সারাক্ষণ ডেস্ক
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার জানিয়ে দিয়েছেন যে পানামা খাল ও গ্রিনল্যান্ড অধিগ্রহণের লক্ষ্যে সামরিক বা অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেবেন না—এমন কোনো নিশ্চয়তা তিনি দিতে পারবেন না। ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর থেকেই তিনি যে সম্প্রসারণবাদী এজেন্ডা প্রচার করে আসছেন, এটি তারই অংশ। ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের প্রাক্কালে, ট্রাম্প কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত করার কথাও ভেবেছেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। একইসঙ্গে, তিনি ন্যাটো মিত্রদের কাছ থেকে আরও বেশি প্রতিরক্ষা ব্যয় দাবি করবেন বলে উল্লেখ করেছেন এবং মেক্সিকো উপসাগরের নাম বদলে আমেরিকা উপসাগর রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
অফিসে বসার এখনও দুই সপ্তাহ বাকি থাকলেও, ট্রাম্প ইতিমধ্যে তার আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা তুলে ধরছেন—যেখানে কূটনৈতিক বিচেনা বা মিত্র দেশের উদ্বেগের প্রতি তেমন গুরুত্ব নেই। ফ্লোরিডায় তার রিসোর্টে এক সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাওয়া হয়, পানামা খাল ও গ্রিনল্যান্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে তিনি সামরিক বা অর্থনৈতিক জোর প্রয়োগ থেকে বিরত থাকবেন কি না। জবাবে ট্রাম্প বলেন, “না, আমি কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারব না। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য আমাদের এগুলো দরকার।”
ট্রাম্প অভিযোগ করেন যে কানাডীয় পণ্য ক্রয় ও কানাডাকে সামরিক সহায়তা দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সুবিধা হচ্ছে না, বরং দুই দেশের মধ্যকার সীমানাকে তিনি “কৃত্রিমভাবে টানা রেখা” বলেই মন্তব্য করেন।
গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাবে ডেনমার্ক সাড়া না দিলে সে দেশের ওপর শুল্ক আরোপের ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প। তার ভাষায়, গ্রিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মন্তব্যের ঠিক আগমুহূর্তে ট্রাম্পের ছেলে ডন জুনিয়র ব্যক্তিগত সফরে গ্রিনল্যান্ডে পৌঁছান।
ডেনমার্ক জানিয়েছে যে তাদের অধীন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড বিক্রির প্রশ্নই আসে না। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেদেরিকসেন বলেছেন, “আমরা দীর্ঘদিনের মিত্র ও অংশীদার। আর্থিক উপায়ে পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানো ভালো কোনো পথ নয়।”
কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জলি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (এক্স) বলেছেন, “প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত ট্রাম্পের মন্তব্য কানাডা সম্পর্কে তার সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রকাশ করছে। আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী, আমাদের মানুষ দৃঢ়চেতা। হুমকির মুখে আমরা কখনোই পিছপা হব না।”
পানামার কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি। তবে পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো পূর্বে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়েছিলেন যে ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ বুঝে নেওয়ার পর সেটি আবার যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
অ্যাম্বাসেডর ড্যানিয়েল ফ্রাইড, যিনি অবসরপ্রাপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের একজন কূটনীতিক এবং বর্তমানে আটলান্টিক কাউন্সিল নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, তিনি বলেছেন যে ট্রাম্পের এসব মন্তব্য “জাতীয় ক্ষমতাকে ভূখণ্ড বিস্তারের চোখে দেখার” ছবি আঁকে এবং তাকে “উনিশ শতকের সাম্রাজ্যবাদীর” সঙ্গে তুলনা করা যায়।
গ্রিনল্যান্ড দখলের প্রয়াস ন্যাটোকে ধ্বংস করে দেবে বলে মনে করেন ফ্রাইড। তার মতে, “সেটি আমাদের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পর্যায়ে নামিয়ে আনবে।”
মেক্সিকো উপসাগরের নাম বদলে আমেরিকা উপসাগর রাখার প্রতিশ্রুতি ট্রাম্প আগেই দিয়েছিলেন। এর আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আলাস্কার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ডেনালির নাম ঐতিহাসিক সংবেদনশীলতার কারণে ফিরে পেতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, যা পূর্বে মাউন্ট ম্যাককিনলে নামে পরিচিত ছিল। ট্রাম্প আগেই এটি আবার মাউন্ট ম্যাককিনলে নামেই ফেরানোর কথা বলেছিলেন।
মেক্সিকোর অর্থমন্ত্রী মার্সেলো, যিনি যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো বাণিজ্যসংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা, তিনিও পরবর্তীতে ট্রাম্পের এই নাম পরিবর্তন প্রস্তাবকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। তিনি বলেন, “আজ বলছি, ৩০ বছর পর যদি আমরা ফের মুখোমুখি হই, তবুও সেটির নাম মেক্সিকো উপসাগরই থাকবে।” একইসঙ্গে তিনি জানান, মেক্সিকো সরকার এই বিতর্কে জড়াতে চায় না।
সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের বোর্ড অন জিওগ্রাফিক নেমস ভৌগোলিক নাম নির্ধারণ করে থাকে, যদিও প্রেসিডেন্ট নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে নাম বদলানোর ক্ষমতাও রাখেন।
ট্রাম্প বলেছেন, ন্যাটো সদস্য দেশগুলোকে তাদের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ৫% প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করতে হবে, যা বর্তমান নির্ধারিত লক্ষ্য ২%-এর চেয়ে অনেক বেশি। তিনি বলেন, “আমি মনে করি ন্যাটোর লক্ষ্য ৫% হওয়া উচিত। ওরা সবাই এটা বহন করতে পারবে, ২%-এর বদলে ওদের ৫%-এ থাকা উচিত।”
ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন যে বেশিরভাগ ন্যাটো সদস্য দেশ তাদের প্রয়োজনীয় অবদান দিচ্ছে না। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর বিষয়েও কথা বলেছেন। ন্যাটোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে জোটের ৩২ সদস্য দেশের মধ্যে ২৩টি দেশ ২% লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে কোনো দেশই বর্তমানে ৫% জিডিপি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে না, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও নয়। পোল্যান্ড সবচেয়ে বেশি ব্যয় করছে—জিডিপির ৪.১২%, এরপর এস্টোনিয়া ৩.৪৩% এবং যুক্তরাষ্ট্র ৩.৩৮%।
ট্রাম্প আবারও সতর্ক করে বলেছেন যে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল থেকে অপহরণ করে গাজায় রাখা জিম্মিদের যদি হামাস তার দায়িত্ব গ্রহণের আগেই মুক্তি না দেয়, তাহলে “মধ্যপ্রাচ্যে তুলকালাম ঘটনা ঘটে যাবে।” তিনি বলেন, “এটা হামাসের জন্য ভালো হবে না, আর সত্যি বলতে, কারও জন্যই ভালো হবে না।” তার মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ জানিয়েছেন, ট্রাম্প শপথ নেওয়ার আগেই ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে আলোচনায় ইতিবাচক কিছু আসবে বলে তিনি আশা করেন।
ট্রাম্পের জয়ের পর এটি ছিল তার দ্বিতীয় দীর্ঘ সংবাদ সম্মেলন, যা প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে। তার নির্বাচনী প্রচারণার মতোই এখানেও তিনি নানা বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। তিনি নিজেকে ঘিরে থাকা বিভিন্ন ফৌজদারি অভিযোগের প্রসঙ্গ টেনে আক্রমণ করেন বিচারপতি জুয়ান মার্চানকে, যিনি একটি মামলায় পর্ন তারকাকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে ব্যবসায়িক রেকর্ড জালিয়াতির দায়ে শুক্রবার ট্রাম্পকে সাজা দেওয়ার কথা রয়েছে।
ওই সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার কিছু পরই নিউইয়র্কের একটি আপিল আদালত তার সাময়িক স্থগিতাদেশের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রের এক বিচারক সাময়িকভাবে বিশেষ কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গোপন নথি অপব্যবহার ও ২০২০ সালের নির্বাচন উল্টে দেওয়ার চেষ্টার তদন্ত সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা থেকেও বিরত রাখেন। সেই বিচারক এইলিন ক্যানন আগেও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গোপন নথি রাখার অভিযোগের মামলা খারিজ করে দিয়েছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ট্রাম্পের পাম বিচের মার-এ-লাগোয়, এর জাঁকালো বসার ঘরে। ট্রাম্পের বেশ কয়েকজন শীর্ষ উপদেষ্টা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আর ঠিক বাইরে ক্লাবের অতিথিরা টেরেসে বসে খাবার উপভোগ করছিলেন।
একজন সাংবাদিক ইলন মাস্কের আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রকাশ্য বিবৃতি দেওয়ার যথোপযুক্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুললে ট্রাম্প বলেন, “আমি শুধু বলতে পারি ইলন ভালো কাজ করছে, সে অত্যন্ত মেধাবী। আপনি যাদের কথা বলছেন, আমি তাদের চিনি না।”