০১:০৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫
চতুর্থ টি-২০ ম্যাচে ৪৮ রানে দাপুটে জয় ভারতের দক্ষিণ লেবাননে নতুন বিমান হামলা চালাল ইসরায়েল কর্ণাটকের ‘পিরিয়ড লিভ’ নীতি: প্রগতিশীল পদক্ষেপ নাকি শুধুই প্রতীকী উদ্যোগ? আফগানিস্তানে মাতৃমৃত্যুর হার বেড়েছে নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতের রাজধানীর ৬০ নটিক্যাল মাইল এলাকাজুড়ে বিমান চলাচলে জিপিএস বিভ্রাট, পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের উদ্বেগ ভারতের কেরালা সাবরিমালা স্বর্ণ আত্মসাত মামলা: আরও এক অভিযুক্ত গ্রেপ্তার আরব আমিরাতে ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে বিপ্লব উপসাগরীয় অঞ্চলে ভারতীয় উদ্যোক্তা ও নেতাদের অসাধারণ অবদান মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে নতুন অধ্যায় গড়ছে জিই অ্যারোস্পেস বিহারের অর্থনৈতিক উন্নতি কি সত্যিই দেশের বাকি অংশের সঙ্গে তাল মিলিয়েছে?

অঙ্গবিহীন বিজয়ী বীর

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০০:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 55

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে ৪ ডিসেম্বর ১৯৮২ সালে এক অস্বাভাবিক শিশুর জন্ম ডাক্তারদের মধ্যে বিস্ময়ের জন্ম দেয়। ছেলেটির কোনো হাত পা নেই। বরং পায়ের জায়গায় ছোট ছোট পায়ের পাতার মতো কিছু বেরিয়ে আছে।

ছেলেটির বাবা বরিস ভোয়সিচ এবং মা ডুসকা ভোয়সিচ কখনো কল্পনা করতে পারেন নি তাদের এমন এক সন্তান হবে। কারণ সন্তান জন্মের আগে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না। ডাক্তাররা এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। কারণ তাদের পরিবারে এমন কোনো ঘটনার রেকর্ড নেই। টেট্রা অ্যামেলিয়া সিনড্রোম নামের এক জটিল সমস্যাকে এর কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ছেলের জন্মের পর সে বেঁচে থাকবে কিনা বা বেঁচে থাকলে কীভাবে পৃথিবীতে টিকে থাকবে সেটাই বাবা মায়ের প্রধান ভাবনা হয়ে দাঁড়ায়। ছেলেটির নাম রাখা হয় নিকোলাস জেমস ভোয়সিচ। ডাক নাম নিক। সবাই তাকে প্রতিবন্ধী সন্তান হিসাবেই বিবেচনা শুরু করে। পৃথিবীর বিশাল চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়ায় নিক। তবে তার মা বাবা তাকে সবচেয়ে সহযোগিতা করেন। নিক শুরুতে স্বাভাবিক স্কুলে যেতে পারেন নি। যদিও তার আই কিউ ছিল আর দশজন শিশুর মতোই। তিনি যখন স্কুলে গেলেন তখন প্রথম বাঁধা পেলেন তার কিছু সহপাঠীর কাছ থেকে। তারা তাকে নানা রকম নিন্দাসূচক ও হাস্যকর কথা বলতে থাকে। তারা বলতো, নিক, তুমি দেখতে খুব অদ্ভুত। কেউ তোমার বন্ধু হতে চাইবে না। তুমি এটা পারো না, ওটা করতে পারো না।’ নিক সে সময়ের অনুভূতি জানিয়ে বলেন, ‘বিষয়টি আমার হাতে ছিল না। এটা এমন না যে আমার আমার এলোমেলা চুল ঠিক করতে হবে, আর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আমার বাস্তবতাকে বদলাতে পারি না। এমন নয় যে, ঘুম থেকে ওঠে বললাম, আমার হাত পা দিয়ে দাও। আর সেগুলো চলে এলো।’ শুধু স্কুলে নয়, প্রায় সবখানেই একই ধরনের কথা শুনতে শুনে নিক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমি ভাবতে শুরু করি, আসলে আমি মোটেও কাজের নই। আমি কখনোই এমন কিছু হতে পারবো না বা করতে পারবো না, যা মানুষ পছন্দ করবে। আমি অন্যদের মতো ফুটবল মাঠে যেতে পারবো না। নিজে কখনো বাইক চালাতে পারবো না। বা এ ধরনের কোনো কাজই আমি করতে পারবো না। এসব ঘটনা আমার মনে গভীর প্রশ্নের জন্ম দেয়, আসলেই কি আমার জীবনের কোনো উদ্দেশ্য আছে? কেন আমার জীবনেই এমনটা ঘটলো তা জানতে বাবা, মা, ডাক্তারদের কাছে প্রশ্ন করলাম। কেউ কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। তারা জানেন না।’

আবেগপ্রবণ হয়ে নিক কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, ‘আপনি কিসে বিশ্বাস করেন? আপনি কি নিজেকে বিশ্বাস করেন? অন্যরা আপনার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন তাই কি আপনি মেনে নেন? যখন অন্যরা বলে তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, তুমি এটা ব্যর্থ মানুষ, তোমাকে কেউ পছন্দ করে না- তখন কি তা মেনে নেন? অনেকেই আপনাকে নিচু করে রাখতে চাইবে। তারা কখনোই প্রকৃত চোখে আপনাকে দেখবে না।’

নিক বলেন, জীবনে এমন অনেক কিছু আমাদের থাকে যা পরিবর্তন করা যায় না। এখন মূল বিষয়টা দাঁড়ায়, আমি কি জীবন থেকে হারিয়ে যাবো নাকি এরই মধ্যে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবো। আমি দ্বিতীয়টি করার সিদ্ধান্ত নিলাম।’ তিনি ধীরে ধীরে তা পায়ের ছোট পাতা দিয়ে লিখতে আরম্ভ করলেন। টাইপ করা, কিছু বাজানো এমনকি শেভ করতে শিখলেন। তিনি কুইন্সল্যান্ড রানকর্ন স্টেট হাই স্কুলে পড়ার সময় সেখানে ক্লাস ক্যাপটেন ছিলেন। স্কুলের স্টুডেন্ট কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন নিক।

নিজের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে নিক নিজেকে তৈরি করতে থাকেন। একই সঙ্গে তার মতো শারীরিক সীমাবদ্ধতার শিকার মানুষের জন্য কিছু কাজ করার উদ্যোগ নিলেন। তিনি দেখলেন তিনি কথা ভুলতে পারেন এবং সেই কথা সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনে। মাত্র সতের বছর বয়সে লাইফ উইদাউট লিম্বস’ নামে একটি সংগঠন করেন এবং আত্ম উন্নয়ন বিষয়ক ও মোটিভেশনাল আলোচনা শুরু করেন। প্রথম দিকে লোকজন তার উপস্থিতিতে বিস্ময় প্রকাশ করলেও তারা তার গুণকে মেনে নিতে শুরু করে। নিজের সীমাবদ্ধতাকে জয় করে একজন মানুষ যে অনন্য হয়ে উঠতে পারে সেটাই তার আলোচনার প্রধান বিষয়। নিক গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসা পরিকল্পনা ও অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে ডাবল ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,

চার্চসহ বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। খ্রীষ্টধর্মে গভীর আস্থাশীল নিক নিজে বিশ্বাস করেন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিই হচ্ছে আসল। এ কারণে তার কোম্পানির নাম রাখেন অ্যাটিটিউট ইজ অ্যালটিটিউট। এই কোম্পানির মাধ্যমে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মোটিভেশনাল বক্তব্য দিয়ে থাকেন। তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে এখন আমেরিকাতে বসবাস করছেন। নিক প্রায় ৬০টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি কয়েক কোটি মানুষের সামনে বক্তব্য রেখেছেন। তার বেশ কিছু বই বেস্ট সেলারের মর্যাদা পেয়েছে। নিকের লেখা বহুল পঠিত বইগুলোর মধ্যে আছে লাইফ উইদাউট লিম্বস, আনস্টপেবল, লিমিটলেস, স্ট্যান্ড স্ট্রং, লাভ উইদাউট লিমিটস। তার বই ত্রিশটিরও বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে এবং দশ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে পৃথিবী জুড়ে। অসংখ্য টিভি শোতে নিক অংশ নিয়েছেন। তিনি মোটিভেশনাল মুভি রিলিজ করেন। এর মধ্যে আছে লাইফ’স গ্রেটার পারপাস, বায়োগ্রাফি অফ এ ডিটারমাইন্ড ম্যান অফ ফেইথ। দি বাটারফ্লাই সার্কাস শর্ট ফিল্মে তিনি অভিনয় করেন। তিনি ২০১২ সালে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে দুই ছেলে আছে। তারা স্বাভাবিক শিশুর মতোই জন্মগ্রহণ করেছে।

বর্তমানে ৩৬ বছর বয়সী নিক নিজেকে তৈরি করেছেন সব কাজের উপযোগী করে। তিনি সাঁতার কাটতে পারেন, সমুদ্রে সার্ফিং করেন, গলফ খেলেন, ফটোগ্রাফি করেন, ফুটবল খেলেন, প্যারাট্রুপারের সঙ্গে শরীর বেঁধে ঝাঁপ দেন আকাশ থেকে, তার জন্য বিশেষ ভাবে নির্মিত হুইল চেয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তিনি বলে থাকেন, যদি ঈশ^র একজন অঙ্গবিহীন মানুষকে ব্যবহার করতে পারেন তাহলে নিশ্চয়ই একটি আন্তরিক হৃদয়কেও তিনি কাজে লাগাতে পারবেন।

নিক ভোয়সিচ-এর কয়েকটি উক্তি সব প্রতিবন্ধকতার সবচেয়ে বড় হলো ভয়। যা হুইলচেয়ারে বসে থাকা মানুষের চেয়েও বেশি প্যারালাইজড করে দেয়।

জীবন হচ্ছে বড় বড় অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ, যদি তা আমরা কাজে লাগাই।

কখনো কি মনে করেন যে আপনি পরিস্থিতির স্বীকার বা ফাঁদে পড়েছেন? তখন আপনি আবিষ্কার করবেন, আসল ফাঁদ হচ্ছে আপনার ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি, সাহসের অভাব অথবা বিকল্প কিছু খুঁজে নিতে না পারার অক্ষমতা।

আমি যদি একশ বার পড়ে যাই, তাহলে একশ বারই চেষ্টা করবো উঠে দাঁড়াতে। যদি আমি পড়ে যাই এবং চেষ্টা ছেড়ে দিই তবে কি আমি কখনো দাঁড়াতে পারবো? না। যদি আমি ব্যর্থ হই, আমি চেষ্টা করে যাবো, আবার এবং আবার। আমি বলতে চাই, এটাই শেষ নয়।

সবচেয়ে বড় পুরস্কার আসে তখনই যখন নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারবেন। এটা হচ্ছে যখন অন্যের জীবনমানকে আপনি বাড়াতে পারবেন। যখন নিজের চেয়ে বড় কিছুর অংশ হতে পারবেন এবং যখন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবেন।

সঠিক পথে ছোট পদক্ষেপ দিয়ে যাত্রা শুরু করুন। পদক্ষেপ কতো ছোট এটা কোনো ব্যাপার নয়, আপনার লক্ষ্যের দিকে অবিচল এগিয়ে চলুন।

হাল ছাড়বেন না। এবং এটা মনে রাখবেন এমন একজন আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন যিনি আপনি যে পথে আছেন তা জেনেই আপনাকে বিশ্বাস করেন এবং ভালোবাসেন।

আমার সামনে বেছে নেয়ার দুটো সুযোগ আছে, যা আমার নেই তার জন্য স্ররষ্টার ওপর অভিমান করা। অথবা আমার যেটুকু আছে তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানো।

যদি কোনো মিরাকলের দেখা না পান, নিজেই মিরাকলে পরিণত হোন।

সঠিক পথ এখন হয়তো আপনি খুঁজে পচ্ছেন না, কিন্তু এটা মনে করবেন না, তা নেই। পথ ঠিকই আছে।

বড় স্বপ্ন দেখুন। কখনো হাল ছাড়বেন না। আমরা সবাই ভুল করি। কিন্তু আমরা ভুল না। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করুন। সত্যকে মেনে চলুন। সব কিছুকে জয় করতে পারবেন।

পরিবর্তনের জন্য আশা করা কোনো কিছু বদল করতে পারে না। কাজ শুরু হলেই সব কিছুকে বদলে দিতে পারে।

পরিস্থিতির ওপর আমাদের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু সে পরিস্থিতিতে আমরা কেমন আচরণ করবো তার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতেই থাকে। যদি আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করি তবে যে চ্যালেঞ্জই আসুক না কেন তা অতিক্রম করতে পারবো।

পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছাড়া আপনি কখনো দাঁড়াতে পারবেন না।

সব সময় এগিয়ে চলুন। কেননা কাজ মোমেন্টাম তৈরি করে। যা অপ্রত্যাশিত সুযোগকে সামনে এনে দেয়।

একজন অঙ্গবিহীন মানুষ যদি বড় স্বপ্ন দেখতে পারে, তবে আমরা সবাই মিলে কেন তা পারবো না?

আমি আশা করি মর্মবেদনায় আক্রান্ত মানুষেরা আমার আনন্দময় জীবন দেখুক। তারা যেন ভাবতে পারে, হাত পা না থেকেও নিক যেমন স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারে, তেমনি আজকের দিনটির জন্য আমি কৃতজ্ঞ হবো এবং আমার সেরা কাজটা দেবো।

ঝুঁকি নিন। ঝুঁকি শুধু জীবনের অংশ নয়, এটাই জীবন। আপনার স্বপ্ন এবং কমফোর্ট জোনের মাঝে এই জীবন অবস্থান করে।

বিশ্বাস করুন, বড় কিছু করার আশা করুন। আপনার জীবন মাপা হবে এর আলোকে কতোটুকু আপনি কাজ করলেন তার ওপর।

জীবনে দুই ধরনের ঝুঁকি আছে। একটি চেষ্টা করার ঝুঁকি অন্যটি চেষ্টা না করার।

যদি আপনি নেতিবাচক চিন্তা পরিহার করতে পারেন এবং অতি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তবে তা ইতিবাচক বাস্তবতার জন্ম দেবে।

যতোক্ষণ আমার আশা জেগে আছে আমি নিজেকে অঙ্গহীন ভাববো না।

একজন মানুষের চরিত্র কোনো আরামপ্রদ অবস্থা বা নীরবে তৈরি হয় না। অভিজ্ঞাতার ভেতর দিয়ে যাওয়া এবং মনের অনেক ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে আমরা শক্তিমান হই, আমাদের মনছবি অনুপ্রাণিত করে এবং আমরা সফল হই।

লেখক  : সাংবাদিক ও গবেষক

জনপ্রিয় সংবাদ

চতুর্থ টি-২০ ম্যাচে ৪৮ রানে দাপুটে জয় ভারতের

অঙ্গবিহীন বিজয়ী বীর

০৮:০০:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে ৪ ডিসেম্বর ১৯৮২ সালে এক অস্বাভাবিক শিশুর জন্ম ডাক্তারদের মধ্যে বিস্ময়ের জন্ম দেয়। ছেলেটির কোনো হাত পা নেই। বরং পায়ের জায়গায় ছোট ছোট পায়ের পাতার মতো কিছু বেরিয়ে আছে।

ছেলেটির বাবা বরিস ভোয়সিচ এবং মা ডুসকা ভোয়সিচ কখনো কল্পনা করতে পারেন নি তাদের এমন এক সন্তান হবে। কারণ সন্তান জন্মের আগে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না। ডাক্তাররা এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। কারণ তাদের পরিবারে এমন কোনো ঘটনার রেকর্ড নেই। টেট্রা অ্যামেলিয়া সিনড্রোম নামের এক জটিল সমস্যাকে এর কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ছেলের জন্মের পর সে বেঁচে থাকবে কিনা বা বেঁচে থাকলে কীভাবে পৃথিবীতে টিকে থাকবে সেটাই বাবা মায়ের প্রধান ভাবনা হয়ে দাঁড়ায়। ছেলেটির নাম রাখা হয় নিকোলাস জেমস ভোয়সিচ। ডাক নাম নিক। সবাই তাকে প্রতিবন্ধী সন্তান হিসাবেই বিবেচনা শুরু করে। পৃথিবীর বিশাল চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়ায় নিক। তবে তার মা বাবা তাকে সবচেয়ে সহযোগিতা করেন। নিক শুরুতে স্বাভাবিক স্কুলে যেতে পারেন নি। যদিও তার আই কিউ ছিল আর দশজন শিশুর মতোই। তিনি যখন স্কুলে গেলেন তখন প্রথম বাঁধা পেলেন তার কিছু সহপাঠীর কাছ থেকে। তারা তাকে নানা রকম নিন্দাসূচক ও হাস্যকর কথা বলতে থাকে। তারা বলতো, নিক, তুমি দেখতে খুব অদ্ভুত। কেউ তোমার বন্ধু হতে চাইবে না। তুমি এটা পারো না, ওটা করতে পারো না।’ নিক সে সময়ের অনুভূতি জানিয়ে বলেন, ‘বিষয়টি আমার হাতে ছিল না। এটা এমন না যে আমার আমার এলোমেলা চুল ঠিক করতে হবে, আর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আমার বাস্তবতাকে বদলাতে পারি না। এমন নয় যে, ঘুম থেকে ওঠে বললাম, আমার হাত পা দিয়ে দাও। আর সেগুলো চলে এলো।’ শুধু স্কুলে নয়, প্রায় সবখানেই একই ধরনের কথা শুনতে শুনে নিক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমি ভাবতে শুরু করি, আসলে আমি মোটেও কাজের নই। আমি কখনোই এমন কিছু হতে পারবো না বা করতে পারবো না, যা মানুষ পছন্দ করবে। আমি অন্যদের মতো ফুটবল মাঠে যেতে পারবো না। নিজে কখনো বাইক চালাতে পারবো না। বা এ ধরনের কোনো কাজই আমি করতে পারবো না। এসব ঘটনা আমার মনে গভীর প্রশ্নের জন্ম দেয়, আসলেই কি আমার জীবনের কোনো উদ্দেশ্য আছে? কেন আমার জীবনেই এমনটা ঘটলো তা জানতে বাবা, মা, ডাক্তারদের কাছে প্রশ্ন করলাম। কেউ কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। তারা জানেন না।’

আবেগপ্রবণ হয়ে নিক কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, ‘আপনি কিসে বিশ্বাস করেন? আপনি কি নিজেকে বিশ্বাস করেন? অন্যরা আপনার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন তাই কি আপনি মেনে নেন? যখন অন্যরা বলে তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, তুমি এটা ব্যর্থ মানুষ, তোমাকে কেউ পছন্দ করে না- তখন কি তা মেনে নেন? অনেকেই আপনাকে নিচু করে রাখতে চাইবে। তারা কখনোই প্রকৃত চোখে আপনাকে দেখবে না।’

নিক বলেন, জীবনে এমন অনেক কিছু আমাদের থাকে যা পরিবর্তন করা যায় না। এখন মূল বিষয়টা দাঁড়ায়, আমি কি জীবন থেকে হারিয়ে যাবো নাকি এরই মধ্যে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবো। আমি দ্বিতীয়টি করার সিদ্ধান্ত নিলাম।’ তিনি ধীরে ধীরে তা পায়ের ছোট পাতা দিয়ে লিখতে আরম্ভ করলেন। টাইপ করা, কিছু বাজানো এমনকি শেভ করতে শিখলেন। তিনি কুইন্সল্যান্ড রানকর্ন স্টেট হাই স্কুলে পড়ার সময় সেখানে ক্লাস ক্যাপটেন ছিলেন। স্কুলের স্টুডেন্ট কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন নিক।

নিজের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে নিক নিজেকে তৈরি করতে থাকেন। একই সঙ্গে তার মতো শারীরিক সীমাবদ্ধতার শিকার মানুষের জন্য কিছু কাজ করার উদ্যোগ নিলেন। তিনি দেখলেন তিনি কথা ভুলতে পারেন এবং সেই কথা সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনে। মাত্র সতের বছর বয়সে লাইফ উইদাউট লিম্বস’ নামে একটি সংগঠন করেন এবং আত্ম উন্নয়ন বিষয়ক ও মোটিভেশনাল আলোচনা শুরু করেন। প্রথম দিকে লোকজন তার উপস্থিতিতে বিস্ময় প্রকাশ করলেও তারা তার গুণকে মেনে নিতে শুরু করে। নিজের সীমাবদ্ধতাকে জয় করে একজন মানুষ যে অনন্য হয়ে উঠতে পারে সেটাই তার আলোচনার প্রধান বিষয়। নিক গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসা পরিকল্পনা ও অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে ডাবল ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,

চার্চসহ বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। খ্রীষ্টধর্মে গভীর আস্থাশীল নিক নিজে বিশ্বাস করেন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিই হচ্ছে আসল। এ কারণে তার কোম্পানির নাম রাখেন অ্যাটিটিউট ইজ অ্যালটিটিউট। এই কোম্পানির মাধ্যমে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মোটিভেশনাল বক্তব্য দিয়ে থাকেন। তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে এখন আমেরিকাতে বসবাস করছেন। নিক প্রায় ৬০টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি কয়েক কোটি মানুষের সামনে বক্তব্য রেখেছেন। তার বেশ কিছু বই বেস্ট সেলারের মর্যাদা পেয়েছে। নিকের লেখা বহুল পঠিত বইগুলোর মধ্যে আছে লাইফ উইদাউট লিম্বস, আনস্টপেবল, লিমিটলেস, স্ট্যান্ড স্ট্রং, লাভ উইদাউট লিমিটস। তার বই ত্রিশটিরও বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে এবং দশ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে পৃথিবী জুড়ে। অসংখ্য টিভি শোতে নিক অংশ নিয়েছেন। তিনি মোটিভেশনাল মুভি রিলিজ করেন। এর মধ্যে আছে লাইফ’স গ্রেটার পারপাস, বায়োগ্রাফি অফ এ ডিটারমাইন্ড ম্যান অফ ফেইথ। দি বাটারফ্লাই সার্কাস শর্ট ফিল্মে তিনি অভিনয় করেন। তিনি ২০১২ সালে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে দুই ছেলে আছে। তারা স্বাভাবিক শিশুর মতোই জন্মগ্রহণ করেছে।

বর্তমানে ৩৬ বছর বয়সী নিক নিজেকে তৈরি করেছেন সব কাজের উপযোগী করে। তিনি সাঁতার কাটতে পারেন, সমুদ্রে সার্ফিং করেন, গলফ খেলেন, ফটোগ্রাফি করেন, ফুটবল খেলেন, প্যারাট্রুপারের সঙ্গে শরীর বেঁধে ঝাঁপ দেন আকাশ থেকে, তার জন্য বিশেষ ভাবে নির্মিত হুইল চেয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তিনি বলে থাকেন, যদি ঈশ^র একজন অঙ্গবিহীন মানুষকে ব্যবহার করতে পারেন তাহলে নিশ্চয়ই একটি আন্তরিক হৃদয়কেও তিনি কাজে লাগাতে পারবেন।

নিক ভোয়সিচ-এর কয়েকটি উক্তি সব প্রতিবন্ধকতার সবচেয়ে বড় হলো ভয়। যা হুইলচেয়ারে বসে থাকা মানুষের চেয়েও বেশি প্যারালাইজড করে দেয়।

জীবন হচ্ছে বড় বড় অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ, যদি তা আমরা কাজে লাগাই।

কখনো কি মনে করেন যে আপনি পরিস্থিতির স্বীকার বা ফাঁদে পড়েছেন? তখন আপনি আবিষ্কার করবেন, আসল ফাঁদ হচ্ছে আপনার ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি, সাহসের অভাব অথবা বিকল্প কিছু খুঁজে নিতে না পারার অক্ষমতা।

আমি যদি একশ বার পড়ে যাই, তাহলে একশ বারই চেষ্টা করবো উঠে দাঁড়াতে। যদি আমি পড়ে যাই এবং চেষ্টা ছেড়ে দিই তবে কি আমি কখনো দাঁড়াতে পারবো? না। যদি আমি ব্যর্থ হই, আমি চেষ্টা করে যাবো, আবার এবং আবার। আমি বলতে চাই, এটাই শেষ নয়।

সবচেয়ে বড় পুরস্কার আসে তখনই যখন নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারবেন। এটা হচ্ছে যখন অন্যের জীবনমানকে আপনি বাড়াতে পারবেন। যখন নিজের চেয়ে বড় কিছুর অংশ হতে পারবেন এবং যখন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবেন।

সঠিক পথে ছোট পদক্ষেপ দিয়ে যাত্রা শুরু করুন। পদক্ষেপ কতো ছোট এটা কোনো ব্যাপার নয়, আপনার লক্ষ্যের দিকে অবিচল এগিয়ে চলুন।

হাল ছাড়বেন না। এবং এটা মনে রাখবেন এমন একজন আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন যিনি আপনি যে পথে আছেন তা জেনেই আপনাকে বিশ্বাস করেন এবং ভালোবাসেন।

আমার সামনে বেছে নেয়ার দুটো সুযোগ আছে, যা আমার নেই তার জন্য স্ররষ্টার ওপর অভিমান করা। অথবা আমার যেটুকু আছে তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানো।

যদি কোনো মিরাকলের দেখা না পান, নিজেই মিরাকলে পরিণত হোন।

সঠিক পথ এখন হয়তো আপনি খুঁজে পচ্ছেন না, কিন্তু এটা মনে করবেন না, তা নেই। পথ ঠিকই আছে।

বড় স্বপ্ন দেখুন। কখনো হাল ছাড়বেন না। আমরা সবাই ভুল করি। কিন্তু আমরা ভুল না। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করুন। সত্যকে মেনে চলুন। সব কিছুকে জয় করতে পারবেন।

পরিবর্তনের জন্য আশা করা কোনো কিছু বদল করতে পারে না। কাজ শুরু হলেই সব কিছুকে বদলে দিতে পারে।

পরিস্থিতির ওপর আমাদের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু সে পরিস্থিতিতে আমরা কেমন আচরণ করবো তার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতেই থাকে। যদি আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করি তবে যে চ্যালেঞ্জই আসুক না কেন তা অতিক্রম করতে পারবো।

পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছাড়া আপনি কখনো দাঁড়াতে পারবেন না।

সব সময় এগিয়ে চলুন। কেননা কাজ মোমেন্টাম তৈরি করে। যা অপ্রত্যাশিত সুযোগকে সামনে এনে দেয়।

একজন অঙ্গবিহীন মানুষ যদি বড় স্বপ্ন দেখতে পারে, তবে আমরা সবাই মিলে কেন তা পারবো না?

আমি আশা করি মর্মবেদনায় আক্রান্ত মানুষেরা আমার আনন্দময় জীবন দেখুক। তারা যেন ভাবতে পারে, হাত পা না থেকেও নিক যেমন স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারে, তেমনি আজকের দিনটির জন্য আমি কৃতজ্ঞ হবো এবং আমার সেরা কাজটা দেবো।

ঝুঁকি নিন। ঝুঁকি শুধু জীবনের অংশ নয়, এটাই জীবন। আপনার স্বপ্ন এবং কমফোর্ট জোনের মাঝে এই জীবন অবস্থান করে।

বিশ্বাস করুন, বড় কিছু করার আশা করুন। আপনার জীবন মাপা হবে এর আলোকে কতোটুকু আপনি কাজ করলেন তার ওপর।

জীবনে দুই ধরনের ঝুঁকি আছে। একটি চেষ্টা করার ঝুঁকি অন্যটি চেষ্টা না করার।

যদি আপনি নেতিবাচক চিন্তা পরিহার করতে পারেন এবং অতি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তবে তা ইতিবাচক বাস্তবতার জন্ম দেবে।

যতোক্ষণ আমার আশা জেগে আছে আমি নিজেকে অঙ্গহীন ভাববো না।

একজন মানুষের চরিত্র কোনো আরামপ্রদ অবস্থা বা নীরবে তৈরি হয় না। অভিজ্ঞাতার ভেতর দিয়ে যাওয়া এবং মনের অনেক ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে আমরা শক্তিমান হই, আমাদের মনছবি অনুপ্রাণিত করে এবং আমরা সফল হই।

লেখক  : সাংবাদিক ও গবেষক