আবু ইসহাক
পঁয়ত্রিশ বছর পুলিশ বিভাগে চাকরি করে মোহাম্মদ ইলিয়াস অবসরগ্রহণ করেছেন। শুরু করেছিলেন সাব-ইন্সপেকটর হিসেবে, শেষ করেছেন সুপারিনটেনডেন্ট হিসাবে এগারো বছর চাকরি করার পর। এক সামরিক রাষ্ট্রপতির সময়ে বেশ কিছু সেনা অফিসারকে পুলিশ বিভাগে আমদানি না করলে তাঁর আরো একধাপ উপরের পদে পদোন্নতি লাভের খুবই সম্ভাবনা ছিল, কারণ গ্রেডেশান লিস্ট-এ তাঁর নাম ছিল সমসাময়িক অফিসারদের সবার উপরে।
অবসর-জীবনে বিগত চাকরি-জীবনের অনেক কথাই মাঝে মাঝে তাঁর মনের মণিকোঠা থেকে বেরিয়ে উঁকিঝুঁকি মারে, কখনও বেরিয়ে স্মৃতির পরদায় ছবির মতো ভেসে ওঠে।
সারদা পুলিস ট্রেনিং কলেজে দীর্ঘ একবছরের প্রশিক্ষণ। সেখানে যোগদানের পরের দিন। ময়দানের প্যারেড শেষ করে ইলিয়াস অন্যান্য ক্যাডেটদের সাথে নাশতা খাওয়া সেরে নিজের খাটে এসে বসেছে। দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ এক ক্যাডেট তার খাটের পাশে এসেই বলে, ভাই, পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কি আপনার আত্মীয়স্বজন কেউ আছে?
-না তো! একটু বিস্মিত হয়ে বলে ইলিয়াস।
-নিশ্চিয়ই আছে, নইলে আপনি পুলিশে এলেন কী করে। ইলিয়াসের পাশের খাটে তার মুখোমুখি বসে বলে ক্যাডেটটি।
-এলাম ইন্টারভিউ দিয়ে।
-আপনার হাইট কত?
-পাঁচ ফুট সাড়ে চার ইঞ্চি।
-আর বুকের মাপ?
-সাড়ে বত্রিশ ইঞ্চি।
-আপনার হাইট কত, ভাই? ইলিয়াস জিজ্ঞেস করে।
-পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি।
-আর বুকের মাপ?
-সাইত্রিশ ইঞ্চি।
-বাহ্, আপনাকে দেখলে একজন পালোয়ানের মতো মনে হয়। ইলিয়াস বলে।
-আরে আমি তো পালোয়ানই। কলেজে আমি রেসলিং আর ওয়েট-লিফটিংয়ে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। বেশ গর্বের সাথে বলে সে। একটু থেমে সে আবার বলে, আমার মনে হয় কি জানেন, আপনার কোনো আত্মীয় মাপে কারচুপি করে ব্যাক-ডোর দিয়ে আপনাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
-না রে ভাই, আমার লতার লতা পাতার পাতা কেউ পুলিশের চাকরিতে নেই। আর চৌদ্দ গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ পুলিসে চাকরি করে নি।
-আপনার এই শরীর নিয়ে আপনি চোর-ডাকাত ধরতে পারবেন? চোর তো চিবি দিলে আপনার জিভ বেরিয়ে যাবে। আর আমি চিবি দিয়ে চোর-ডাকাতের হাড্ডি-পাঁজরা গুঁড়ো করে দেব। আমার তো মনে হয়, পুলিশে ঢোকা আপনার উচিত হয় নি।
-আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার দুর্ভাগ্য যে আমাকে পুলিসের চাকরিতে ঢুকতে হয়েছে।
-দুর্ভাগ্য কি বলেছেন! আরে সৌভাগ্য বলুন। ভাগ্য ভালো না হলে কি এই শরীর নিয়ে কেউ পুলিশে ঢুকতে পারে?
আইনের ক্লাসে যাওয়ার সময় হয়েছে। ব্যারাকের সব ক্যাডেট তৈরি হচ্ছে আইনের ক্লাসে যাওয়ার জন্য। তাই পালোয়ান ক্যাডেটটির কথায় কান না দিয়ে ইলিয়াস বাক্স খুলে বই-খাতা বের করে ক্লাসে যাওয়ার জন্য। পালোয়ানটিও তাঁর খাটের দিকে চলে যায়। তিন দিন পরের কথা। রাতের রোল-কলের পর ইলিয়াস তার নিজের খাটে বসে পাশের খাটের ক্যাডেটের সাথে কথা বলছিল। আর কিছুক্ষণ পরেই দশটার ঘণ্টা পড়বে। ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে সবাইকে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়তে হবে। এমন সময় এক ক্যাডেট এসে ইলিয়াসকে জিজ্ঞেস করে,- আপনি কোন জেলার থেকে এসেছেন, ভাই?
ইলিয়াস তার জেলার নাম বলে।
-আপনার জেলায় বোধ হয় ভালো ক্যান্ডিডেট ছিল না?
-ক্যান্ডিডেট তো অনেক ছিল।
-ছিল! আমি তো অবাক হয়ে গেছি, আপনার কী এমনটা দেখে আপনাকে সিলেক্ট করেছে! -কী জানি ভাই, আমার কী দেখে কর্তারা পছন্দ করেছেন তা আমি কী করে বলব? যাঁরা সিলেক্ট করেছেন তাঁরাই জানেন।
-আমাদের জেলা থেকে যারা এসেছে তাদের আপনি দেখেছেন?
-দেখেছি তো অনেককেই। কিন্তু কে কোন জেলা থেকে এসেছে তা এখনও জানতে পরিনি।
-আমাদের জেলা থেকে যে কয়জন এসেছে, সবাই এক-এক জন প্রিন্স। দেখবেন, যেমন তারা লম্বা তেমন তাদের স্বাস্থ্য। রাজপুত্রের মতো তাদের চেহারা।
রাত দশটার ঘণ্টা পড়ার দু-একমিনিট বাকি আছে। ‘প্রিন্স’ তার হাতঘড়ি দেখে আর কোনো কথা না বলে তার খাটের দিকে রওনা হয়। ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে সব বাতি নিবে যায়। সবাই যার যার মশারির নিচে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
আইনের প্রথম মাসিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। ইলিয়াস একশ নম্বরের মধ্যে নব্বই পেয়ে প্রথম হয়েছে। তার প্রথম হওয়ার খবরে অনেকে হতবাক হয়ে গেছে। ‘পালোয়ান’ এবং আরো দু’জন পাস করতে পারেনি।
দুপুরে কয়েকজনের সাথে ইলিয়াস দুপুরের খাওয়ার জন্য ‘চৌকা’র দিকে যাচ্ছিল। সে দেখতে পায়, প্রাচীন মেহগিনি গাছটির নিচে তিনজন ক্যাডেট এক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন ‘পালোয়ান’। আইন-পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি বলে তাদের ‘অর্ডারলি রুম’ হয়েছে অর্থাৎ তাদের মার্চ করিয়ে প্রিন্সিপালের কক্ষে নিয়ে যাবেন একজন সুবেদার। তারা কেন পাস করতে পারেনি তার কৈফিয়ত দিতে হবে প্রিন্সিপালের কাছে। প্রিন্সিপাল তাদের সতর্ক করে দেবেন।
ইলিয়াস ‘পালোয়ান’-এর দিকে তাকায়। ‘পালোয়ান’ লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
পরের দুটি মাসিক পরীক্ষায়ও ‘পালোয়ান’ পাস করতে পারেনি। নিয়ম-অনুযায়ী তিন পরীক্ষায় ফেল করলে তাকে অযোগ্যতার জন্য বরখাস্ত করা হয়। ‘পালোয়ান’ বরখাস্ত হয়ে সারদা ছেড়ে চলে গেল। চোর-ডাকাতকে চিবি দিয়ে তাদের হাডিড-পাঁজরা গুঁড়ো করার সুযোগ আর সে পেল না।
পালোয়ানের পর ‘প্রিন্স’-এর ছবি ভেসে উঠল ইলিয়াসের স্মৃতির পর্দায়। চাকরিতে ‘প্রিন্স’-এর অবস্থান দেখবার কৌতূহল হলো তাঁর। বইয়ের তাকে খুঁজে তিনি পুলিশ অফিসারদের গ্রেডেশন লিস্ট অর্থাৎ পর্যায়ক্রমিক তালিকার একটা কপি পেলেন। গ্রেডেশন লিস্টটা তাঁর অবসরগ্রহণের তিন বছর আগেকার। খুঁজতে খুঁজতে তিনি ‘প্রিন্স’- এর নাম পেলেন। ইলিয়াসের নিম্নস্থ একশ আটচল্লিশ জনের পরে তাঁর নাম এবং পদমর্যাদায় তিনি ইলিয়াসের এক স্তর নিচে।
উনমূল্যায়নের আরো একটা ছবি মাঝে মাঝেই ইলিয়াসের স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে। এটাও সারদা পুলিস ট্রেনিং কলেজের ঘটনা। ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ শুরু হয় সারদায় যোগদানের মাসখানেক পরেই। এই প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সবাই কম-বেশি উৎকণ্ঠিত ও ভীত। সারদার ঘোড়াগুলো বেশ তাজা, তেজি আর বড়। কয়েকটা ঘোড়া নামে সুপরিচিত, যেমন-রেভিলি, ব্যান্ড মাস্টার, ফায়ার ফ্লাই। বেশির ভাগ ঘোড়ার নাম নেই। সেগুলো নম্বর দিয়ে পরিচিত। কয়েকটা ঘোড়া নাকি খুব দুষ্ট আর বজ্জাত। সেই ঘোড়াগুলোর নম্বর যোগাড় করে আস্তাবলে গিয়ে সেই ঘোড়াগুলোকে আগেভাগেই চিনে নেওয়ার চেষ্টা করে অনেক ক্যাডেট।
সতেরো জন ক্যাডেটের একটা স্কোয়াড। ক্যাডেটরা সবাই বুট, ব্রিচেজ ও রাইডিং ক্যাপ পরে একসারিতে দাঁড়িয়েছে। হাবিলদার ‘লেফট-রাইট’ করিয়ে স্কোয়াডটিকে নিয়ে যায় রাইডিং স্কুলে। কাঠের উঁচু বৃত্তাকার বেষ্টনীর মধ্যে রাইডিং স্কুল। এই স্কোয়াডটির অশ্বারোহণের প্রশিক্ষণ আজই প্রথম শুরু হচ্ছে। ক্যাডেটদের প্রায় সবারই চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। হাবিলদার কম্যান্ড দিয়ে তাদের একসারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বেষ্টনীর উত্তর পাশে।
রাইডিং মাস্টার একজন সুবেদার। পঞ্চনদীর দেশের লোক। তিনি যেমন লম্বা, তেমনি মোটা। ভুঁড়িটাও বেশ বড়। তিনি ঘোড়ায় চড়ে এলেন। তাঁর শরীরের ভারে ঘোড়ার পিঠ কিছুটা নুইয়ে গেছে বলে মনে হলো ইলিয়াসের। তিনি ঘোড়ায় চড়ে ক্যাডেটদের কাছে আসতেই হাবিলদার হাঁক দেয়, ‘ক্যাডেট আটেনশান। সালিউট!’ রাইডিং মাস্টার ‘স্যাল্যুট’ নিয়ে ক্যাডেটদের ও তাদের পোশাক দেখতে দেখতে ক্যাডেটদের সামনে গিয়ে ঘোড়া নিয়ে দাঁড়ান।
-সাটান্ড অ্যাট ইজ। রাইডিং মাস্টারের কম্যান্ড। এমন বিশালদেহী পুরুষের এমন অস্বাভাবিক সরু মেয়েলি গলা শুনে অবাক হয় ক্যাডেটরা। আর পাঞ্জাবি হাবিলদার- সুবেদারদের মুখে ‘স্ট্যান্ড’কে ‘সাটান্ড’, ‘স্কুল’কে ‘সকুল’, ‘মার্ক টাইম’কে ‘মারাক টাইম’, ‘স্মল বাট’কে ‘সামাল বাট’ ইত্যাদি সারদায় আসার পর থেকেই প্যারেডের মাঠে শুনে শুনে সবার কান অভ্যস্ত হয়ে গেছে বলে রাইডিং মাস্টারের বিকৃত উচ্চারণের কম্যান্ড শুনে কারো হাসির উদ্রেক হয়নি।
রাইডিং মাস্টার ঘোড়ায় চড়ার কিছু উপদেশ দিলেন উর্দু ভাষায়। বেষ্টনীর দক্ষিণ পাশে সতেরোটা ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে সহিসরা।
রাইডিং মাস্টার কম্যান্ড দেন, ক্যাডেট, আটেনশান! বাউট টারান! ডাবল মারাচ। হর ক্যাডেট ভাগকে যাও, এক-এক আদমি এক-এক ঘোড়া পাকড়ো।
ক্যাডেটরা সবাই দৌড়ে গিয়ে যে যেটা সামনে পেয়েছে সে সেটার লাগাম ধরেছে। কোন ঘোড়াটা শান্ত আর কোনটা বজ্জাত সেটা আর কেউ বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়নি। ঘোড়ার পিঠে জিন নেই। পা রেখে ঘোড়ার পিঠে চড়বার জন্য রেকাবও নেই। শুধু কম্বলের গদি বাঁধা আছে সবগুলো ঘোড়ার পিঠে। নতুন আরোহীদের রেকাব দেওয়া হয় না। কারণ পড়ে গেলে রেকাবে পা আটকে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে এ ব্যবস্থা। ক্যাডেটদের মধ্যে পনেরো জন বাঙালি আর দু’জন অবাঙালি। রাইডিং মাস্টার ঘোড়ায় চড়ে সামনে এসে বলেন, আভি দেখা যায়েগা কৌন রোটি খাতা হ্যায় আওর কৌন চাওয়াল খাতা হ্যায়। হাম যব বোলেগা, ইন্ডিংপিন্ডং (ইনডিপেডেন্টলি) মাউন্ট, তোম লোগ ঘোড়েকা পিঠ পর দোহাত রাখ কর কুদকে উঁচা হো কর ডাইনা পায়ের উঠাকে সওয়ার হো যাওগে, সমঝ লিয়া?
-ইয়েস স্যার! সমস্বরে বলে ওঠে সব ক্যাডেট। -ইন্ডিংপিন্ডিং মাউন্ট। রাইডিং মাস্টার কম্যান্ড দেন।
ক্যাডেটদের মধ্যে যারা ইলিয়াসের মতো হালকা-পাতলা তারা প্রথম লাফেই ঘোড়ায় চড়ে বসে। অন্যান্যদের মধ্যে দু’জন বাদে আর সবাই দু-তিনভারের চেষ্টায় চড়তে সমর্থ হয়। যে দু’জন এখনও উঠতে পারেনি তাদের একজন ভাতভোজী বাঙালি আরেকজন রোটি-খানেওয়ালা অবাঙালি। বাঙালিটি অনেক কষ্টে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে। কিন্তু অবাঙালিটি উঠতে পারে না। ঘোড়ার পিঠে বসে সবাই তার প্রাণান্তকর চেষ্টার দৃশ্য দেখছে। ক্রুদ্ধ রাইডিং মাস্টার তাঁর ঘোড়া দাবড়ানোর ছড়ি উঁচিয়ে অবাঙালি ক্যাডেটটির দিকে তেড়ে আসতে আসতে বলছেন, কিয়া তুমনে পায়ের নেহি উঠা সাকতা? ক্যায়সা না-লায়েক আদমি! তোম রোটি নেহি খাতা?
ক্যাডেটটির দুহাত ঘোড়ার পিঠের উপর আর পেট লেগে আছে ঘোড়ার পেটের সাথে। তার পেটে চাপ লাগায় পেটের বাতাস ফস-ফস শব্দ করে পায়ুপথ দিয়ে বেরুচ্ছে। তা শুনে তার পাশের আরোহী ক্যাডেটরা ফিকফিক করে হাসছে।
রাইডিং মাস্টার সরু গলায় গর্জে ওঠেন, হাঁসো মাত! হাঁসো মাত! ঘোড়া পাদা হ্যায়, ঘোড়া পাদা হ্যায়!
রাইডিং মাস্টারের উগ্রমূর্তি দেখে ক্যাডেটদের হাসি বন্ধ হয়ে যায়।
রাইডিং মাস্টারের নির্দেশে এক সহিস তাকে ঠেলে উঁচু করে দেওয়ার পর সে ডান পা উঁচু করে ঘোড়ার চড়তে সক্ষম হয়।
ভাতভোজী বাঙালিদের উনমূল্যায়ন করার একটা প্রবণতা পাকিস্তানীদের মধ্যে আরো অনেকবার লক্ষ করেছেন ইলিয়াস তাঁর চাকরি-জীবনে।
৬৯৯ বড় মগবাজার, ঢাকা মার্চ, ১৯৯৭
Sarakhon Report 



















