সার্ডিনিয়ার বিচ্ছিন্ন পরিচয়
ইতালির মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ১২০ মাইল দূরে অবস্থিত সার্ডিনিয়া দ্বীপের মানুষরা তাদের দেশকে বলে “দ্য কন্টিনেন্ট”। এ দূরত্ব যেন আসলেই এক মহাসাগরের সমান। দ্বীপের জীবনধারা অনেকটাই আলাদা। লেখক যখন পশ্চিম উপকূলের ছোট শহর কুগলিয়েরিতে পৌঁছান, দেখেন এক বৃদ্ধা বারান্দা থেকে আরেকজনের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। এ দৃশ্যই যেন শহরের পরিচয়।
একই দিনে তিন প্রবীণ বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়—আন্তোনিও, জিওভান্নি মারিয়া আর রেঞ্জো, যাদের সম্মিলিত বয়স ২০০ বছরের বেশি। লেখক নিজের সিসিলিয়ান পরিচয় দিলে আন্তোনিও হাসি দিয়ে বলেন, “তুমিও তো দ্বীপবাসী!” এতে স্পষ্ট হয় দ্বীপের মানুষের আলাদা আত্মপরিচয়।
ভ্রমণের পরিকল্পনা
লেখক এবং তার সঙ্গীর পরিকল্পনা ছিল সোজা—দক্ষিণের রাজধানী কাগলিয়ারিতে উড়ে গিয়ে গাড়ি ভাড়া করে দ্বীপের চারপাশে উল্টো ঘড়ির কাঁটার দিকে চক্কর দেওয়া। লক্ষ্য ছিল উপকূল ধরে যতটা সম্ভব যাত্রা করা, সাঁতার কাটা, হাঁটা এবং ছোট ছোট দ্বীপে যাওয়া। সার্ডিনিয়ার উপকূল প্রায় ১,১৫০ মাইল হলেও সবখানেই পৌঁছানো যায় না।
দক্ষিণ উপকূলের সৌন্দর্য
কাগলিয়ারি থেকে ভিলাসিমিয়াস পর্যন্ত সড়ক পথ অত্যন্ত মনোরম। সমুদ্রকে অনুসরণ করে এ রাস্তা কখনো গ্রাম পার হয়, কখনো সমুদ্রের একদম ধারে চলে আসে।
রাত কাটান টরতোলিতে। দ্বীপের পূর্ব উপকূলের প্রায় অর্ধেক উঠে এসে সেখান থেকে ভেতরের দিকে সামান্য ডিটুর নেন। দুটো পাহাড়ে হাইক করেন—মোন্তে ফুমাই (১,৩১৬ মিটার) এবং মোন্তে নোভো সান জিওভান্নি। যাত্রা শুরু হয় প্রায় ১,০০০ মিটার উচ্চতা থেকে, তাই হাঁটা সহজ এবং মনোরম। চারপাশে কেবল গরুর ঘণ্টার আওয়াজ।
উত্তরের দ্বীপে অভিযান
উপকূল ধরে আবার রওনা হয়ে তারা পৌঁছান কালা ফিনানজায়। সেখান থেকে কায়াক ভাড়া করে প্রায় ৪ মাইল দূরে ইসোলা টাভোলারা দ্বীপে যান। এ দ্বীপের চুনাপাথর ও গ্রানাইটের খাড়া পাহাড় সমুদ্র থেকে উঠে আসে যেন বিশাল কচ্ছপের খোল বা ডাইনোসরের পাল।
এ দ্বীপকে ঘিরে নানা কাহিনি প্রচলিত। বলা হয়, এটি উলিসিসকে ফেরত দিতে ফিয়াকিয়ানরা যে জাহাজ দিয়েছিল, সেটিকে ক্রুদ্ধ সমুদ্রদেব পসেইডন পাথরে রূপান্তর করেন। দ্বীপের এক অংশে নেটোর সামরিক ঘাঁটি আছে। ১৯৬২ সালে বাকি বাসিন্দাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এখন কিছু জমির মালিক পর্যটকদের জন্য আংশিক থাকেন।
ম্যাডালেনা দ্বীপপুঞ্জ ও কেপ্রেরা
সার্ডিনিয়ার উত্তর প্রান্তের কাছে ম্যাডালেনা দ্বীপপুঞ্জের স্বচ্ছ জল আর সাদা বালুর সৈকত বিখ্যাত। তারা কেপ্রেরা দ্বীপে প্রায় ৩ মাইল হাঁটার ট্রেইল শেষ করেন। এখানেই ইতালির বিপ্লবী নায়ক জিউসেপ্পে গ্যারিবাল্ডি জীবনের শেষ ২৬ বছর কাটান।
আসিনারা দ্বীপের অভিজ্ঞতা
সূর্যাস্তের সময় পশ্চিমে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছান পোর্তো তোরেসে। সেখান থেকে এক ঘণ্টার ফেরিতে আসিনারা দ্বীপে। দ্বীপের আয়তন প্রায় ২০ বর্গমাইল। এখানে কোনো স্থায়ী বাসিন্দা নেই। ড্রামাটিক ক্লিফ, প্রশস্ত উপসাগর আর ছোট সৈকত ছাড়াও এখানে আছে বিখ্যাত বুনো সাদা বামন গাধা। তারা ই-বাইকে দ্বীপ ঘুরে এসব গাধাকে দূর থেকে দেখেন।
পশ্চিম উপকূলের রঙিন শহরগুলো
দক্ষিণমুখী যাত্রায় কেপো কাভিয়ায় পৌঁছে খাড়া ক্লিফ ধরে ছোট কিন্তু কষ্টকর হাঁটা শেষ করেন। ঢেউ ভাঙার দৃশ্য এতটাই মুগ্ধ করে যে লেখক পরের দিন সূর্যোদয়ে আবার যান।
এরপর আসে বোজা শহর, তেমু নদীর ধারে—দ্বীপের একমাত্র নাব্য নদী। এরপর একের পর এক ছবির মতো গ্রাম—মোডলো, মাগোমাদাস, ত্রেসনুরাগেস, সেননারিওলো এবং কুগলিয়েরি।
সিনিস উপদ্বীপ ও প্রাচীন সভ্যতা
দক্ষিণে যেতে যেতে থামেন সিনিস উপদ্বীপে। এর দক্ষিণ প্রান্তে চোখজুড়ানো ক্যাপো সান মার্কো—সমুদ্রের দুই ধারে বালুকা-ভূমি। পাশেই থারোস প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান—ফিনিশীয় বাণিজ্য কেন্দ্র, পরে কার্থেজীয় ও রোমানদের নিয়ন্ত্রণে।
সান পিয়েত্রো দ্বীপে টুনা খাবার
দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে পোর্তোভেসমে থেকে ফেরি নেন সান পিয়েত্রো দ্বীপে, যা কার্লোফোর্ত নামের একমাত্র শহর নিয়ে গঠিত। এখানকার বিখ্যাত খাবার বটর্গা দি টুনো—অ্যাটলান্টিক ব্লুফিন টুনার ডিম লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে প্রস্তুত করা।
স্থানীয় রেস্তোরাঁয় টুনার হার্ট, প্রোসিউতো, টারতার, পাস্তা, গ্রিলড এবং ফ্যাটি টুনা—সব পাওয়া যায়। যদিও এ মাছ ধরা ১৬৫৪ সাল থেকে টেকসই দাবি করা হয়, বিশ্বজুড়ে ব্লুফিন টুনার সংখ্যা কমছে। সান পিয়েত্রো আগ্নেয় দ্বীপ হওয়ায় অসাধারণ ক্লিফ ভিউ মেলে।
শেষ দিনের যাত্রা
শেষ দিন শুরু হয় সান্ত’আন্তিওকো দ্বীপের কালাসেত্তার ছোট বন্দরে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল ধরে কাগলিয়ারির দিকে ফেরেন। শেষ সূর্যাস্ত উপভোগ করেন ছোট সৈকত পোর্তো ট্রামাতসু থেকে। এরপর ডোমুস দে মারিয়া নামের গ্রাম পেরিয়ে এগিয়ে যান। এ নাম লেখককে মনে করিয়ে দেয় ইতালীয় গায়ক ফাব্রিজিও দে আন্দ্রের অ্যালবাম “লা বুয়োনা নভেলা”-কে, যার সঙ্গে সার্ডিনিয়ার সম্পর্ক গভীর।
শেষমেষ ছোট ছোট গ্রাম, কিছু পুরনো বাড়ি, পাহাড়ের ঢালে ছড়িয়ে থাকা জনপদ পেরিয়ে যাত্রার শেষ বা শুরুতে পৌঁছান—এক আনন্দময় অভিজ্ঞতার সমাপ্তি।