আবু ইসহাক
ছোট এক শহরের ছোট বাড়ি। সেই বাড়ির উত্তর দিকের দেয়ালের ফোঁকরে থাকত এক জোড়া চড়ুই পাখি। একদিন কুড়িয়ে খেতে মাঠে গিয়েছিল ওরা। হঠাৎ কেমন অদ্ভুত শব্দ শুনে ওরা সচকিত হয়ে ওঠে। মাথা তুলে একে অন্যের দিকে তাকায়।
দূর থেকে বোঁ-বোঁ শব্দ ভেসে আসছে।
চড়ুই দুটো ভয় পায়। ফুডুৎ করে ওরা গাছের ডালে গিয়ে বসে।
শব্দ ক্রমেই বাড়ছে। চারদিকের পাখি-পাখালি ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে। চড়ুই পাখি দুটো পাতার ফাঁক দিয়ে উকি মারে। দূর-দিগন্ত থেকে প্রকাণ্ড একটা কি এদিকেই উড়ে আছে। ভয়ে ওরা ঘন পাতার ভিতর লুকিয়ে পড়ে। ভয়ঙ্কর বোঁ-বোঁ আওয়াজ করতে করতে ওদের মাথার ওপর দিয়েই ওটা চলে যায়।
বুক দুরু দুরু দুটোরই। কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে চড়ুই ওর সঙ্গিনীকে বলে, চিনতে পেরেছ তো?
-উ-ই।
-আরে! বাবা তো এটার কেচ্ছাই শুনিয়েছিল একদিন, মনে নেই?
-অহ্ হো, মহাপতঙ্গ?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা-ই।
চড়ুই পাখি দুটোর শিশুকালের কথা। পুরাতন এক বাড়ির দেয়ালের ফোকরে ছিল ওদের মা-বাবার নীড়। মা-বাবার ডানার মধ্যে মুখ লুকিয়ে ওরা তখন রাক্ষণ-খোক্কস আর দেও-দুরাচারের কেচ্চা শুনত। ছোঁ-রাক্ষস, ম্যাও-খোক্কস, কুণ্ডলী-ফোঁসফোঁস ও কা- ভক্ষুসের কথাই বলত মা-বাবা। কারণ এগুলোই ওদের প্রধান শত্রু।
এক অন্ধকার রাত্রে মা ছোঁ-রাক্ষসের গল্প বলছিল, ‘ছোঁ-রাক্ষস আমাদেরই মতো পাখাওয়ালা আকাশচারী জীব। ওদের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ম। ওরা মাটির দিকে চোখ রেখে আকাশে ভেসে বেড়ায়। সুযোগ পেলে চোখের পলকে ছোঁ মেরে বাঁকা নখে বিধিয়ে ধরে নিয়ে যায়। তারপর গাছে বসে ঠোকর মেরে মেরে চোখ খায়, বুক খায়, কলজে খায়।’ ছানা দুটো ভয়ে ওদের মার ডানার মধ্যে মুখ লুকায়। জোছনা উঠলে ওদের ভয় কমে। তখন নর-ছানাটা শুধায়,-আচ্ছা মা, সবচেয়ে বড় পাখি কোন্টা? -তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর। উনি দেখেছেন। বলো নাগো, সেই বড় পাখির গল্পটা।
-হ্যাঁ, বলছি। অনেক আগে। আমরা তখন ছিলাম অনাবৃষ্টির দেশে। তোদের মা ডিমে তা দিচ্ছিল। আমি গিয়েছিলাম কুড়িয়ে খেতে। হঠাৎ শুনি বিকট শব্দ। চেয়ে দেখি অতি প্রকাণ্ড এক পাখি বোঁ-বোঁ আওয়াজ তুলে উড়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে অনেক দূর দিয়ে-আকাশ যেখানে গাছের মাথায় ঠেকেছে সেখান দিয়ে। এত বড় বিরাট পাখি আর কখনো দেখিনি।
-এটা কি ছোঁ-রাক্ষসের মতো ছোঁ মারে? মাদী-ছানাটা রীতিমতো কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
-তা তো দেখিনি, মা। ঐ একদিনই দেখেছি ওটা।
-ওটা দেখতে কেমন, বাবা? নর-ছানাটা জিজ্ঞেস করে।
-ওটা দেখতে? ইতস্তত করে চড়ুই, হ্যাঁ, ওটা দেখতে অনেকটা ফড়িং-এর মতো। লেজ-লম্বা-ফড়িং দেখছিস তো? ঐ যে, বৃষ্টির দিন একটা মেরে এনে তোদের খাইয়েছিলাম।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখেছি। দুটো ছানাই বলে।
-সেই ফড়িং-এর মতো পাখা আর লম্বা লেজ। সে এক মহা-1-1 পতঙ্গ। কত বড় না দেখলে বোঝা যাবে না। বোঁ-বোঁ শব্দ করে উড়ে বেড়ায়।
পিতার বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। আজকের এ আকাশচারী জীবটা মহাপতঙ্গ না হয়ে যায় না।
পক্ষীরাজ্য ভীত-সন্ত্রস্ত। এরকম পাখি এর আগে কেউ কখনো দেখিনি এ দেশে। গাছে গাছে পাখিদের জরুরী সভা বসে।
এক পাখি বলে, ভয়ের কোন কারণ নেই। আমার মনে হয় এটা শস্যভোজী।
মাংসভোজী রাক্ষস নয়।
প্রতিবাদ করে অন্য পাখি বলে, না, না, এটা নিশ্চয় রাক্ষস পাখি। রাগের চোটে কেমন বোঁ-বোঁ করছিল।
আর এক পাখি সমর্থন করে বলে, ঠিকই, এটা রাক্ষস পাখিই। তর্জন-গর্জন শুনেও বুঝতে পারো না তোমরা? এটা খপাখপ ধরবে আর টপাটপ গিলবে। যদি বাঁচতে চাও তবে এ দেশে ছেড়ে পালাও।
পালিয়ে যায় অনেক পাখিই। বেশির ভাগ যায় অনাবৃষ্টির দেশে।
চড়ুই পাখি দুটো কিন্তু দেশ ছাড়ে না। কারণ ঘনবৃষ্টির দেশে ঝড়-বৃষ্টিতে কষ্ট হলেও পেট পুরে খেতে পাওয়া যায়। তাছাড়া এ মহাপতঙ্গ অনাবৃষ্টির দেশেও দেখা গিয়েছে। ওদের জনক স্বচক্ষে দেখেই গল্প বলেছিল।
চড়ুই-দম্পতি তুলো, পালক, শুকনো খড় ঠোঁটে করে ফোকরে এনে জমা করে। সাজিয়ে গুজিয়ে সেখানে নীড় রচনা করে। বাড়ির বাসিন্দা দো-পেয়ে দৈত্য ওদের দেখে খুশী হয়। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ডেকে বলে, লক্ষণ শুভ। ঐ দ্যাখো, চড়ুই পাখি বাসা বাঁধছে। এগুলো ভালো দেখে আসে, মন্দ দেখে চলে যায়। এ বছরটা সুখে-শান্তিতে কাটবে।
কিন্তু সুখে-শান্তিতে কাটে না। বন্যায় দেশ ডুবে যায়। দিন দিন পানি বাড়তে থাকে। বাড়ির মালিক দো-পেয়ে দৈত্য এবং আরো অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যায়। যারা যেতে পারে না তারা প্রাণের দায়ে বাড়ির ছাদে, ঘরের চালে, গাছের ডালে উঠে হা- হুতাশ করে। চড়ুই পাখি দুটোরও দুর্দশার অন্ত নেই। ওদের প্রতিবেশী চড়ুই পাখিগুলোর অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কিন্তু ওদের পালাবার উপায় নেই। বাসায় রয়েছে কলজের টুকরো দুটো কচি ছানা। ওদের ফেলে তো আর যাওয়া যায় না।
এমন দুঃসময়ে বোঁ-বোঁ আওয়াজ তুলে আসে এক মহাপতঙ্গ। চড়ুই দুটো উঁচু গাছের ডালে ঘন পাতার আড়ালে বসে চেয়ে দেখে। মহাপতঙ্গটা কয়েক পাক ঘুরে একটা জলা মাঠে নামে।
দো-পেয়ে দৈত্যরা হৈ-চৈ শুরু করে দেয়। মহাপতঙ্গটা সাঁতার কেটে একটা বড় বাড়ির ছাদের সিঁড়ির কাছে গিয়ে থামে। কী অবাক কাণ্ড! একটা দো-পেয়ে দৈত্য মহাপতঙ্গের পেট থেকে বেরিয়ে আসে। তার আহ্বানে এক-এক করে একপাল দো- পেয়ে দৈত্য মহাপতঙ্গের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ওটা একা বোঁ-বোঁ ডাক দিতে আকাশে ওঠে। দু’পাক ঘুরে সোজা সূর্যান্তের দিকে উড়ে চলে যায়।
ঐ দিন আরো কয়েকবার মহাপতঙ্গ আসে। বাড়ির ছাদে, ঘরের চালে, গাছের ডালে ছিল যে সব দো-পেয়ে দৈত্য তাদের পেটে পুরে কোথায় উধাও হয়ে যায়।
চড়ুই পাখির দুটো বিস্ময়ের সীমা নেই। রাত্রে বাসায় বসে স্ত্রী চড়ুই বলে, দো-পেয়ে দৈত্যরা তো যেমন তেমন টেটন নয়।
-হ্যাঁ, জগৎ টেটন। পুং চড়ুই বলে-ওরা মহাপতঙ্গকেও দেখছি পোষ মানিয়েছে।
-সত্যি, ওদের বুদ্ধি-কৌশলের তারিফ করতে হয়।
-কেন, মা? বুকের তলা থেকে নর-ছানাটা জিজ্ঞেস করে। -হ্যাঁ রে, হ্যাঁ। বড় হয়ে যখন বাইরে যাব তখন দেখতে পাবি। হাম্বা-হাবা, ভ্যাঁ-
ভোম্বল, ঘেঁউ-পা-চাটা, কুউত্তুরুত, প্যাঁক-চৈচৈ, ম্যাও-খোক্কস, শুস্তধর, চিহি টগবগ আরো কত জীব-জানোয়ারকে যে ওরা পোষ মানিয়েছে তার উয়াত্তা নেই। -এই হাম্বা-হাবার অবস্থা দেখে আমার হাসিও পায় দুঃখও লাগে। পুং চড়ুই বলে, বেচারাকে নানান কাজে খাটিয়ে তো মারেই। উপরন্তু, ওর পেটের নিচের ঝুলে-পড়া চামড়া টেনে টিপে সাদা রস বের করে দো-পেয়ে দৈত্যরা নিজেদের গলা ভিজায়।
স্ত্রী-চড়ুই হেসে বলে, আবার দ্যাখো, বিরাটকায় শুণ্ডধর, চিহি টগবগ। ওদের পিঠে চড়ে কেমন মনের সুখে ঘুরে বেড়ায়।
-এতেও সাধ মেটেনি। এবার মহাপতঙ্গের পেটের মধ্যে জায়গা করেছে। দল বেঁধে ওর পেটের মধ্যে বসে এখন মহানন্দে আকাশে পাড়ি জমাতে শুরু করেছে।
স্ত্রী চড়ুই বলে, এবার দো-পেয়ে দৈত্যরা কিন্তু ভারি বিপদে পড়েছিল। মহাপতঙ্গকে পোষ মানিয়েছিল তাই রক্ষা।
কিছুদিন পরে পানি শুকিয়ে যায়। দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল যেসব দো-পেয়ে দৈত্য তারা দেশে ফিরে আসে। কিন্তু দেশে খাবার নেই। ক্ষেতের ফসল ভেসে গেছে বন্যায়। চারদিকে হাহাকার। চড়ুই পাখি দুটোরও দুর্দশার অন্ত নেই। বন্যার সময়ে দো-পেয়ে দৈত্যরা বাড়ির ছাদে যেসব খাদ্য-শস্য ফেলে গিয়েছিল তা-ই কাড়াকাড়ি করে খেয়ে এতদিন চলেছে। কিন্তু এখন দুটো ঘাসের দানাও কুঁড়িয়ে পাওয়া যায় না। এই দুর্দিনে আবার পেটে দুরস্ত ক্ষুধা নিয়ে দুটো নতুন ঠোঁটের আবির্ভাব হয়েছে। ক্ষুধার জ্বালায় সেগুলো খালি ট্যাও ট্যাও করে। বাসায় ঢুকবার সাথে সাথে ঠোঁট ফাঁক করে এগিয়ে আসে-আ-আ-দে-দে-দে। চড়ুই পাখি দুটো মাঠে মাঠে খাবার সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। এমন দিনে আবার শব্দ শোনা যায়, বোঁ-বোঁ-বোঁ- মহাপতঙ্গ এসে মাঠে নামে। দো-পেয়ে দৈত্যরা তার পেট থেকে বস্তা বস্তা কি সব নামিয়ে নেয়। এটা উড়ে চলে গেলে আর একটা মহাপতঙ্গ আসে। তারপর আরেকটা আরো কয়েকটা। সবগুলোই বস্তা বস্তা কি সব দিয়ে চলে যায়। চড়ুই দুটোর কৌতূহল জাগে। ফুডুৎ ফুডুৎ লাফ দিয়ে দিয়ে ওরা এগিয়ে যায়। কাছাকাছি গিয়ে দেখে ওদের স্বজাতি কয়েকটা গিয়ে হাজির হয়েছে ওখানে। খুঁটে খুঁটে কি যেন খাচ্ছে।
ফুডুৎ করে উড়ে ওরাও চুটে যায়।
কি আশ্চর্য। খাবার দিয়ে গেছে মহাপতঙ্গ! ক্ষুধার খাবার। আনন্দ! কি আনন্দ!! বস্তা ঝরে পড়েছে কত খাবার।
দুটোতে ঠেসে পেট পুরে খায়। বাসায় ফিরে বাচ্চা দুটোকে খাওয়ায়। আঃ কি শাস্তি! অনেক দিন পরে আজ চড়ুই-দম্পতি খোশ-মেজাজে গল্প করে। গল্প ঠিক নয়। দো- পেয়ে দৈত্যের গুণকীর্তন।
পুং চড়ুই বলে, দো-পেয়ে দৈত্য সমস্ত দুঃখ-অশান্তি দূর করতে পারে। ওরা ইচ্ছে করলে আরও সুন্দর করতে পারে পৃথিবীকে।
-হ্যাঁ, তা পারে। ওরা যদি করে পণ, করে দুঃখ বিমোচন।
স্ত্রী চড়ুইটা কৃতজ্ঞতায় গানই জুড়ে দেয়। ওর সঙ্গীও যোগ দেয় সে গানে। ছানা দুটো মুগ্ধ হয়ে শোনে।
মহাপতঙ্গ যে খাদ্য-শস্য দিয়ে যায়, সেগুলো দো-পেয়ে দৈত্যদের ঘরে ঘরে আসে। দেয়ালের ফোকরে আবার চড়ুই-দম্পতির সুখের ঘরকান্না চলে। স্ত্রী-চড়ুই জোড়া জোড়া ডিম পাড়ে। দুটিতে পালা করে তা দেয়। জোড়া জোড়া বাচ্চা ফোটে। সারাদিন ধরে শস্য-কণা কীট-পতঙ্গ কুড়িয়ে এনে বাচ্চাদের ঠোঁটে ঠোঁটে ঢুকিয়ে খাওয়ায়। ওরা বড় হয়ে ওঠে। ওদের কাছে ছোঁ-রাক্ষস, ম্যাও-খোক্কস, কুণ্ডলী-ফোঁসফোঁস ও কা-ভক্ষুসের কেচ্ছা বলে। এ সব রাক্ষস-খোক্কস ও দেও-দুরাচারের কেচ্ছা শুনে বাচ্চাগুলো মুষড়ে পড়ে। তখন ওরা সুন্দর পৃথিবীর গল্প শুরু করে দেয়। রঙ-রূপ-রসের বৈচিত্র্যে অপরূপ এ পৃথিবী। চন্দ্র-সূর্যের কর্তব্যনিষ্ঠায় আলোকোজ্জল এ পৃথিবী। পানি আর বাতাসের প্রাচুর্যে প্রাণবন্ত এ পৃথিবী। ফুল-ফল-শস্যের সম্ভারে সমৃদ্ধ এ পৃথিবী। দুঃখের তুলনায় অনেক সুখ এখানে। গল্পে গল্পে দো-পেয়ে দৈত্যের প্রসঙ্গ এসে যায়। এদের বুদ্ধি, কৌশল ও গুণ-হেকমতের অনেক গল্প চলে। তারপর চলে মহাপতঙ্গের গল্প। বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময় কত মহান কাজ করছে এগুলো।
এভাবে দিন যায়। মাস পেরোয়। বছর ঘোরে। একদিন ভোর বেলা। উর্দু উদ্ধ বাচ্চা ফুটোকে খেলার ছলে আত্মরক্ষার নানা কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছিল পাখি দুটো। হঠাৎ স্ত্রী চড়ুই বলে ওঠে,ঐ যে শব্দ। মহাপতঙ্গ আসছে।
হ্যাঁ, তাই তো। মহাপতঙ্গই আসছে। পুং চড়ুই বলে,-এবার আবার কি নিয়ে নিশ্চয়ই ভালো খাবার-টাবার নিয়ে এসেছে। চলে, না দেখে আসি। এলো?
-আমরাও যাব, মা? ছানা দুটো আবদার করে।
না রে, না। তোরা এখনো ভালো করে উড়তে পারিসনে। আমরা গিয়ে দেখে আসি। -আমাদের ভয় করবে যে। মাদী-চানাটা বলে।
-ভয়। দিনে-দুপুরে কিসের আবার ভয়।
-ম্যাও-খোক্কস আসে যদি?
-দুও বোকা। ম্যাও-খোক্কস এ দেয়াল বেয়ে উঠতেই পারবে না।
উঁহু, কুণ্ডলী-ফোঁসফোঁসও এ খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠতে পারবে না। তোরা বড় হয়ে এরকম জায়গা বেছে নিয়ে বাসা বাঁধবি। এ রকম জায়গায় যদি আসে তো কা- ভক্ষুস আসূতে পারে।
কা-ভক্ষুস!
বাচ্চা দুটো ভয়ে শিউরে ওঠে। ওদের মা বুঝতে পেরে বলে, থাক গো, আমি ওদের কাছে থাকি। তুমিই গিয়ে দেখে এসো।
-আচ্ছা, তুমি থাক ওদের নিয়ে। আমিই গিয়ে দেখে আসি। মহাপতঙ্গ খাবার নিয়ে এলে তোমাদের জন্যে টোটলা ভরে নিয়ে আসব। পুং চড়ুই ঢেউয়ের তালে নাচতে নাচতে উড়ে যায়।
মহাপতঙ্গ ঠিকই। আর এসেছে একটা নয়। একজোড়া নয়। পাঁচ জোড়া। চড়ুই খুব খুশী হয়। অনেক খাবার নিয়ে এসেছে নিশ্চয়। চোঁ-ও করে একটা মহাপতঙ্গ নেমে যায় অনেক নিচে।
একি! ছোঁ মারবে নাকি? না, ঐ তো ওপর দিকে উঠছে আবার। কিন্তু ওটার পেট থেকে পড়ছে কী ও?
চড়ুই ভাবে, নিশ্চয়ই ডিম। বারে বা, বড় পাখির বড় রঙ আণ্ডা পাড়ার দ্যাখো ঢঙ। বুমমম প্রচণ্ড শব্দে মূর্ছা যায় চড়ুই পাখি। ঘুরতে ঘুরতে সে একটা ঝোপের ওপর পড়ে। বেলা যখন গড়িয়ে যায় তখন তার জ্ঞান ফিরে আসে। কিন্তু শরীরে এতটুকু বল নেই। সে চোখ মেলে। ঝোপের ওপর কাত হয়ে শুয়েই সে মিটমিট করে তাকায় এদিক ওদিক। এ কোথায় সে। কেমন করে সে এলো এখানে, এ ঝোপের ওপর? কি হয়েছিল তার? চড়ুইটি কিছুই মনে করতে পারে না।
অনেকক্ষণ ধরে ঘটনাটা মনে করবার চেষ্টা করে সে। তারপর আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে আর বিস্ময় জাগে। ডিমটা বুঝি ফেটেই গেছে! তাই তো এমন শব্দ। বড় পাখির বড় ডিম। এ রকম শব্দ তো হবেই।-চড়ুই ভাবে। কিন্তু এভাবে ডিম পেড়ে লাভটা কি হল? মাটিতে পড়ে ফেটেই তো গেল। তা দিয়ে দিয়ে বাচ্চা ফোটাতে পারল না আমাদের মতো।
বাচ্চা ফোটানোর কথা ভাবতে গিয়ে নিজের বাচ্চা দুটোর কথা মনে পড়ে যায় তার। বাচ্চা দুটো নিয়ে স্ত্রী সেই সকাল থেকে ওর পথ চেয়ে বসে আছে। ক্ষুধার জ্বালায় কত না জানি কষ্ট পাচ্ছে ওরা। কিন্তু একটা দানাও যে যোগার হয়নি। কি ব্যাপারটাই না ঘটে গেল। ওরা কি শুনতে পেয়েছে ডিম ফাটার শব্দ?
চড়ুই কোন রকমে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। ফুডুৎ করে সে উড়াল দেয়। যেতে যেতে তার মনে হয়-মহাপতঙ্গিনীটার কোন দোষ নেই। প্রসব-বেদনায় টিকতে না পেরে উড়ন্ত অবস্থায়ই পেড়ে ফেলেছে ডিম। পূর্ণগর্ভা পাখিটায় চড়ে উড়তে বেরুনো উচিত হয়নি দো-পেয়ে দৈত্যের।
হঠাৎ নিচে চোখ পড়ে চড়ুই পাখির।
পথ ভুল হল নাকি!-চড়ুই চমকে ওঠে। কোন্ পথে এলো সে? এ রকম দেখাচ্ছে কেন? না, পথ ভুল হবার কথা তো নয়। তালগাছ ডানে রেখে দুই আমগাছের ফাঁক দিয়েই তো এসেছে সে কিন্তু আণ্ডা রঙের উঁচু বাড়িটা কোথা গেল? ঐ দিকে নারকেল গাছটা তো ঠিকই আছে।
চড়ুই উড়ে যায় দুইদিকে নিশানা ঠিক রেখে। কিন্তু সব নিশানা পাওয়া যাচ্ছে না। ঐ যে তেঁতুল গাছ। কিন্তু ওটার এমন ছিন্ন-ভিন্ন চেহারা কেন? কিছুই ভেবে পায় না চড়ুই। যাকগে, আর একটু গেলেই তাদের কাউন রঙের বাড়িটা। কিন্তু কোথায় সে কাউন রঙের বাড়ি।
চড়ুই পাখির বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে। নিচে চেয়ে দেখে ধ্বংসস্তূপ। লণ্ডভণ্ড সব। সে চীৎকার করে ওঠে। স্ত্রীর নাম ধরে ডাকে। বাচ্চা দুটোর নাম ধরে ডাকে। কিন্তু সে ডাক ফিরে আসে প্রতিধ্বনি হয়ে।
ইটের স্তূপের ফাঁকে ফাঁকে খোঁজে চড়ুই। কিন্তু কোন চিহ্ন নেই তার স্ত্রী আর বাচ্চা দুটোর। শুধু এক জায়গায় মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বাড়ির বাসিন্দা দো- পেয়ে দৈত্য।
ব্যাথায় ছটফট করে চড়ুই। ডানা ঝাপটায়। ঠোঁট দিয়ে বুকের পালক কাটে। বিলাপ করতে করতে সঙ্গিনী ও ছানা দুটোর কত কথাই না বিনিয়ে বলে যায়।
নিঃসঙ্গ এক চড়ুই পাখিকে প্রায়ই দেখা যায় জানালার ধারে, রেলিং-এর ওপর। ঘৃণার স্বরে সে ডেকে যায়, ছিঃ-ছিঃ-ছি-, ছিঃ-ছিঃ-ছি!
এ ছিঃ-ছি কিসের জন্যে? এ ধিক্কার কাদের জন্যে? এ নিশ্চয় তাদের জন্যে যারা ডিম্ববতী মহাপতঙ্গিনীর পেটে চড়ে উড়ে বেড়ায় আর অশান্তি ডেকে আনে।