রাকিব হাসনাত
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের একটি পর্যালোচনা কমিটি জনপ্রশাসনে প্রায় সাড়ে সাতশো সাবেক কর্মকর্তাকে বিগত সরকারের আমলে ‘বঞ্চিত’ বিবেচনা করে তাদের ‘ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি’ দেয়ার যে সুপারিশ করেছে তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে।
বিশ্লেষকরা কেউ কেউ বলছেন সততা ও দক্ষতা ছিল এমন দল নিরপেক্ষ কর্মকর্তারা যারা গত সরকারের আমলে পদোন্নতি পাননি তাদের বাছাই করে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিতে পারলে সেটি ইতিবাচক হবে।
আবার কেউ বলছেন ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি হলেও যে সময়টুকু তারা কাজ করেননি সে সময়ের জন্য আর্থিক সুবিধা দেয়াটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। পাশাপাশি এ ধরনের সুযোগ একবার দেয়া হলে ভবিষ্যতে এটিকে উদাহরণ নিয়ে নিয়ে অপব্যবহারের সুযোগও তৈরি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা।
গত ১৬ই সেপ্টেম্বর সরকার পদোন্নতি বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আবেদনের জন্য পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছিলো। সেই কমিটিই মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
তবে এ রিপোর্টের বিষয়ে সরকার এখন কী পদক্ষেপ নিবে কিংবা যেসব কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে তারা কি বিগত দিনের আর্থিক সুবিধাও পাবেন কি না তা এখনো নিশ্চিত নয়।
ওই কমিটির প্রধান সাবেক সচিব ড. জাকির আহমেদ খান বলছেন অনেকগুলো বিষয়কে মানদণ্ড হিসেবে নিয়েই তারা তাদের সুপারিশ করেছেন। মি. খান বিশ্বব্যাংকের সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক।
“যারা আবেদন করেছেন তাদের চাকরি জীবনের ভোগান্তি থেকে শুরু করে অনেক কিছু পর্যালোচনা করা হয়েছে। আমরা সব বিচার বিশ্লেষণ করে সুপারিশমালা তৈরি করেছি। এখন সরকার পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে। এমনকি তারা আর্থিক সুবিধা পাবেন কি না সেটিও সরকারের বিষয়,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে মাঝে মধ্যে ভূতাপেক্ষা নিয়োগ বা পদোন্নতির উদাহরণ থাকলেও এতো বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে এ ধরনের পদোন্নতি দেয়া হলে তা হবে নজিরবিহীন ঘটনা। ভূতাপেক্ষা মানে হলো আগে থেকে কার্যকর হওয়া।
তবে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলছেন সৎ, যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা গত আমলে নিয়মানুযায়ী পদোন্নতি পাননি তাদের বাছাই করে ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি দিতে পারলে সেটি প্রশাসনের জন্য ভালো হবে।
অন্যদিকে সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলছেন যারা বঞ্চিত হয়েছেন তাদের বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে কিন্তু এটিও সত্যি যে প্রশাসনে এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। ফলে বিভিন্ন জন বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে সামনে আসছে, যেগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ের একটি ভবন
রিপোর্টে কী বলা হয়েছে
আবেদন পর্যালোচনা কমিটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের রিপোর্ট দেয়ার পর মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সংবাদ সম্মেলনে জানায় যে ওই কমিটি ১৫৪০ জনের কাছ থেকে আবেদন পেয়েছিলো এবং এসব আবেদন যাচাই বাছাই করে তারা তাদের রিপোর্টে ৭৬৪ জনকে ভূতাপেক্ষা সুযোগ সুবিধা নিয়ে পদোন্নতির সুপারিশ করেছেন।
“সচিব থেকে শুরু করে উপসচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা এর মধ্যে রয়েছেন। সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে সরকার এখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে,” ওই সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের চৌঠা অগাস্ট পর্যন্ত ‘বঞ্চিত ও বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া’ সচিব থেকে শুরু করে উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই তালিকায় রয়েছেন।
এর আগে সেপ্টেম্বরে পর্যালোচনা কমিটি গঠনের সময় জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমান বলেছিলেন যে “১৬ বছরের বঞ্চনায় যে সমস্ত কর্মকর্তারা বঞ্চিত ছিলেন, তারা মানসিকভাবে নিপীড়িত হয়েছেন। এরা নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছেন, সামাজিকভাবে, পারিবারিকভাবে, অনেকে আর্থিকভাবে হয়েছেন।”
জানা গেছে, পর্যালোচনা কমিটি যাদের জন্য ভূতাপেক্ষা পদোন্নতির সুপারিশ করেছে তাদের মধ্যে ১১৯ জন সচিব ও ৫২৮ জন অতিরিক্ত সচিব পদের কর্মকর্তারা রয়েছেন।
সচিবালয়ের এই ভবনেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
বঞ্চিত কারা
সরকারের দিক থেকে বলা হয়েছে যে পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সরকার পদক্ষেপ নিবে এবং সে কারণে ধারণা করা হচ্ছে যে ৭৬৪ ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি পাবেন তারা আর্থিক সুবিধা সহ পদোন্নতি পাবেন।
এর মধ্যে যাদের কাজে ফেরত আসার সুযোগ আছে তারা আসবেন, বাকিরা অবসরে থাকবেন।
কোন ধরনের কর্মকর্তারা আবেদন করেছে এবং তাদের বক্তব্য কি ছিল- এটি জানতে সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করেছেন।
যেমন বিসিএস ১১ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে গিয়েছিলেন। তিনি আবেদনে জানিয়েছেন যে তার ব্যাচের মেধা তালিকায় তার নিচে ছিলেন এমন একুশ জন সচিব হয়েছেন। কিন্তু তাকে সচিব করা হয়নি।
আবার যুগ্ম সচিব হিসেবে অবসরে যাওয়া আরেকজন কর্মকর্তা চাকরি জীবনে অন্তত পাঁচবার পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন দাবি করে করে সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতির জন্য আবেদন করেছেন।
এর আগে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে যুগ্ম সচিব পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিলো।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘বঞ্চিত’বিবেচনায় নিয়ে ১১৭ জন কর্মকর্তাকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিলো গত ১৩ই অগাস্ট।
আবার অবসর থেকে ফিরিয়ে এনে অন্তত পাঁচজনকে সিনিয়র সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এরা আগে বিএনপি আমলে সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে প্রশাসনে পরিচিত ছিলেন।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বেশ কিছু কর্মকর্তাকে অবসর থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে
উদ্যোগ কতটা যৌক্তিক
পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আর্থিক সুবিধাসহ ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি দিলে এসব কর্মকর্তাদের জন্য সরকারকে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হবে এবং সেটি কতটা যৌক্তিক হবে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
জানা গেছে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার আগের বিএনপি সরকারের আমলে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত কর্মকর্তারা সুবিধাসহ ভূতাপেক্ষা পদোন্নতির দাবি করলেও তখন সরকার সেটি দিতে রাজি হয়নি। এমনকি পরে তাদের কয়েকজন আদালতে গেলেও সরকারপক্ষ তার বিরোধিতা করেছে।
এবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই সরকারের সময়ে আস্থাভাজন হিসেবে বিবেচনা করে অনেক কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত কিংবা অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
আবু আলম শহীদ খান বলছেন আগে ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি দেয়া হলেও যে সময়টায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা চাকরিতে ছিলেন না সে সময়ের বেতন ভাতা পেতেন না। এবার তা দেয়ার কথা বলা হচ্ছে।
“কিন্তু ধরুন কেউ যুগ্মসচিব হিসেবে অবসরে গেলেন। এখন দশ বছর পর তাকে সচিব করা হলে মাঝে যেই পদে তিনি চাকরি করেননি তার বেনিফিট কীভাবে পাবেন। এগুলো নিশ্চয়ই সরকারকে পর্যালোচনা করতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
মি. খান বলছেন এসব কর্মকর্তারা বঞ্চিত হয়েছেন এটি সত্যি এবং এ বঞ্চনার জন্য দেশের রাজনীতি ও সিস্টেম দায়ী। এ কারণেই কোনো ব্যাচে কেউ বঞ্চিত হয়েছেন আবার কেউ অতিরিক্ত সুবিধা পেয়েছেন।
“কোনো ক্ষেত্রে হয়তো কারও জুনিয়র কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে তার সিনিয়র পজিশনে চলে গেছেন। আবার এটাও সত্যি যে এক ব্যাচের সবাই সচিব হবে না। যারা হবে না তারা সবাই বঞ্চিত তাও নয়। কিন্তু অন্যায় হলে তার প্রতিবিধান করতে হবে,” বলছিলেন তিনি।
এসব চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সুবিধাসহ ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি দেয়ার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া।
“যারা বঞ্চিত হয়েছে তার তো কিছু রাজনৈতিক কারণ আছে। এদের অধিকাংশই ছিল অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ। গত সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেনি। এখন তারা পদোন্নতি পেয়ে ফিরে আসলে ভবিষ্যতের সরকারগুলোর সময়ে লেজুড়বৃত্তি কমবে,” বলছিলেন তিনি।
তার মতে কর্মকর্তারা যদি মনে করে যে সততা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কাজ করে বঞ্চিত হলেও পরে সরকার এর ক্ষতিপূরণ করবে তাহলে পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করার আগ্রহও বাড়বে।
“মনে রাখতে হবে বঞ্চিত হয়ে যারা পদোন্নতি পাননি, চাকরি হারিয়েছেন কিংবা অবসরে যেতে বাধ্য হয়েছে তাদের ও তাদের পরিবারের সামাজিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। মর্যাদা ফিরে পাওয়ার অধিকার তাদের আছে,” বলছিলেন মি. মিয়া।
তবে এ ধরনের সুযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের আবেদনকেই বিবেচনায় নেয়া উচিত হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
“অন্যথায় এটি ক্ষতিকরও হয়ে উঠতে পারে। আগে বিএনপি করেছে বলেই এখন সুবিধা দিতে হবে এমনটি যেন না হয়। পদোন্নতির একমাত্র মাপকাঠি হতে হবে সততা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা,” বলছিলেন ফিরোজ মিয়া।
বিবিসি নিউজ বাংলা