো নাকি এখনও যত্ন করে রেখেছেন ববিতা, জানিস?’
এবার না হেসে উপায় নেই। মিথ্যা জেনেও এ বিষয় নিয়ে ওদের কথা বাড়তে থাকে। রুক্সি জানালেন, ‘তুই জানিস না ববিতা আপারে কী প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো পারভেজ মোশারফের পক্ষ থেকে? জানিস?’
সুলতনা আকাশ থেকে পড়ার মেকি ভান করে উত্তর দেন’ কি?’
‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীত্ব?’
‘ববিতা আপু কি উত্তর দিলেন?’
‘রাজি হলেন না। বললেন আমার কাছে নায়ক ফারুক নায়ক জাফর ইকবালই স্বপ্নের পুরুষ। কোন জেনারেল নয়। আমি যেমন আছি তেমনই ভালো। তেমনই থাকতে চাই। হিহিহি।
শুরু হলো কথার পিঠে কথা। সব ভুলে গিয়ে কথার ফোয়ারায় মগ্ন হওয়া। এ যে কখন শেষ হবে তা কেউ বলতে পারবেন না।
সেই সুলতানা রুক্সির তোপখানার হেটেল কক্ষে। রুমে পা দিয়ে সাব্বিরকে দেখে তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন, ওমা, সাব্বির যে। সে এসব কি গিলছে? জীবনভর ভালমানুষ সেজে থাকার এ কি দশা?’
‘তোকে নাকি সাব্বির হলের রুমে ভুলিয়ে ভালিয়ে রেপ করেছিলো?’ কোন রাখঢাক নেই। সহজ-সরল তীক্ষ্ণ প্রশ্নের তীর। এভাবে কেবল বন্ধুকেই প্রশ্ন করা যায়। স্বামী-সন্তান, মাবাবা, ভাইবোন, আত্মীয়-পরিজন আর কাউকেই নয়। সাব্বির সোফার সঙ্গে হেলান দিয়ে রয়েছে। হাতে গ্লাস। মাথা নিচু, গলার টাইটার নট ঢিলা, ঢলঢল করছে মরা সাপের মতন বুক আর ভাতের ডেকচির মতন দেখতে পেটের উপর।
সুলতানা রুক্সির দিকে তাকালেন একঝলক। মোটেই চমকালেন না। একটু বাদে হৈ-হৈ হাসিতে ঘর কাঁপিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। সাব্বিরের আনত মুখ তুলে মেয়েলি এক হাসি দিয়ে সুলতানা আচমকা বলে ওঠেন, ‘কিরে, আমারে রেপ করার খুব শখ তোর? রুক্সির বড় বড় ব্রেস্ট দেখে খুশি হোসনি? তোদের যৌনতাবোধের প্রথম উনুন তো আমরাই। নাকি?’
‘তাহলে পুরোটাই বানানো? সাব্বির?’ চোখ পাকান রুক্সি।
সাব্বির এবার মদালস নত মুখখানা কিঞ্চিৎ তুলে ওদের দিকে দৃষ্টি তাক করেন। বিমর্ষ বদনে আক্ষেপের সুরে বলেন,’ এ জীবনে এ শখ আর কোনদিন পূরণ হবে না জানি। আর সুলতানার মতন এরকম চৌকশ তাগড়া মেয়েকে আমার মতন পাঁচফুট চার ইঞ্চির পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব? তুই বিশ্বাস করলি?’ সাব্বিরের মাথা ফের নুয়ে পড়ে পেটের উপর। নেশা পুরো ধরে গেছে।
রুক্সি ফের আকাশ থেকে পড়লেন। ওর সব হিসাব-নিকেশ ব্যর্থ। এলোমেলো হয়ে পড়ছে সবকিছু। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে , এই ঘৃণাবর্তের ভেতর তিনি কেবল পাঁক খেতে থাকেন। একসময় রুক্সি হেসে ওঠেন জোরে, শালা সাব্বিরের বাচ্চা, বানচোত ধর্ষকামী। মনে মনে এ কাজ বহুবার তুই করেছিস, না? বল সত্যি কিনা?’
সাব্বির কোন উত্তর দেন না। তিনি গ্লাসে চুমুক দেন আর মাথা নুয়ে মুচকি হাসেন। এ আচরণে দুজনই বুঝে নেন সাব্বিরের মনের কথা। টরেন্টো ফেরার পর সুলতানার সঙ্গে নিয়মিত কথা চলে রুক্সির। উল্টা-পাল্টা নানা বিষয় আর কিছু হাহা-হোহো। সহসা একদিন পুরনো প্রসঙ্গটা ভিডিও-আড্ডার বিষয় হয়ে ফিরে এল। স্মৃতিচারণ করার ভঙ্গিতে রুক্সি হালকা সুরে বললেন,’ তোরা পারিসও বটে। এমন সিরিয়াস করে এসব কথা কেউ বলতে পারে একমাত্র তসলিমা নাসরিন ছাড়া?’
ওপাশে কয়েক সেকেণ্ড নীরবতা। হঠাৎ সুলতানা বলে ওঠেন, কে বলেছে সাব্বির আমায় রেপ করেনি? করেছিলো তো? মাত্র দুবার। কিন্তু ও আমার হাজবেন্ড বায়োজিতের চাইতে বেটার। বায়োজিত আরও নিষ্ঠুর, আরও নির্লিপ্ত। সপ্তাহে দুবার নিয়ম করে নির্দয়ভাবে রেপ করে আমাকে। আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা ভালো-মন্দ কোনকিছুই ওর বিবেচনায় থাকে না। তাই এগুলো বলার মতন কোন বিষয় বলেই মনে হয় না আজকাল। তাই ওরে মাফ করে দিছি। মনে রাখিস রুক্সি, যতই লেখাপড়া করি না কেন, এগুলো মেনে নিয়েই, হজম করেই মেয়েদের চলতে হয়। আমরা এর ব্যতিক্রম নই। বাদ দে তো। পারভেজ মোশারফের খবর রাখিস?’ জোর করে হেসে ওঠেন সুলতানা।
‘না তো?’ রুক্সির কণ্ঠ থেকে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না।
‘ও বিরল রোগে উননব্বই বছর বয়সে নির্বাসিত হয়ে মারা গেছেন দুবাই শহরে। অনেকে বলে পাকিস্তানের জনগণের দুর্দশার জন্য আইয়ূব খান, জিয়াউল হকের মতন তিনিও সমানভাবে দায়ি। অন্তিম সময়ে বেচারার শেষ ইচ্ছা কি ছিল জানিস?’ মিথ্যে যে এমন সাজিয়ে-গুছিয়ে বলা যায় তা সুলতানার কথা না শুনলে বোঝা মুশকিল।
রুক্সিও অধীর আগ্রহের ভান করে জিজ্ঞাসা করেন, ‘না তো? ব্যাপারটা কি?’
‘তাও জানিস না? বৃথা তোর লেখাপড়া, বৃথা তোর ঝকঝকে টরেন্টো-জীবন।’ হায়-হায় করে কৃত্রিম ঢেউ তোলেন কণ্ঠে। পাল্টাপাল্টি হিসাবে রুক্সির জিহ্বা আফসোসের শব্দ করে।
‘কি? পরিষ্কার করে বলবি তো?’
‘শোন তাহলে। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে কবরী আপার ঠোঁটে ‘আমি তোমার বন্ধু, তুমি আমার স্বামী’ গানটা শুনতে চেয়েছিলেন এককালের মহা বিক্রমশালী রাষ্ট্রনায়ক পারভেজ মোশারফ। শুনেছি, ইয়ুটিউবে গানটা শুনে শুনে নাকি তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বেচারা!!’ ফের হাসির রোল সুলতানার গলায়।
‘তুই খবরটা কই পাইলি, এ্যা? ফাজিল কোথাকার!’
‘কেন, বদহাওয়াডটকমে। তোর চোখে পড়েনি? টরেন্টো শহরে ভালো চাকরি করিস বলে কিছুই দেখবি না?’ উত্তরটা যেন প্রস্তুত ছিল, ঝটপট বলে দেন সুলতানা। ডুবোচরের মতন বাঁধভাঙা হাসির উচ্ছ্বাস আড়ালে। রুক্সি ঠিকই টের পান।
‘তুই একটা খচ্চর।’ বলে এবার রুক্সিও হাসতে থাকেন। দুই বান্ধবীর হাসির যৌথ মহড়া থামতেই চায় না মোবাইলের এপার-ওপারে।
হাসতে হাসতে উভয়ই একসময় একেবারে ভুলে যান, জীবন বড় নিষ্ঠুর।

রুক্সি – মণীশ রায়

০৭:০০:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪
মণীশ রায়
পোশাকি নাম মোসাম্মৎ রোখসানা বেগম। বন্ধুমহলে শুধুই রুক্সি। আর্ট কলেজের একদা দুর্দান্ত স্মার্ট এক ছাত্রী। কেবল বন্ধু-বান্ধবই নয়, পরপর কবছরের জুনিয়র ছাত্র-ছাত্রী পর্যন্ত, এরকম বেপরোয়া আবেদনময়ীকে পারলে চ্যুইংগাম মনে করে জাবর কাটে প্রতিদিন, এমনি মনমোহিনী ছিলেন তিনি। কলেজ চত্ত্বরে তাঁর এই উপস্থিতি ছিল চকমকি পাথরের মতো। একই সঙ্গে উজ্জ্বল ও ক্ষুরধার, তাঁকে কি ভোলা যায়?
এখনকার বয়স? পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই। সামনাসামনি হলে বড়জোর চল্লিশ। অতি যত্ন ও সতর্কতা বজায় রাখায় ত্বক এখনও সর্ষে ফুলের মতো উজ্জ্বল ও মাখনের মতো পেলব। দৃষ্টিতে কৌতূহল আর হাসিতে চড়ুইর মতো চঞ্চল এক মাদকতা। সব মিলেমিশে যৌবনের অস্ফুট ছটা এখনও শরীর ছাড়েনি। যেন কাউকে সামনে পেলে এক্ষুণি মৌমাছির মতো ঢলে পড়বেন।
রুক্সি থাকেন কানাডার টরেন্টো শহরে। হুয়াইট-কলার চাকরি তাঁর। একই সঙ্গে মৌজ-মাস্তিতে ভরা বেহিসাবী স্বাধীন জীবন-যাপনে অভ্যন্ত। কথা ও চলাফেলায় রাখ-ঢাক নেই। তাই এদেশীয় দমবন্ধ আলখেল্লায় ঢাকা প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে নেই তেমন কোন যোগাযোগ।
রুক্সির বন্ধু-বান্ধব একেবারে হাতে গোনা কজন। সেই যে আর্ট কলেজে থাকতে যে-জন কাছাকাছি ছিলেন, এখনও তেমনই রয়েছে। সময়ের সঙ্গে পরিচিতির ব্যাপকতা বাড়লেও কেবল বাড়েনি বুকের সঙ্গে আগলে রাখার, যা খুশি বলা ও ভাবার মতো বন্ধু-সংখ্যা।
রুক্সির এরকম বিরল বন্ধুদের একজন হলেন বিশিষ্ট চারুশিল্পী অধ্যাপক আলমগীর হোসেন। এখনও নিজের ভেতরে কোন মানসিক উচাটন বা চাপ দেখা দিলে তিনি পুরনো বান্ধবী রুক্সিকে টরেন্টোয় রিং দেন; ভরাট গলায় বলে ওঠেন,’ দোস্ত, হাছা কইতাছি, মিছা কতা না। এখন অব্দি তোর মতন এমন একখান মাইয়া চোখে পড়ে নাইক্কা। কলেজ ক্যাম্পাসে যৌবনের ত্রাস ছড়ানো একটা পাগলি বেড়াল ছিলি তুই। হাছা কইরা কইতাছি রুক্সি, তোয়াজ না।’
‘শালা ফোর টুয়েন্টি। এক নম্বর না, তুই হলি আমার দুই নম্বরি স্তাবক! আসল জায়গায় দিমু একটা। যা ফোট্।’ বলে খিলখিল করে হাসিতে ভেঙে পড়েন রুক্সি। এ বয়সেও এসব কথা শুনতে ওর বেশ লাগে। ভেতরটা ফুরফুরে হয়ে যায় আনন্দে ও গর্বে। নিমেষে নেশার মতো এক ঘোর ছড়িয়ে যায় শরীরে ও মনে।
আলমগীর উত্তর দেন, হাছা কতার ভাত নাই দেখতাছি। বিশ্বাস করলি না তো? সত্যি বলছি। আর্ট কলেজের অধ্যাপক হয়েই বলছি, তোর মতন বেদেনি কিসিমের একটা মেয়েই দেখি না আজকাল। সব যেন মাশরুম বনে গেছে। চোখে পড়লেই কেমন একটা স্যাঁতস্যাঁতে অনুভূতি হয় মনে। তোর মতন বুনো গন্ধটা আর পাইনা। কান পাকড়াইয়া কইতাছি, হাছা বাত। একটা বাতও মিছা না।’
‘তুই তো তখন আড্ডার ছলে আমার বুকের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতি। ভুলে গেলি? ঠিক কিনা, ক?’ গলায় ইয়ার্কী।
‘সোহরাওয়ার্দি পার্কের আড্ডার কথা মনে আছে তোর?’ কথা ঘুরাতে চান আলমগীর। মুখ লুকাবার ছাতা খুঁজে পান না হাতের কাছে। ধরা পড়ায় লজ্জা পান তলে তলে, এখনও!
কঠোর নিয়মে বাঁধা অধ্যাপকের চোখে ভাসে সেই সময়। লুকিয়ে চুরিয়ে বান্ধবীর বুকের দিকে তাকিয়ে থাকার ব্যাপারটা মিথ্যে নয়। এসব কি বলার কথা, বিশেষ করে পড়ন্ত বয়সে এসে? নিজেকে অসভ্য লাগে। ভেতরে একটা চোর-চোর ফিলিং হয়। বিশ্রী সে অনুভূতি। সুযোগ পেলে রুক্সি প্রায়ই একথা বলে ওকে জব্দ করতে চান। তিনি তখন আর কথা বলতে পারেস না। আড়ষ্টতা চেপে বসে।
‘থাকবে না? ওই পার্কেই তো তুই আর সাব্বির মিলে আমারে দিয়া গাঁজাভরা সিগারেটে টান দেয়ালি আর আমারে নেশায় মজিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দুজন মিলে আমার বুক দেখতি। শালা বানচোত পুরুষবন্ধু আমার। সবগুলো এক।’
‘যাঃ। এসব তোর মনগড়া কথা। পুরুষগুলোকে বেকায়দায় ফেলার ফন্দি। পারিসও তুই।’ নিজের কাছে নিজেকে কেমন যেন বেআক্কেল লাগে। লুকনোর মরিয়া চেষ্টা বান্ধবীর কাছে।
‘মনগড়া? হোস্টেলে গিয়ে কবার গণ-বাথরুমে ঢুকতি তাও সাব্বির বলে দিতো আমায়।’ বলে ফের খিলখিল করে হেসে ওঠেন রুক্সি। আলমগীরের মতো গুণী-জ্ঞানী সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন এক অধ্যাপককে এমন বিটলা রকমের বেকায়দায় ফেলতে পেওে রুক্সির আনন্দ যেন আর ধরে না।
‘তুই কি এগুলো ভেবে মজা পাস আজকাল? এগুলোও পারভারশন। বুঝিস?’ বলতে চাননি; তবু নিজেকে বাঁচাবার অন্তিম এক চেষ্টা অধ্যাপকের।
‘চিরকালই যৌনতা আমার পছন্দের বিষয়। স্বামীর প্রাচুর্য, সন্তানের অর্জন, স্ত্রীর সৌন্দর্য নিয়ে খুল্লামখুল্লা কথা বলতে পারলে কেন যৌনতা নয়? সবাই সেদিকে ছুটছি অথচ কেউ কিছু বলি না আমাদের সমাজে। সিক্রেট লাইফ বলে দাদ-বিখাউজের মতন লুকিয়ে রাখি জামার তলায়। আশ্চর্য!’
‘আগে তো এসব বলিস নি কখনও?’
‘বললে কী করতি? তোর আর সাব্বিরের মতন ভীতুর ডিম দিয়ে কিছু কি হতো সেসময় বল? ‘কী হবে’, ‘কে, কি ভাববে’ চিন্তা করতে করতেই তো তোদের যৌবন শেষ, যৌনতার কবরখানা সেখানে। শোন, এখন বয়স হয়েছে না? সব যৌন হতাশা কেবল ঠোঁটে জমা হচ্ছে। ঠোঁটই এখন একমাত্র যৌনযন্ত্র, বুঝলি?’ বলেই ফের হাসির ফোয়ারা।
আলমগীরের রুচিবোধ বারবার করে হোঁচট খাচ্ছে এসব কথায়। বডি-শেমিং এর মতো রীতিমতো অসভ্যতা বলে মনে হচ্ছে এগুলো। কারো শারীরিক গঠন কিংবা মানসিক দুর্বলতা নিয়ে কথা বলা কি ঠিক?
রুক্সির যে মাঝে মাঝে কি হয়? জিন-পরি পাওয়া মানুষের মতো লাগে কখনও, একদম পাল্টে যান তখন। মুখে কোন লাগামই থাকে না। সরকারি কলের অবিরল ধারার মতো যা খুশি তা শুধু বলেই যাচ্ছেন। আবার অন্যসময় ‘তাড়াতাড়ি বল্’ বলে একই মহিলার গুরুগম্ভীর বিপরীত আচরণ, দুচারটা কথা ছাড়া আর কিছুই যেন বলার নেই, অদ্ভুত মানুষ তখন তিনি!
তা সত্ত্বেও রুক্সির সঙ্গেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে, আড্ডা দিতে আঁইচাই করে আলমগীরের মন। বিস্মৃতপ্রায় প্রিয় গানের কলি হঠাৎ রাস্তার মোড়ে কানে ভেসে এলে যেমন সুখ হয়, তেমনিভাবে রুক্সি জাগিয়ে দেয় ওকে। এ বয়সে প্রাণ খুলে হাসা ও কথা বলা যে কী মধুর একান্ত অভিজ্ঞতা তা কেবল তিনিই বুঝতে পারেন।
এসব ফোনকল বেশিরভাগ রাতের বেলাতেই হয়। তখন কুসুমী ওর পাশে মড়াকাঠের মতন শুয়ে থাকে। দুজনই ওরা আদি ঢাকাইয়া। রুস্তম সর্দারের নাতনি ওর স্ত্রী কুসুমী। আলমগীর ওদের পুরনো ঢাকার পাতলা লেনের বাড়িতে জায়গীর থেকে আর্ট কলেজে পড়ালেখা
সেরে সেখানকার অধ্যাপক হয়েছেন।
ওদের কোন সন্তান নেই। তবে অনেকগুলো পোষ্য কুকুর-বিড়াল রয়েছে ছাদের উপর। ওদের দেখভাল করেই সময় কাটে একরোখ মেজাজী কুসুমীর।
মাঝে মাঝে কুসুমী ওকে বলে, ‘রাইতের বেলায় সব থুইয়া কার লগে কথা কও অত? কানাডার ওই চাইর বিয়াওলি মাগিটা না?’
‘দিন-দিন রুক্সিটা কেমন য্যান বদলাইয়া যাইতাছে। বুঝবার পারতাছি না।’ এমন এক ভাব ওর কথার সুরে ভেসে বেড়ায় যে মনে হবে রুক্সিকে তিনি বুঝি দুদিন হল চেনেন। নিজেকে নিরপেক্ষ-নির্দোষ এক মনোবিজ্ঞিানীর মতো পেশ করেন স্ত্রীর কাছে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল হিসাবে এই অভিনয়টুকু তিনি ভালোই রপ্ত করে নিয়েছেন দাম্পত্যে। খুশিতে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ান মাঝে মাঝে।
‘বারো ভাতারি মাগিগো শেষ বয়সে এই রকমই অয়। নিজের চক্ষে ঘুম আহে না, মাগি অহন তুমার লগে কথা কইয়া তুমার ঘুমটা বরবাদ করবার চায়। আহ ফোন ছাইড়া?’ তাড়া দেয় স্বামীর চেয়ে দশ বছরের ছোট এসএসসি ফেল কুসুমী। চোখে অনন্ত ঘুমের আবেশ।
আলমগীর মোবাইল ফোনটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বিছানায় এসে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন। চেহারা জুড়ে তেতো ওষুধ সেবনের অভিনয় ছড়িয়ে রাখলেও মনে মনে তিনি হা-হা করে হাসছেন। এসময় পুরনো দিনের কথা খুব মনে পড়ে। কীরকম মুখর ছিল সেসব আড্ডা। যত মনে পড়ে তত আনন্দের ফাগ ছড়িয়ে পড়ে অন্তরে। কখনও হাসি পায়, কখনও লজ্জায় কুণ্ঠিত হয়ে পড়েন। অথচ এসবের কোন মূল্যই নেই কুসুমীর কাছে। সে তার বাপদাদার গর্বে আটখানা। কিছু হলেই ‘আমার বাপে কইতো’ বলে শুরু করে দেবে এক বিশাল কাহিনি। এর না আছে ভাব, না আছে ভালোবাসা। তবু সে বলে ছাড়বেই। বিরক্তিকর সব। ইচ্ছে হয় সব ছেড়েছুড়ে নতুন করে জীবন রচনা করতে। কিন্তু তা বোধ করি এ জীবনে আর সম্ভব হবে না। ঝুরিবটের মতো সবকিছু সেঁধিয়ে গেছে অভ্যেসের গভীরে।
ওপাশে রুক্সির একই দশা। নিজেকে উজাড় করে কথা বলার আরামটাই আলাদা। প্রিয় যোগ-ব্যায়ামের মতো এ বয়সে বড় স্বস্তি মিলে তাতে। এজন্য ফেলে আসা কৈশোর-যৌবনের স্মৃতিগুলো ভুলভুলাইয়া রহস্য হয়ে ধরা দেয় ওর কাছে। সেগুলো নিজের পোড় খাওয়া দৃষ্টির আতশকাচের নিচে রেখে পরখ করার আলাদা একটা মজা রয়েছে। অতল বিনোদনের খনি হয়ে ওঠে স্মৃতিগুলো।
বিছানায় মুনিম নামের ওর চারনম্বর পুরুষটা বেদম নাক ডাকছে। এককালে অশ্বডিম্ব প্রসবকারী প্রকৌশালীর চাকরি করতো এক কোম্পানিতে। এখন সব ছেড়েছুড়ে বউর রোজগারে ভাগ বসাচ্ছে। রাত করে পানাহার সেরে দেরিতে শুতে যাওয়ার অভ্যেস লোকটার। সাদা বাঁদরের মতো চেহারাসুরত, কেবল লাফায়। এটা করবো, ওটা দেবো আসলে জীবনে কিছুই করতে পারেনি এই অপদার্থ প্রকৌশলীটি। রুক্সি ওকে বিয়ের আগে ভেবেছিলো, ওর সঙ্গে বিয়েটা হলে নিরাপত্তা জুটবে সারাজীবন। আগের বিদেশী স্বামীর মতো রাস্তার কিনারে পাভের সামনে ওকে ফেলে রেখে পালাবে না। তার উপর নিজের দেশের মানুষ, বুয়েটের এককালের মেধাবী ছাত্র। কিন্তু বছর পাঁচেক পর টের পেলেন, এ একটা বোকাচোদা, এর সঙ্গে শোয়া পর্যন্ত যায় না এক বিছানায়। কটু একধরনের গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসে ওর। চরম বিরক্তিকর, দিনদিন টরেন্টোর শীতের মতন এর তীব্রতা কেবল বাড়ছে। চার নম্বর এই স্বামী-রত্নটিকে, রুক্সি ভাবছেন , সামনের বছরই টা-টা বাই-বাই করে দেবেন। কতো আর চিল্লাবেন? এ বয়সে কি কেউ কারো অভ্যেসে বদল আনতে পারে?
এ পর্যন্ত চার স্বামীর সঙ্গে রুক্সির সংসার হয়েছে। শুরুতে প্রতিবার প্রচণ্ড এক মানসিক উত্তেজনা। কিছুদিন আবেগের জলকেলি; তারপর যেই-সেই। সেই পুরনো বৈচিত্রহীন একঘেয়েমি ওকে পেয়ে বসে। অবসাদ কোন এক অশুভ প্রেতাত্মার মতো ঢুকে পড়ে ভেতরে। ধীরে ধীরে বিষে পরিণত হয় সম্পর্ক। তখন ‘শুয়োরের বাচ্চা চলে গেলে বাঁচি’ ধরনের অথর্ব এক মানসিকতা ওকে গ্রাস করে নেয়। তখন যে- কদিন সম্পর্কটি টিকে থাকে তা কেবলই সহ্যশক্তির জোরে, অন্যকিছু নয়। দশবছরের ছোট মুনিমের অবস্থান এখন সেই পর্যয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। মৃত সম্পর্ক বড় সাংঘাতিক, বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেই রুক্সিকে গিলে খাবে। অবসাদ-অতৃপ্তি আর মৃত্যুচিন্তা ওকে যে কোথায় নিয়ে যাবে, ভাবলেই শরীর শিউরে ওঠে বারবার।
ঠিক তখনই বাড়ির কথা বড় মনে পড়ে যায়। হাত-পা ছড়িয়ে নারকেল-সুপারির চেনা হাওয়া-রোদ্দুরে ভেসে বেড়াতে মন চায়। প্রবাসে বাস করে-করে ভেতরে ফাঙ্গাস জমে গেলেই এসব মনে হয়। প্রায়ই বৃক্ষের নিবিড় ছায়া আর নদীতটের মায়া ফুপিয়ে ওঠে ওর ভেতর। কিন্তু কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়ালেও ক্লান্তি চলে আসে একসময়। মনে হয়, নিবিড় প্রকৃতির ধারে তো একজন সুখময় পুরুষের সাক্ষাৎ মিলবার কথা। তিনি কই? তিনি তো ওর অপহৃত সময়, ভুলভালাইয়া রহস্যের হাতছানি, একেই তো নিরন্তর খুঁজে চলেছেন তিনি। হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েও যেন কোথায় পালিয়ে যেতে চান। কিভাবে ধরা দেবেন ওর সুখময়? এ ভাবনা থেকেই একসময় হতাশা ভর করে। ‘কিছু ভালো লাগে না’-র মতো কদিন ভেতরে কামড়াকামড়ি চলার পর নিজের দেশের টিকিট কাটতে নিসপিস করে স্বদেশ-অনুরাগী রুক্সির মন!
সেখানে ফিরেও দেখেছেন রুক্সি। প্রথম প্রথম কানাডা থেকে প্লেনে চেপে বসলেই মনে হতো, ওর যত বন্ধু-পরিজন সবাই বুঝি ওর ফিরবার কথা শুনে ওকে ঘিরে সাঁওতালদের মতো যূথবদ্ধ হয়ে নাচতে শুরু করবে আনন্দে। এতো টান, এতো ভালোবাসা কোথায় রাখবে সে? বহিঃপ্রকাশ তো ঘটবেই। কিন্তু বাস্তবে ঢাকার যানজট, নোংরা আর মানুষের বদ্ধ মানসিকতায় ওর শ্বাসকষ্ট কেবল বাড়তেই শুরু করে। সুখের নামগন্ধ নেই। ডাক্তারের কাছ থেকে চেয়ে মুঠোভরতি বড়ি গিলে খেয়েও জান বাঁচে না। শেষ আশ্রয় ওর পিতা। তিনিও মুখের উপর বলে দেন তুই কোনদিনও আমাদের ছিলি না। এখন কেনো?’
‘আমি থাকতে চাই আপনাদের সঙ্গে।’ কণ্ঠের বলিষ্ঠতা দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান রুক্সি। কিন্তু সবই বৃথা। কেননা আব্বাহুজুর ধারাপাতের নামতা আগেই মুখস্থ করে রেখেছেন। সামনে দাঁড়াতেই বমি করার মতো উগড়ে দিচ্ছেন সব।
‘তুই পুরো পরিবারটিকেই ধ্বংস করে ছাড়বি। জেনেশুনে আমি এ সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। কেউ রাজি হবে না তোর সঙ্গে একত্রে থাকতে। হোটেলে আছিস, হোটেলে থাক। বিদেশে আছিস, বিদেশেই থাক। দেশে স্থায়ী হয়ে আর ঝামেলা বাড়াস না। আমি না হয় তোর হোটেল ভাড়াটা মিটিয়ে দেবো। আর আমার পরিবারের কারো যদি তোর সঙ্গে দেখার ইচ্ছে হয় তো দেখা করে আসবে। এখন তুই যাঃ।’ নির্লিপ্ত, উদাসীন কণ্ঠ রুক্সির আব্বাজানের। চোখে ভাসে সব।
আম্মা নেই। বুড়ো বাবার হাতেও এখন আর কোন ক্ষমতা গচ্ছিত নেই। সবকিছুর উপর এখন দুই ছেলে আর এক কন্যার একচ্ছত্র আধিপত্য; সবুজ গাছপালায় ঘেরা লক্ষ্মীবাজারের বাংলো বাড়িটি ডেভালপার দিয়ে ভেঙেচুরে ছয়তলা দুটো বাড়ি বানিয়ে এখন সুখভোগ করছে সবাই, শুধু রুক্সির অস্তিত্ব বাষ্প হয়ে উবে গেছে ওদের স্মৃতি থেকে। আব্বা এখন শুধু নিমিত্ত, মুখোমুখি ওদের যা বলতে শরম লাগে, আব্বাকে দিয়ে কঠোর ভাষায় তা-ই বলিয়ে নিয়ে অপরাধবোধ থেকে ওরা নিস্তার পেতে চায়। বিনিময়ে বুড়োর নিরাপত্তা আর খাওয়া-দাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় ওরা। তাই ওদের মন-যুগানো চাকর বনে গেছেন তিনি।
একসময়ের পরাক্রমশালী দারোগা আব্বার এখন হাত চলে না, পা যখন-তখন হোঁচট খায়, মুখের কথায় দিন-কাল ভুল হয়। তবু মেয়েকে স্থান দেবেন না এ বাড়িতে। এর থেকে বেরোতে পারলেন কই? একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস চাপে রুক্সি।
মাঝে মাঝে রুক্সির মনে হয়, ওর নিজের বেপরোয়া একগুয়েমি এসবের জন্য দায়ি। তিনি কখনও কোনদিন আব্বার পছন্দের পুরনো ছকে পা ফেলে ধেই-ধেই নাচতে চাননি। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী রুক্সি বিয়ে করেননি; আর্ট কলেজের ডিগ্রি নিয়ে একবছরের মাথায় হুট-হাট এক খ্রীস্টান ছেলেকে বিয়ে করে ফেললেন তিনি। দারোগা সাহেবের ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল জামাই হবেন পুলিশের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। সারাজীবন বড় কর্মকর্তাদের আদেশ-নির্দেশে দারোগা সাহেবের জীবন ফালা ফালা হয়েছে। মেয়েকে লগ্নী করে সেই হতাশা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন তিনি। মেয়ে তা হতে দেননি। এ আঘাত সহ্য করা কি সহজ ব্যাপার পুরুষ পিতার পক্ষে?
রুক্সির মা একথা ওকে জানাতেই তিনি উত্তর দিলেন,’ পুলিশ? রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে যে এদেশে পাঁচ টাকা ঘুষ খেতেও লজ্জা পায় না তাদের কাউকে বিয়ে করবো আমি?’
‘তুই কি আর কনস্টেবল বিয়ে করবি? তুই তো বিসিএস কর্মকর্তারে শাদি করবি। তোর আব্বার মুখটা এতো বড় হবে।’
ওই ব্যাটাও হিস্যা পায়। বুঝলা?’ ‘
‘তোর বাবারে দেহস না তুই? সে তো চুল থেইকা নখ পর্যন্ত পুরা সৎ মানুষ। সবাই একরহম না।’
‘না, আব্বা সাধুপুরুষ। তোমরার মতন সব বউর কাছেই স্বামী হল পৃথিবীর সেরা সৎ মানুষ। সংসারে কত খরচ হয় আর আব্বা কত বেতন পান, এই তফাতটা এখনও বোঝ না? নাকি জৌলুশের কাচের ঘর ভেঙে পড়বে ভেবে বালুর ভেতর মুখ লুকিয়ে রাখো, আম্মা?
সেই মেয়েকে দারোগা বাপ কিভাবে কাছে টেনে নেবেন? তিনি হলেন প্রথাবিরোধী তসলিমা নাসরিনের শিষ্যা; তাঁর মতো মুসলমানের কন্যা হয়েও অবিরাম ‘কি, কেন’ প্রশ্নবাণে ঘরের সবাইকে আহত করলে কে রুক্সিকে ভালো বলবে? বইর পাতার বাইরে এধরনের বেগম রোকেয়াকে কে পছন্দ করে বাস্তবের সংসারে?
সবই জানেন রুক্সি, বোঝেনও। তবু এসব করেই তিনি মজা লুটে বেড়ান এ সংসারে। ছোটবেলা থেকে চলতি প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অন্যকে ঘায়েল করায় দারুণ মজা পান তিনি। সেজন্য অনেকেই ওকে দেখতে পারে না। হয়তো শত্রু ভাবে। রুক্সি এসব তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নিজের আনন্দে মজে থাকেন।
এভাবে বাপের বাড়ির সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করে তিনি হামলে পড়েন আর্ট-কলেজের একদা বন্ধুদের উপর। কোন উদ্দেশ্য নেই, কোন তাড়াও নেই। শুধু খুঁজে খুঁজে তিনি সব পুরনোদের বের করে তাদের সঙ্গে দেখা করেন।
ইদানীং ওর মনে এক অদ্ভুত ইচ্ছে জেগেছে। ঠিক ইচ্ছেও নয়। লিউ টলস্টয়ের গল্পের মতন এক প্রশ্ন, কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ভেতর কে বেশি সুখি? আলমগীর, সাব্বির, সুলতানা নাকি সে নিজে? নিজের জগতে এ পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত কে সুখ ও স্বস্তি নিয়ে বেঁচে রয়েছে জানার ইচ্ছে জাগে মনে।
ঢাকায় পা রাখার পর প্রথমেই যার নাম মনে পড়ে যায় সে অবশ্যই অধ্যাপক আলমগীর। ডাক নাম রুকু। আদি ঢাকাইয়া। ওর চেহারায় একটা হারামিপনা রয়েছে। হারামিপনা? আদর করে ওকে বরং বুনো রুকু বলাটাই মানায় ভালো। সবকিছু নিয়ে তিনি মন্ড বানাতে
জানেন, হেসে উড়িয়ে দিতে জানেন কঠিন সব সমস্যা আর ঠাট্টা-মশকরা আর শ্লেষ মিশিয়ে সব সম্পর্ককেই গ্যাসের বেলুন বানিয়ে
আকাশে উড়িয়ে দিতে পারেন। ওর আঁকার হাতও সেরকম। সুন্দরী নারী সেখানে কুঞ্চুরির মুখ করে বসে থাকে। পুরুষ আর বাঁদরের মুখ মিলেমিশে থাকে ওর ক্যানভাসে। সবুজ প্রকৃতির ভেতর লুকিয়ে থাকে ড্রাগনের গনগনে মুখ। নিষ্ঠুরতা আর নম্রতা, সৌন্দর্য ও বিকৃতি আলিঙ্গন করে শুয়ে থাকে ওর আঁকাজোকায়।
রুক্সি ওকে রিং দেয় আমি এখন ঢাকায়।’
কথা শেষ হবার আগেই চিল্লিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে রুকু, এক্ষুণি চলে আসছি। তোপখানার সেই হোটেলটা তো? জিনিস রাখিস কিন্তু। আমি তন্দুরি চিকেন নিয়ে আসছি সঙ্গে করে।’ প্রতিবার এভাবেই প্রকাশ করে নিজেকে।
খুব হল্লা জমে আলমগীরের সঙ্গে। এক পর্যায়ে হাত জোড় করে আলমগীর বলে ওঠে, ‘একটা কথা কমু?’
‘ক না। একটা ক্যালা, পঞ্চাশটা কইয়া ফেলা।’
‘কথাটা মিছা না। আমি লুকিয়ে তোর স্তন ঠিকই দেখতাম। নেশার মতো হয়ে গেছিল সেটা। দেখার ওই আনন্দটা এখন আর খুঁইজ্যা পাই না রে। কসম। ‘বলে সোফা থেকে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। পুরনো নিষিদ্ধ স্মৃতি নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকেন।
‘ক্যান, তোর বউ কুসুমীরটা দেখস না?’
‘ওইটা তো বাস্তব। হাতের কাছের আমপাতা জামপাতা। মজা নাই। অহন তো ওই সময়ও নাই। অহন আমি গাছপাথর। খালি ভাইবা মজা লই। ‘বলে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করে দেন তিনি।
রুক্সি পুরুষ মানুষের এরকম কান্নায় খুব অভ্যন্ত। ওর দুই নম্বর স্বামী ভারতীয় হোটেল ব্যবসায়ী এস. মাথুর এভাবে কান্না করত। হুলো বেড়ালের মতো চেহারা ছিল তার। সহজে মেয়েরা ওর কাছে ঘেঁষতে চাইত না। পটাপটি তো দূর কি বাত। তবু এসব কান্নাকাটির কারিগরি কৌশল খাটিয়েই রুক্সির মন জয় করে নিয়েছিল। আগের মাড়োয়ারি বউর অবহেলা-অত্যাচারের করুণ গল্প শুনিয়ে কিভাবে যেন ওকে পটিয়ে ফেললো। আসলে মাথুরের উপর রাগ করতে পারতেন না তিনি। রেগে গেলে ওকে খুশি করার জন্য গিফটের বন্যায় ভাসিয়ে দিত। শুধু একটাই দোষ ছিল, প্রচণ্ড ছেলেপ্রীতি। বিয়ের অনেকদিন পর রুক্সি সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। সেজন্যই ওকে ডিভোর্স দিতে হল।
আলমগীরের দিকে তাকিয়ে রুক্সির পুরনো স্বামীর কথা মনে পড়ে যায়। আসলে কাউকে করুণা করতে শুরু হলে তার সঙ্গে আর যাই হোক, এক ছাদের নিচে বসবাস করা যায় না। খুবই দুর্বিসহ লাগে।
রুক্সি আচমকা বলে ওঠেন, আমাকে নিয়ে কুসুমীর কাছে যাবি এখন? একটু দেখা করে আসতাম। বক্সিবাজারের ভিলা টাইপের তোদের বাড়িটা খুব টানে আমায়। চল যাই? শাদি-শুদা মানুষ তুই, আমার লগে কি?’
সঙ্গে সঙ্গে আলমগীর গম্ভীর হয়ে গেলেন। বিস্ফারিত চোখ নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন ওর দিকে। গ্লাসে চুমুক দেন ঘনঘন। তারপর বলে ওঠেন, সম্ভব না দোস্তো। সম্ভব না।’
‘কেনো?’
‘কুসুমি অহন আগের মতন নাই। আমার থেইক্যা আগ্রহ তার কাইট্টা গেছে। অহন হে আল্লা-মাবুদ, খানাদানা আর পোলা-মাইয়া নাতিপুতির তত্ত্বতালাশ লইয়া আছে। আমারে লইয়া ভাবনের সময় কই?’
‘তাতে আমার কি?’
‘সেজন্যই সম্ভব না। সম্ভব না।’
কথা শুনে রুক্সির মাথা গরম হতে শুরু করে। ফের সে প্রশ্ন করেন, কেনো?’
‘সেটা বলা সম্ভব না।’ বলেই তিনি বসা থেকে উঠে হনহন করে বাইরে বেরিয়ে যায়। আর ফিরে আসেননি। ঢাকায় আরও কদিন ছিলেন রুক্সি। কিন্তু আলমগীর আর ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। টেলিফোন করলেও তিনি কেটে দিয়েছেন। পরে অবশ্য টরেন্টোতে ফিরে আসার পর ওর সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়েছে কয়েককবার। কিন্তু সেই প্রাণটা আর নেই। কেমন শীতল হয়ে পড়েছে ওদের সম্পর্কটি।
সাব্বিরকেও রিং দিয়েছেন রুক্সি। আর্ট কলেজের আরেক দোস্ত ওর। ফোনটা পেয়ে তিনি ফিসফিস করে বললেন, আমি রিং ব্যাক দিচ্ছি। মিটিং নিয়ে ব্যস্ত দোস্ত।’
কিন্তু সেই রিং আর ফেরত আসে না। ভীষণ রাগ হচ্ছিলো তখন রুক্সির। ওদের সঙ্গে দেখা করবেন বলে ছুটে এসেছেন এদেশে আর ওরা এখন মিটিংএর দোহাই দিচ্ছেন? ‘শালা বানচোত’ বলে একটা গালি দিয়ে ওঠেন আপনমনে।
বিকালের পর সাব্বিরের রিং এল। রুক্সির একবার মনে হল ফোনটা ধরবে না। কিন্তু না ধরেই বা উপায় কি? ঢাকা এখন ওর কাছে বিদেশ-বিভুঁই। স্রেফ কৌতূহলের খপ্পরে পড়ে বারবার ছুটে চলে আসেন তিনি। হোটেলে বসে বসে কি করবেন সারাদিন? যাদের খবর নিতে এসেছেন, তারাই যদি দেখা না দেয়, তো একা-একা বেরিয়ে পড়ে কোথায় যাবেন রুক্সি?
অগত্যা তীব্র জেদে ফোনটা ধরে বলে উঠলেন, ব্যাটা হারামি, আমি সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে হোটেলে বসে আছি আর তুমি বালের মিটিং মারাও বানচোত?’ ঢেলে দেন ভেতরকার যত উম্মা। পুরুষদের গালিগালাজের এই স্টাইলটা তিনি ওদের থেকেই রপ্ত করে নিয়েছেন। পুরুষদের ঘায়েল করতে চাইলে ওদেরই মতন করে রুখে দাঁড়াতে হয়। নইলে দমতে চায় না সহজে।
‘সরি ফ্রেন্ড। আমি রাস্তায়। আধ ঘণ্টার ভেতর চলে আসতেছি। আলমগীর বলেছে তুই এসে গেছিস। আমার চকোলেট আনছিস তো?’ সাব্বির মদ্যপান কিংবা সিগারেট কোনটাতেই আসক্ত নন। একেবারে সাত্ত্বিক তিনি। তিনি মজে রয়েছেন সংসারে বউ আর একামাত্র মেয়ে তনিমা ওর কাছে সব। প্রচুর টাকা পয়সা। সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে আপৎকালে বিদেশ থেকে চাউল-ডাল এনে মুনাফা করা ওর মূল বাণিজ্য। রুক্সির ধারণা, আর্ট কলেজে যাঁরা ওর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁদের ভেতর সবচেয়ে সুখি মানুষ এই সাব্বির। সেভাবেই ওকে মেপে এসেছেন এদ্দিন।
কিন্তু ভুল ভাঙলো যখন সাব্বির চকোলেট না খেয়ে পেগের পর পেগ হুইস্কি মারতে শুরু করে দেয় ওর হোটেল কক্ষে এসে।
‘কি ব্যাপার। টেলিফোনে বললি পর্যন্ত চকোলেট রাখতে। আর এখন ফ্রিজ থেকে বোতল নিয়ে নিজেই বসে গেলি?’
সাব্বির কিছু বললেন না। চুপচাপ চুমুক দিতে থাকেন গ্লাসে। রুক্সি রীতিমতো বিস্মিত ও বিরক্ত। কেউ তার নিজের চরিত্র থেকে অন্যত্র সরে এলে ওর খুব রাগ হয়। রুক্সির কাছে সাব্বির হল একজন সুখি মানুষের নমুনা। অথচ ওর এখন এমন ভাব যে মনে হবে সাব্বির এক অতৃপ্ত আত্মা। রুক্সির ভেতর কৌতূহল ভাতের বলক হয়ে ফুটছে। আসলে ব্যাপারটা কি?
সহসা এসময় কাঁদতে শুরু করে দেন সাব্বির। মনে হচ্ছে সিনেপ্লেক্সে এক সিনেমা দেখতে এসে রুক্সির চোখের সামনে অন্য সিনেমা শুরু হয়ে গেছে।
রুক্সি ভালো করে তাকান সাব্বিরের দিকে। অভিজ্ঞ চোখ খুঁজে ফিরে অজানা তথ্য-উপাত্ত। সহসা চমকে উঠেন তিনি আবিষ্কার করেন সাব্বিরের চেহারার পরতে পরতে একেবারে অন্যকিছুর ছায়া। যা কখনও ভাবেননি, সাব্বির যেন ঠিক ত-ই।
সাব্বির বেঁটেখাটো গাট্টাগোট্টা গড়নের পুরুষ। শিলপাটার মতন ছড়ানো পেশীবহুল মুখমণ্ডল। সেখানে প্রেম-ভালোবাসা বা শিল্পবোধের কোন ছোঁয়া নেই। আগেও এরকম কিছুর অস্তিত্ব ছিল না।
রুক্সি এককালে বলতেন, ‘তুই তো একটা টিয়াপাখিও আঁকতে পারিস না। আর্ট কলেজে ফর্তি হলি কেন?’ সাব্বির কোনকথা না বলে হাসতেন কেবল। কারণ ওর কাছে এর কোন জুৎসই উত্তর জানা ছিল না তখন। কিন্তু সেই শিল্পবোধহীন সাব্বির বাস্তবজীবনে সফল ব্যবসায়ী হবার পর ফোনে প্রায়ই রুক্সিকে জানাতেন,’ জানিস, আমার কারণে এখন অনেক অজানা শিল্পীর আর্ট পীস বিক্রি হয়। গুলশানে আমার তিনটি গ্যালারি, জানিস তুই?’ আত্মগর্বে টসটস করত কণ্ঠ। সেই মানুষটাই রুক্সির চোখের সামনে লোভ, হিংসা আর কেড়ে খাওয়ার ফন্দিফিকির জানা এক পুরুষ! সত্যিকার সুখী মানুষের কি এতগুলো জিহ্বা একসঙ্গে লকলক করে? আর্ট কলেজের পুরনো সাব্বির কি তবে মৃত?
রুক্সির চোখের সামনে সাব্বির। কখনও পেট চেপে ধরে, কখনও গালের দুপাশ দুই হাতের তালু রেখে ভেউ ভেউ করছেন, দেখেশুনে রুক্সির তো বেঢপ মনে হবেই। ভেতরের বিস্ময়বোধ কাটিয়ে বার বার করে রুক্সি শুধু প্রশ্ন করছেন আসলে তোর কী হইছে? এইরকম করছিস কেন? তুই তো সবচেয়ে ক্লিন মানুষ ছিলি আমাদের ভেতর। সহজ সরল অমায়িক ধরন। সুযোগ পেলে হেল্প করিস, ছুটে যাস অন্যের বিপদে। এ কি কম কথা সুখি হওয়ার?’ মুখে এসব বললেও তলে তলে ওর শিকারী দৃষ্টি ঠিকই জিরক্স কপির মতো সাব্বিরকে পরখ করতে থাকে।
‘নারে। তোরা যা ভাবিস আমি তা নই। আমি আর্ট জানি না বলে আর্ট গ্যালারি খুলেছি। নিজের অপারগতা লুকানোর জন্য। আমি ভীষণ লোভী; আমি সুলতানাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রেপ করেছি হলে নিয়ে। তুই জানিস তা? আমি তোকেও হলের রুমে নিতে চেয়েছিলাম। সুযোগ পাইনি।’
‘কি সব বলছিস? মাথা ঠিক আছে? সুলতানাকে তুই ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে রেপ করেছিস? এটা বিশ্বাস করতে হবে আমাকে? তোর মতন সাবমিসিভ একটা পোলা সুলতানার মতন দজ্জাল মেয়েকে গেইথা ফেললি? পাগল?’
‘বিশ্বাস করিস না? করবি কিভাবে? আমার বউ গিনি পর্যন্ত ফালতু বলে উড়িয়ে দেয়। ওর ধারণা, আমি নাকি নিজের শভিনিজম তৃপ্ত করছি তাতে। সাইকোলজির ছাত্রী তো!’
‘আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।’
‘সুলতানাকে ডাকতে পারবি এখন? ডাক? প্রমাণ হয়ে যাবে সামনাসামনি।’
‘ডাকবো?’
‘শিউর। আমার কথা বলবি না। খবদার। আরেকটা কথা। ওর বিয়ের রাতেও ওকে আমি নিতে চেয়েছি। প্রস্তাব শুনে সে আমার দিকে জুতা ছুড়ে মেরেছে।’
‘ব্ল‍্যাকমেলিং? মাই গড! তুই তো একটা বিস্ট। নো নো। তোর বউর ধারণাই ঠিক। তুই এরকম হতেই পারিস না। একটা নিরীহ গোবেচারা ভদ্র আর্ট অনুরক্ত যুবক কিভাবে রেপিস্ট হয়? ইমপসিবল। আমি এক্ষুণি সুলতানাকে ডাকছি।’
উত্তেজনায় রুক্সি একটা ইন্ডিয়ান বিয়ার মেরে দিলেন। তাও ওর চোখ থেকে বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। এর ভেতর তিনি সুলতানাকে রিং দিয়ে বসলেন, তাড়াতাড়ি আয়।’
‘তুই? কোথায়?”
‘তোপখানায়।’
‘কি বলিস?’
‘হ্যা। তুই?’
‘আমি ছোট ছেলের কলেজে।’
‘বিজ্ঞাপনী সংস্থায় যে চাকরি করতি তা কি ছেড়ে দিয়েছিস?’
‘কবে। সংসার আর চাকরি দুটো একসঙ্গে রাখা মুশকিল। আর এখন বায়োজিদের তো ম্যালা ইনকাম। রিয়েল এস্টেট কোম্পানিটা তো ও দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। এনিওয়ে, কোথায় আসবো?’
‘এসএমএস করছি, চলে আয়।’
‘শোন বেশিক্ষণ বসতে পারবো না রে। ছেলেকে কলেজে রেখে এসেছি। ছুটি হবার আগে ফিরতে হবে।’
‘আয় না।’
ঘণ্টাখানেকের ভেতর চলে এলেন সুলতানা। ওর ভালো নাম নার্গিস সুলতানা। অসম্ভব প্রাণবন্ত আর গল্পপ্রিয় মানুষ তিনি। যেখানে-সেখানে যখন-তখন গল্প তৈরি করতে ওস্তাদ। ‘জানিস, পার্কের যে পাগলটা আছে না, মজনু না কি নাম, বস্তা আর ছাল-বাকল পরে হাঁটে, ওই বেটা কিন্তু ছ্যাকা কেইস। জানিস মহিলা কে?’ সবাই কৌতূহল নিয়ে হয়তো তাকালেন ওর দিকে। তিনি তখন ভাব নেবেন। আঙুল দিয়ে চুলের জট খুলবেন, মাথায় হাত বুলাবেন। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কাটানোর পর ফিক করে হেসে হয়তো বলে উঠবেন যুঁই
ম্যাডাম।’ যুঁই ম্যাডাম হলেন ওদের কলেজের সবচাইতে সুন্দরী মোহময়ী শিক্ষিকা। যখন করিডোর দিয়ে হেঁটে যান তখন জুঁই ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে দেন চারপাশে। পিছন থেকে সাব্বির মুঠোর ভেতর বাতাস কয়েদ করে বলে ওঠেন,’ জুঁই ম্যাডাম। আহা!’ সেই ম্যাডামের সঙ্গে পার্কের পাগলের সম্পর্ক?
এ নিয়ে কল্পনা-জল্পনা করেই সময় কেটে যেতো ওদের। তখন থেকে পাগলের দাম বেড়ে গেল। না চাইতেই পাগলকে ওরা সাহায্য করতে থাকেন। একজন অরেকজনকে লুকিয়ে রোজ ভালো-ভালো খাবার-দাবার দেন। সোহা নামের এক ধনীর কন্যা ছিলেন ওদের ক্লাসমেট, শুনে সে-ও তোয়াজ করতে থাকেন পাগলকে। রুক্সি শুনেছেন, সে নাকি মালিবাগের নতুন হওয়া আড়ং থেকে কিনে পাঞ্জাবি উপহার দিয়েছিলেন পাগলাকে।
অনেক পরে সুলতানা ফিকফিক করে হেসে ওদের বলেছেন,’ গুল মারছিলাম। তোরা তো এসব অবাস্তব খুব খাস। তাই।’ এরকম ঘটনা ওর অনেক রয়েছে। একবার টরেন্টোতে থাকাকালীন রিং দিলেন সুলতানা। কিছুতেই দুজনের ভেতর কথা আর জমছে না। মাথুরকে নিয়ে রুক্সির ভীষণ মন খারাপ। হাতিটাকে সামাল দিতে পারছে না সে। রীতিমতো হতাশায় ভুগছেন। সহসা সুলতানা বলে উঠলেন,’ দোন্তো, একটা কথা শুনছিস?’
‘কি?’
‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফ নাকি আমাদের নায়িকা ববিতার প্রেমে পড়েছিলেন একসময়? চিঠিগুলো নাকি এখনও যত্ন করে রেখেছেন ববিতা, জানিস?’
এবার না হেসে উপায় নেই। মিথ্যা জেনেও এ বিষয় নিয়ে ওদের কথা বাড়তে থাকে। রুক্সি জানালেন, ‘তুই জানিস না ববিতা আপারে কী প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো পারভেজ মোশারফের পক্ষ থেকে? জানিস?’
সুলতনা আকাশ থেকে পড়ার মেকি ভান করে উত্তর দেন’ কি?’
‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীত্ব?’
‘ববিতা আপু কি উত্তর দিলেন?’
‘রাজি হলেন না। বললেন আমার কাছে নায়ক ফারুক নায়ক জাফর ইকবালই স্বপ্নের পুরুষ। কোন জেনারেল নয়। আমি যেমন আছি তেমনই ভালো। তেমনই থাকতে চাই। হিহিহি।
শুরু হলো কথার পিঠে কথা। সব ভুলে গিয়ে কথার ফোয়ারায় মগ্ন হওয়া। এ যে কখন শেষ হবে তা কেউ বলতে পারবেন না।
সেই সুলতানা রুক্সির তোপখানার হেটেল কক্ষে। রুমে পা দিয়ে সাব্বিরকে দেখে তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন, ওমা, সাব্বির যে। সে এসব কি গিলছে? জীবনভর ভালমানুষ সেজে থাকার এ কি দশা?’
‘তোকে নাকি সাব্বির হলের রুমে ভুলিয়ে ভালিয়ে রেপ করেছিলো?’ কোন রাখঢাক নেই। সহজ-সরল তীক্ষ্ণ প্রশ্নের তীর। এভাবে কেবল বন্ধুকেই প্রশ্ন করা যায়। স্বামী-সন্তান, মাবাবা, ভাইবোন, আত্মীয়-পরিজন আর কাউকেই নয়। সাব্বির সোফার সঙ্গে হেলান দিয়ে রয়েছে। হাতে গ্লাস। মাথা নিচু, গলার টাইটার নট ঢিলা, ঢলঢল করছে মরা সাপের মতন বুক আর ভাতের ডেকচির মতন দেখতে পেটের উপর।
সুলতানা রুক্সির দিকে তাকালেন একঝলক। মোটেই চমকালেন না। একটু বাদে হৈ-হৈ হাসিতে ঘর কাঁপিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। সাব্বিরের আনত মুখ তুলে মেয়েলি এক হাসি দিয়ে সুলতানা আচমকা বলে ওঠেন, ‘কিরে, আমারে রেপ করার খুব শখ তোর? রুক্সির বড় বড় ব্রেস্ট দেখে খুশি হোসনি? তোদের যৌনতাবোধের প্রথম উনুন তো আমরাই। নাকি?’
‘তাহলে পুরোটাই বানানো? সাব্বির?’ চোখ পাকান রুক্সি।
সাব্বির এবার মদালস নত মুখখানা কিঞ্চিৎ তুলে ওদের দিকে দৃষ্টি তাক করেন। বিমর্ষ বদনে আক্ষেপের সুরে বলেন,’ এ জীবনে এ শখ আর কোনদিন পূরণ হবে না জানি। আর সুলতানার মতন এরকম চৌকশ তাগড়া মেয়েকে আমার মতন পাঁচফুট চার ইঞ্চির পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব? তুই বিশ্বাস করলি?’ সাব্বিরের মাথা ফের নুয়ে পড়ে পেটের উপর। নেশা পুরো ধরে গেছে।
রুক্সি ফের আকাশ থেকে পড়লেন। ওর সব হিসাব-নিকেশ ব্যর্থ। এলোমেলো হয়ে পড়ছে সবকিছু। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে , এই ঘৃণাবর্তের ভেতর তিনি কেবল পাঁক খেতে থাকেন। একসময় রুক্সি হেসে ওঠেন জোরে, শালা সাব্বিরের বাচ্চা, বানচোত ধর্ষকামী। মনে মনে এ কাজ বহুবার তুই করেছিস, না? বল সত্যি কিনা?’
সাব্বির কোন উত্তর দেন না। তিনি গ্লাসে চুমুক দেন আর মাথা নুয়ে মুচকি হাসেন। এ আচরণে দুজনই বুঝে নেন সাব্বিরের মনের কথা। টরেন্টো ফেরার পর সুলতানার সঙ্গে নিয়মিত কথা চলে রুক্সির। উল্টা-পাল্টা নানা বিষয় আর কিছু হাহা-হোহো। সহসা একদিন পুরনো প্রসঙ্গটা ভিডিও-আড্ডার বিষয় হয়ে ফিরে এল। স্মৃতিচারণ করার ভঙ্গিতে রুক্সি হালকা সুরে বললেন,’ তোরা পারিসও বটে। এমন সিরিয়াস করে এসব কথা কেউ বলতে পারে একমাত্র তসলিমা নাসরিন ছাড়া?’
ওপাশে কয়েক সেকেণ্ড নীরবতা। হঠাৎ সুলতানা বলে ওঠেন, কে বলেছে সাব্বির আমায় রেপ করেনি? করেছিলো তো? মাত্র দুবার। কিন্তু ও আমার হাজবেন্ড বায়োজিতের চাইতে বেটার। বায়োজিত আরও নিষ্ঠুর, আরও নির্লিপ্ত। সপ্তাহে দুবার নিয়ম করে নির্দয়ভাবে রেপ করে আমাকে। আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা ভালো-মন্দ কোনকিছুই ওর বিবেচনায় থাকে না। তাই এগুলো বলার মতন কোন বিষয় বলেই মনে হয় না আজকাল। তাই ওরে মাফ করে দিছি। মনে রাখিস রুক্সি, যতই লেখাপড়া করি না কেন, এগুলো মেনে নিয়েই, হজম করেই মেয়েদের চলতে হয়। আমরা এর ব্যতিক্রম নই। বাদ দে তো। পারভেজ মোশারফের খবর রাখিস?’ জোর করে হেসে ওঠেন সুলতানা।
‘না তো?’ রুক্সির কণ্ঠ থেকে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না।
‘ও বিরল রোগে উননব্বই বছর বয়সে নির্বাসিত হয়ে মারা গেছেন দুবাই শহরে। অনেকে বলে পাকিস্তানের জনগণের দুর্দশার জন্য আইয়ূব খান, জিয়াউল হকের মতন তিনিও সমানভাবে দায়ি। অন্তিম সময়ে বেচারার শেষ ইচ্ছা কি ছিল জানিস?’ মিথ্যে যে এমন সাজিয়ে-গুছিয়ে বলা যায় তা সুলতানার কথা না শুনলে বোঝা মুশকিল।
রুক্সিও অধীর আগ্রহের ভান করে জিজ্ঞাসা করেন, ‘না তো? ব্যাপারটা কি?’
‘তাও জানিস না? বৃথা তোর লেখাপড়া, বৃথা তোর ঝকঝকে টরেন্টো-জীবন।’ হায়-হায় করে কৃত্রিম ঢেউ তোলেন কণ্ঠে। পাল্টাপাল্টি হিসাবে রুক্সির জিহ্বা আফসোসের শব্দ করে।
‘কি? পরিষ্কার করে বলবি তো?’
‘শোন তাহলে। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে কবরী আপার ঠোঁটে ‘আমি তোমার বন্ধু, তুমি আমার স্বামী’ গানটা শুনতে চেয়েছিলেন এককালের মহা বিক্রমশালী রাষ্ট্রনায়ক পারভেজ মোশারফ। শুনেছি, ইয়ুটিউবে গানটা শুনে শুনে নাকি তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বেচারা!!’ ফের হাসির রোল সুলতানার গলায়।
‘তুই খবরটা কই পাইলি, এ্যা? ফাজিল কোথাকার!’
‘কেন, বদহাওয়াডটকমে। তোর চোখে পড়েনি? টরেন্টো শহরে ভালো চাকরি করিস বলে কিছুই দেখবি না?’ উত্তরটা যেন প্রস্তুত ছিল, ঝটপট বলে দেন সুলতানা। ডুবোচরের মতন বাঁধভাঙা হাসির উচ্ছ্বাস আড়ালে। রুক্সি ঠিকই টের পান।
‘তুই একটা খচ্চর।’ বলে এবার রুক্সিও হাসতে থাকেন। দুই বান্ধবীর হাসির যৌথ মহড়া থামতেই চায় না মোবাইলের এপার-ওপারে।
হাসতে হাসতে উভয়ই একসময় একেবারে ভুলে যান, জীবন বড় নিষ্ঠুর।