শশাঙ্ক মণ্ডল
শস্য উৎসব: অম্বুবাচী সাধভক্ষণ নবান্ন ডাকশাখ সহরাই।
গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজে সর্বত্র শস্যোৎসব তার জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রান্তে অম্বুবাচী থেকে শুরু করে সাধভক্ষণ নবান্ন ডাকশাখ প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলি সাড়ম্বরে পালিত হতে দেখা যায়। বর্ষার শুরুতে কৃষকরা অম্বুবাচী পালন করে বর্ষার আগমনে পৃথিবী রসসিক্ত হয়ে ওঠে; পৃথিবী শস্য উৎপাদন ক্ষমতা লাভ করে।
পৃথিবীকে এ সময় রজস্বলা হিসাবে কল্পনা করা হয় এবং পৃথিবী অশুচি থাকে। ঋতুমতী পৃথিবীতে হলকর্ষণ মৃত্তিকা খনন বন্ধ রাখতে হয়। কৃষকরা নানা রকম আচার পালন করে থাকে বাড়িতে রন্ধন বন্ধ হয়, ঐ দিন গ্রামের মানুষদের মধ্যে দুধ আম পাকা কলা খাওয়ার প্রথা প্রচলিত আছে। বাসি পাস্তা ভাত এবং পূর্ব দিনের রান্না তরকারি ঐ দিন খেয়ে থাকে।
আশ্বিন মাসের শেষের দিকে ধান গাছ সতেজ হয়ে ওঠে, ধানের শীষ বেরুতে শুরু করে ধানগুলিকে গর্ভবতী নারীর সাথে তুলনা করা হয়। আশ্বিনের সংক্রান্তির দিনে কৃষকরা ধানগাছ গুলিকে সাধভক্ষণ করায়। সাধভক্ষণ অনুষ্ঠানের পূর্ব দিনের সন্ধ্যা বেলায় নেড়ার ঘর পোড়ান হয়। নেড়া অমঙ্গলের প্রতীক হিসাবে কল্পিত হয়েছে। নেড়ার ঘর পোড়ানো উপলক্ষে ছেলেরা কুলো হাতে করে ছড়া গান করতে থাকে ‘আমাদের বাড়ির পোকা মাকড় পরের বাড়ি যা রাজার বাড়ি হরিণ ছা, মেরে খা, মেরে খা’ ইত্যাদি।
কুলোর বাতাস দিয়ে শস্য বিঘ্ননাশক অপদেবতা, পোকা মাকড় প্রভৃতিকে দূর করে দেবার অনুষ্ঠান সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে মানুষের মধ্যে প্রচলন আছে। আশ্বিনের শেষদিনের ভোরে সাধভক্ষণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে নানারকম উপাচার সহযোগে যথা কাঁচা নিম পাতা, কাঁচা হলুদ, আলো চাল, তাল শাঁস, কলা, ওল, কচু ঘি মধু নানারকম মিষ্টান্ন একসাথে মিশিয়ে প্রসাদ তৈরি করা হয় এবং তা ধানের খেতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সকলে চিৎকার করে বলে ওঠে- ‘আশ্বিন যায় কার্তিক আসে/ মা লক্ষ্মী গর্ভে বসে। সাধ খাও বর দাও গো হো’- এই অনুষ্ঠান মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামেও লক্ষ করা যায়।
-মহাসমারোহে নতুন ধান ঘরে তুলে সেই ধানের চাল রান্না করে নবান্ন উৎসব পালন করে থাকে সুন্দরবনের কৃষিজীবী মানুষ। পল্লী রমণীরা শুচিবসন পরে শুদ্ধ চিত্তে লক্ষ্মীর অরাধনা করে লক্ষ্মীর প্রসাদ পেতে চায়। নবান্ন উৎসব উপলক্ষে অন্নগ্রহণ করার পূর্বে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে প্রসাদ নিবেদন করা হয়। এই উৎসব উপলক্ষে নানারকম গান ছড়া। পল্লী-মেয়েদের মধ্যে প্রচলিত আছে। ঢেঁকিতে ধান ভানা উপলক্ষে ডায়মন্ডহারবার আলিপুর এলাকাতে এখনও এই ধরনের গান গেয়ে থাকে।