কবিগান
একবার আমি আমার চাচার বিবাহের বরযাত্রী হইয়া শ্যামসুন্দরপুর যাই। এই গ্রাম আমাদের বাড়ি হইতে প্রায় সাত মাইল দূরে। পরদিন ভোরে উঠিয়া দূরের কোনো গ্রামে ঢোলের বাদ্য শুনিতে পাইলাম। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম পাঁচচর জমিদারের কাছারিতে কবিগান হইতেছে। সেখান হইতে ঢোলের বাদ্য আসিতেছে। আমি সেই ঢোলের বাদ্য অনুসরণ করিয়া ধীরে ধীরে জমিদারের কাছারির দিকে আগাইয়া যাইতে লাগিলাম। খানিক যাইতেই ঢোলের বাদ্যের সঙ্গে গানের অস্পষ্ট সুরও কানে আসিতে লাগিল। সেই সুর যেন আমাকে স্বপ্নাবিষ্টের মতো কবিগানের আসরের দিকে টানিয়া লইয়া চলিল।
সেখানে দুইদল কবি-গায়কের মধ্যে পাল্লা হইতেছিল। একজন যমের পাঠ লইয়া বলিতেছিল, “আমি যম। আমার প্রতাপ বিশ্বব্যাপী। আমার হাত হইতে কেহ রক্ষা পাইতে পারে না।” তাহার প্রতিপক্ষ কবিয়াল সতীর পাঠ লইয়া বলিতেছিল, “আমার যদি সত্যকার পতিভক্তি থাকে তবে তুমি যম কিছুতেই আমার পতিকে লইয়া যাইতে পারিবে না।” নানা সুরের ধুয়ার সাহায্যে উপস্থিত বোল রচনা করিয়া তাহারা এ-পক্ষে ও-পক্ষে জবাজবি করিতেছিল। কবিয়ালেরা যখন তাল-ছন্দ ঠিক রাখিয়া একটি পদের সঙ্গে অপর পদের মিল দিয়া উপস্থিত বোল তৈরি করিতেছিল, সেই মিলের আনন্দে আমার সর্ব দেহ-মন আলোড়িত হইতেছিল। গান শেষ হইল বেলা একটার সময়। গানের একটি ধুয়া বারবার আবৃত্তি করিতে করিতে আমি বিবাহবাড়িতে ফিরিয়া আসিলাম। তখন দুপুরের খাওয়া শেষ করিয়া বর-কনেকে সঙ্গে লইয়া বরযাত্রীরা দেশে রওয়ানা হইতেছে।
আমি খাইলাম কি না-খাইলাম মনে নাই। বরযাত্রীর দলের কিছুটা পিছে পিছে চলিতে লাগিলাম, আর কবিগানের আসর হইতে শিখিয়া আসা সেই গানের কলিটি জোরে গাহিতে লাগিলাম:
ওহে যম রাজা। তুমি আমারে মন্দ বলো না।
তারে নারে নাইরে নারে, নারে নারে নারে নারে;
নাইরে নারে নারে নারে নাইরে নারে নারে না,
তুমি আমারে মন্দ বলো না।
আঁকাবাঁকা গ্রাম্য পথ দিয়া বর-কনেকে পালকিতে লইয়া বরযাত্রীর আগে আগে দল চলিয়াছে। এ-বাড়ি ও-বাড়ি হইতে বউঝিরা বাহির হইয়া মাথাভরা ঘোমটার ফাঁকে পালকির ভিতরের বর-কনেকে এক নজর দেখিবার বৃথা চেষ্টা করিতেছিল। তাহাদের একঘেয়ে গ্রাম্য-জীবনে এই ঘটনা কি কম বৈচিত্র্যময়? গাছের ডালে দু’একটি পাখি সুমিষ্ট স্বরে গান গাহিতেছিল। সেদিকে আমার কোনোই খেয়াল নাই। আমি শুধু গাহিয়া চলিয়াছি, ওহে যমরাজা। তুমি আমারে মন্দ বলো না।
এ কি সুর। এ কি মাদকতা। ওহে যমরাজা। তুমি আমারে মন্দ বলো না। নারে নারে নাইরে নারে নারে না, নাইরে নারে নারে নারে নাইরে নারে নারে না; তুমি আমারে মন্দ বলো না।
বরযাত্রীরা অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে। এখন আমার আরও স্বাধীনতা। নাচিয়া নাচিয়া কেবল এই সুর গাহিতেছি। এইরূপ গাহিতে গাহিতে সুরের ভিতরে যেখানে নারে নারে করিতেছিলাম সেখানে যা-তা ইচ্ছামতো কথা জুড়িয়া দিয়া ছন্দের পরিমাপ বিষয়ে আমার মনে একটা ধারণা আসিল। তারপর হঠাৎ কথার সঙ্গে কথা আসিয়া কেমন করিয়া যেন একের সঙ্গে অপরের মিল হইয়া গেল। তখন আর আমাকে পায় কে; সারা পথ ইচ্ছামতো উপস্থিত বোল রচনা করিয়া গান গাহিতে লাগিলাম। সে কি আনন্দ। কথার সঙ্গে কথা আসিয়া যখন মিলের বন্ধন পরিতেছে, তাহার তালে তালে আমার বুক নাচিয়া উঠিতেছে।
চলবে…
Sarakhon Report 



















