০২:৫৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

মায়া সভ্যতার ইতিহাস (পর্ব-৫৩)

  • Sarakhon Report
  • ০৬:০০:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০২৪
  • 4

সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়

মায়াসমাজে কাগজ তৈরির বিশেষ পদ্ধতি

মায়া-সভ্যতার অন্যতম লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হল কাগজ তৈরি। কাগজ তৈরির এই পদ্ধতি-কৌশল সবটাই নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধিপ্রসূত। এখানে ডুমুর গাছের ছাল নানা স্তরে শুকিয়ে এবং অন্যান্য কৌশলে কাগজ তৈরি করা হয়। কাগজ তৈরির ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রধান স্তর হল এরকম: প্রথমত ডুমুর গাছের ডাল (লম্বায় ৫ ফুট এবং ব্যাস ১ ইঞ্চি) কাটা হয়। এরপর গাছের ডালগুলি ছাঁটা হয় এবং নির্দিষ্ট আকারে বা লম্বায় আলাদা আলাদা করে রাখা হয়। তৃতীয় স্তরটিতে এই ডালের বাইরের ছাল ছাড়ানো হয় এবং জলের মধ্যে রেখে শুকনো করা হয়। এরপর অপ্রয়োজনীয় আঁশগুলো জমিয়ে তা ছাড়িয়ে নেওয়া হয়।এরপরে চতুর্থ স্তরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এই স্তরে গাছের ছালের সুতোর মত পাতলা জিনিসগুলোকে জল দিয়ে ধোওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াটি অনেকটা ভুট্টার শাঁশকে গুড়ো করলে যা অবস্থা হয় কিছুটা তার মত। তবে এই কাগজ তৈরির সঙ্গে একটি লোকাচারও যুক্ত আছে। বলা হয় এই কাগজ তৈরির অধিকার কেবল অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত এবং সচ্ছল সদস্যর ছিল। ক্লাসিক-উত্তর যুগে ইউকাতান অঞ্চলে শিল্পী, কারিগর, মায়া-সমাজের উঁচু জমিদার সদস্য হতেন। এই শিক্ষিত কারিগরের অঙ্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান থাকত।

মায়াসমাজে সামাজিক মর্যাদার স্তরবিন্যাস: প্রাচীন মায়া-সমাজে ছিল সামাজিক মর্যাদার চারটি ভাগ। এই চারটি স্তর ছিল এরকম (ক) পুরোহিত, (খ) অভিজাত সম্প্রদায়, (গ) সাধারণ মানুষ এবং (ঘ) দাস সম্প্রদায়।

(ক) পুরোহিততন্ত্র-বিশিষ্ট গবেষক বিশপ লান্ডা ক্লাসিক উত্তর যুগের সামাজিক বিন্যাস প্রসঙ্গে বলেন যে সমাজের প্রধান এবং পুরোহিত পদ প্রধানত ছিল বংশানুক্রমিক এবং তা নির্ধারিত হত অভিজাত সম্প্রদায়ের পরিবার থেকে। এই পুরোহিত, পুরোহিতের ছেলেদের এবং লর্ডদের দ্বিতীয় পুত্রকে শিক্ষাদান করত। এই শিক্ষাদানের প্রথা ছিল পুরোহিততন্ত্রকে ধারাবাহিক বাঁচিয়ে রাখার জন্য। প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষাদান করার মধ্য দিয়ে পুরোহিত-পুত্র এবং লর্ডদের পুত্রদের মধ্যে একটি মানসিকতা গড়ে উঠত পুরোহিতের ছেলে ছাড়াও নিকট আত্মীয়র কেউ পুরোহিতের পদ গ্রহণ করত।

(খ) সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের দ্বিতীয় স্তর হল অভিজাতবর্গ (Nobility) রাজার । অনেক সময় (Halach Uinic) নীচে এই অভিজাতরা নগর ও গ্রামের প্রশাসনিক কর্তা ছিল। এবং এই প্রশাসক কে হবে তা নির্ধারণ করার অধিকার ছিল রাজার। এই নির্বাচন করা হত বংশানুক্রমিক অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। এই অভিজাত শ্রেণির প্রশাসকগণ সাধারণভাবে বংশানুক্রমিকা ফিচারসংক্রান্ত দিক দেখার দায়িত্ব পালন কভার কিন্তু যুদ্ধ বা জরুরী অবস্থার সময় সামরিক বিভাগের সর্বোচ্চ পদাধিকারী শাসনভার গ্রহণ করতেন। আবার অবস্থাভিত্তিক প্রধান তার এলাকার সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণ করত। এক্ষেত্রে সামরিক প্রধান অঞ্চপারোহিত প্রধানের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা ছিল। পুরোহিতের নির্দেশ মত ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা হচ্ছে কিনা বা পোকা-মাকড় ঠিকমত মেরে জমিজমা গুছিয়ে রাখছে কিনা তাও দেখত সামরিক প্রধান।

(গ) সামাজিক শ্রেণিবিভাজনের তৃতীয় স্তর গড়ে তুলেছিল মায়া-সমাজের সাধারণ মানুষ বা চাষী সম্প্রদায়। কৃষকরা চাষবাস করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরিমাণে পশুপালনের কাজও করত। আবার অন্য তথ্যও বলছে এই কৃষক সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ বড় বড় বাড়ি, প্রাসাদ, মন্দির গড়ার কাজেও সাহায্য করত। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করার জন্য যখন যেমন প্রয়োজন হত তাই করত। কিন্তু লক্ষ্যণীয় দিক হল সমাজের এই নিরীহ শ্রেণিদেরও অঞ্চলের প্রধান, পুরোহিতদের নানাভাবে সন্তুষ্ট রাখতে হত। কখনো কখনো নানারকম দান, উপঢৌকন দিতেও হত। নৈবেদ্য বা ভোগদানের মধ্যে থাকত শাক-সবজি, সুতির কাপড়, লবণ, পাখি বা কুকুরের মাংস। এছাড়া থাকত মধু, মোম এবং ধূপধূনা জাতীয় নানা সুগন্ধী।

(ঘ) সামাজিক বিন্যাসের শেষ স্তরটি গড়ে তুলেছিল দাস সম্প্রদায়ের মানুষ। মনে করা হয় ক্লাসিক উত্তর সময়েই মায়াপান অঞ্চলের কোকম (Cocom) শাসকরাই এই বিভাজনটির সূত্রপাত করেছিল। আবার এই দাস সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল জেলবন্দী অপরাধীরা। বিশেষত যাদের দেবতাদের কাছে উৎসর্গ করা হয়নি। দাসদের মায়া- সমাজে অন্য একটি নামেও ডাকা হত। সেই শব্দটি হল পেনতারব (Phentarob)। তবে এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে দাস চিহ্নিত করার মাপকাঠি কি ছিল। সাধারণভাবে জন্মসূত্র ছাড়া চুরি করার দায়ে শাস্তিপ্রাপ্তরা, জেলে বন্দী হলে বা অপরাধ করার দায়ে জেল খাটলে, হঠাৎ বা কোনো কারণে পিতৃমাতৃহীন হলে বা কোনোভাবে বাণিজ্যিক শর্তে কেনাবেচা হলে সেই ব্যক্তি দাস-এর দীনহীন অবস্থার শিকার হন। সবচেয়ে দেখের কথা হল যারা পিতৃমাতৃহীন অভাগা তাদের কেউ কিনে নিয়ে বা অপহরণ করে দেবতার উদ্দেশ্যে দান করত। এক্ষেত্রে এই দাস যদি ছোটছেলে হত তাহলে তার দাম পাঁচ থেকে দশ পাথর হত। আবার এদের মধ্যে যারা ধনী লর্ডদের বাড়িতে থাকত তাদেরই সাধারণভাবে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হত।

(চলবে)

মায়া সভ্যতার ইতিহাস (পর্ব-৫২)

মায়া সভ্যতার ইতিহাস (পর্ব-৫২)

 

মায়া সভ্যতার ইতিহাস (পর্ব-৫৩)

০৬:০০:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০২৪

সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়

মায়াসমাজে কাগজ তৈরির বিশেষ পদ্ধতি

মায়া-সভ্যতার অন্যতম লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হল কাগজ তৈরি। কাগজ তৈরির এই পদ্ধতি-কৌশল সবটাই নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধিপ্রসূত। এখানে ডুমুর গাছের ছাল নানা স্তরে শুকিয়ে এবং অন্যান্য কৌশলে কাগজ তৈরি করা হয়। কাগজ তৈরির ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রধান স্তর হল এরকম: প্রথমত ডুমুর গাছের ডাল (লম্বায় ৫ ফুট এবং ব্যাস ১ ইঞ্চি) কাটা হয়। এরপর গাছের ডালগুলি ছাঁটা হয় এবং নির্দিষ্ট আকারে বা লম্বায় আলাদা আলাদা করে রাখা হয়। তৃতীয় স্তরটিতে এই ডালের বাইরের ছাল ছাড়ানো হয় এবং জলের মধ্যে রেখে শুকনো করা হয়। এরপর অপ্রয়োজনীয় আঁশগুলো জমিয়ে তা ছাড়িয়ে নেওয়া হয়।এরপরে চতুর্থ স্তরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এই স্তরে গাছের ছালের সুতোর মত পাতলা জিনিসগুলোকে জল দিয়ে ধোওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াটি অনেকটা ভুট্টার শাঁশকে গুড়ো করলে যা অবস্থা হয় কিছুটা তার মত। তবে এই কাগজ তৈরির সঙ্গে একটি লোকাচারও যুক্ত আছে। বলা হয় এই কাগজ তৈরির অধিকার কেবল অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত এবং সচ্ছল সদস্যর ছিল। ক্লাসিক-উত্তর যুগে ইউকাতান অঞ্চলে শিল্পী, কারিগর, মায়া-সমাজের উঁচু জমিদার সদস্য হতেন। এই শিক্ষিত কারিগরের অঙ্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান থাকত।

মায়াসমাজে সামাজিক মর্যাদার স্তরবিন্যাস: প্রাচীন মায়া-সমাজে ছিল সামাজিক মর্যাদার চারটি ভাগ। এই চারটি স্তর ছিল এরকম (ক) পুরোহিত, (খ) অভিজাত সম্প্রদায়, (গ) সাধারণ মানুষ এবং (ঘ) দাস সম্প্রদায়।

(ক) পুরোহিততন্ত্র-বিশিষ্ট গবেষক বিশপ লান্ডা ক্লাসিক উত্তর যুগের সামাজিক বিন্যাস প্রসঙ্গে বলেন যে সমাজের প্রধান এবং পুরোহিত পদ প্রধানত ছিল বংশানুক্রমিক এবং তা নির্ধারিত হত অভিজাত সম্প্রদায়ের পরিবার থেকে। এই পুরোহিত, পুরোহিতের ছেলেদের এবং লর্ডদের দ্বিতীয় পুত্রকে শিক্ষাদান করত। এই শিক্ষাদানের প্রথা ছিল পুরোহিততন্ত্রকে ধারাবাহিক বাঁচিয়ে রাখার জন্য। প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষাদান করার মধ্য দিয়ে পুরোহিত-পুত্র এবং লর্ডদের পুত্রদের মধ্যে একটি মানসিকতা গড়ে উঠত পুরোহিতের ছেলে ছাড়াও নিকট আত্মীয়র কেউ পুরোহিতের পদ গ্রহণ করত।

(খ) সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের দ্বিতীয় স্তর হল অভিজাতবর্গ (Nobility) রাজার । অনেক সময় (Halach Uinic) নীচে এই অভিজাতরা নগর ও গ্রামের প্রশাসনিক কর্তা ছিল। এবং এই প্রশাসক কে হবে তা নির্ধারণ করার অধিকার ছিল রাজার। এই নির্বাচন করা হত বংশানুক্রমিক অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। এই অভিজাত শ্রেণির প্রশাসকগণ সাধারণভাবে বংশানুক্রমিকা ফিচারসংক্রান্ত দিক দেখার দায়িত্ব পালন কভার কিন্তু যুদ্ধ বা জরুরী অবস্থার সময় সামরিক বিভাগের সর্বোচ্চ পদাধিকারী শাসনভার গ্রহণ করতেন। আবার অবস্থাভিত্তিক প্রধান তার এলাকার সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণ করত। এক্ষেত্রে সামরিক প্রধান অঞ্চপারোহিত প্রধানের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা ছিল। পুরোহিতের নির্দেশ মত ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা হচ্ছে কিনা বা পোকা-মাকড় ঠিকমত মেরে জমিজমা গুছিয়ে রাখছে কিনা তাও দেখত সামরিক প্রধান।

(গ) সামাজিক শ্রেণিবিভাজনের তৃতীয় স্তর গড়ে তুলেছিল মায়া-সমাজের সাধারণ মানুষ বা চাষী সম্প্রদায়। কৃষকরা চাষবাস করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরিমাণে পশুপালনের কাজও করত। আবার অন্য তথ্যও বলছে এই কৃষক সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ বড় বড় বাড়ি, প্রাসাদ, মন্দির গড়ার কাজেও সাহায্য করত। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করার জন্য যখন যেমন প্রয়োজন হত তাই করত। কিন্তু লক্ষ্যণীয় দিক হল সমাজের এই নিরীহ শ্রেণিদেরও অঞ্চলের প্রধান, পুরোহিতদের নানাভাবে সন্তুষ্ট রাখতে হত। কখনো কখনো নানারকম দান, উপঢৌকন দিতেও হত। নৈবেদ্য বা ভোগদানের মধ্যে থাকত শাক-সবজি, সুতির কাপড়, লবণ, পাখি বা কুকুরের মাংস। এছাড়া থাকত মধু, মোম এবং ধূপধূনা জাতীয় নানা সুগন্ধী।

(ঘ) সামাজিক বিন্যাসের শেষ স্তরটি গড়ে তুলেছিল দাস সম্প্রদায়ের মানুষ। মনে করা হয় ক্লাসিক উত্তর সময়েই মায়াপান অঞ্চলের কোকম (Cocom) শাসকরাই এই বিভাজনটির সূত্রপাত করেছিল। আবার এই দাস সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল জেলবন্দী অপরাধীরা। বিশেষত যাদের দেবতাদের কাছে উৎসর্গ করা হয়নি। দাসদের মায়া- সমাজে অন্য একটি নামেও ডাকা হত। সেই শব্দটি হল পেনতারব (Phentarob)। তবে এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে দাস চিহ্নিত করার মাপকাঠি কি ছিল। সাধারণভাবে জন্মসূত্র ছাড়া চুরি করার দায়ে শাস্তিপ্রাপ্তরা, জেলে বন্দী হলে বা অপরাধ করার দায়ে জেল খাটলে, হঠাৎ বা কোনো কারণে পিতৃমাতৃহীন হলে বা কোনোভাবে বাণিজ্যিক শর্তে কেনাবেচা হলে সেই ব্যক্তি দাস-এর দীনহীন অবস্থার শিকার হন। সবচেয়ে দেখের কথা হল যারা পিতৃমাতৃহীন অভাগা তাদের কেউ কিনে নিয়ে বা অপহরণ করে দেবতার উদ্দেশ্যে দান করত। এক্ষেত্রে এই দাস যদি ছোটছেলে হত তাহলে তার দাম পাঁচ থেকে দশ পাথর হত। আবার এদের মধ্যে যারা ধনী লর্ডদের বাড়িতে থাকত তাদেরই সাধারণভাবে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হত।

(চলবে)

মায়া সভ্যতার ইতিহাস (পর্ব-৫২)

মায়া সভ্যতার ইতিহাস (পর্ব-৫২)