সারাক্ষণ ডেস্ক
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজাহার ইউনিয়নের রাজাবিরাট এলাকায় গত ৩ জানুয়ারি,২০২৫ সকাল ১০টার দিকে আাদিবাসীদের ভোগদখলীয় জমিতে রাজাহার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ও তার লোকেরা মাটি ভরাট করতে শুরু করলে কয়েকজন যুবক তাতে বাধা দেন। তখন চেয়ারম্যান ও তাঁর লোকজন নেকোলাস মুর্মুর নামের এক যুবককে মারধর করে। খবর পেয়ে ব্রিটিশ সরেন নামের এক যুবক প্রতিবাদ করতে গেলে চেয়ারম্যান তাঁকেও লাঠি দিয়ে মারধর করার হুমকি দেয়। এ সময় ব্রিটিশ সরেনের মা ফিলোমিনা হাঁসদা চেয়ারম্যানের লাঠি ফেরাতে গেলে চেয়ারম্যান তাঁর মাকে মারধর করে মাটিতে ফেলে দেয়। এতে তিনি মারাত্মক আহত হন। বর্তমানে তিনি বগুড়ার জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনার জের ধরে ঐদিনই রাত ১১টার দিকে ব্রিটিশ সরেনের বাড়িতে চেয়ারম্যানের লোকজন আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। এতে মাটির ঘরের ভেতরের আসবাব, কাপড় ও টিনের চাল পুড়ে গেছে।
তথ্যানুসন্ধানের সময় : ১৩-১৫ জানুয়ারি, ২০২৫।
তথ্যানুসন্ধানের স্থান: রাজাহার ইউনিয়ন, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা।
সুত্র: বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খবর
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, গোবিন্দগঞ্জের রাজাহার ইউনিয়নের বাজাবিরাট এলাকায় এক সময় প্রচুর সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করত। বর্তমানে সেখানে মাত্র ৩৪টি সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বাড়ী রয়েছে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষেরা সহজ সরল ও নিরহ প্রকৃতির তাই আস্তে আস্তে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রভাবশালী লোক ও স্থানীয় কিছু বাঙালী বিভিন্ন অজুহাতে প্রতারণার মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে প্রায় ২৫০ একর জমি দখল করে নিয়েছে। এক্ষেত্রে কখনও তাদের উপর হামলা করা হয়েছে, কখনও ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছে, আবার কখনও জাল কাগজ-পত্র তৈরী করে তাদের কাছ থেকে এ জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে।
প্রতিনিধিদল যখন ভুক্তভোগী বৃটিশ সরেনের সাথে কথা বলেছে। তিনি ভারাক্রান্ত মনে জানান, এই এলাকায় তাদের ৩ একর ৭২ শতক জমি রয়েছে। সি এস খতিয়ানে এ জমির মালিক লক্ষন হেমব্রম। যিনি এ জমি পেয়েছিলেন রাজা শৈলাস চন্দ্র রায়ের কাছ থেকে। জমিদারি প্রথা বিলোপ হবার পর লক্ষন হেমব্রম তার দাদী মাইকা হেমব্রমের নামে এ জমি রেকর্ড করে দিয়েছে, সেই থেকেই তারা এ জমি ভোগ দখল করে আসছে। কিন্তু হঠাৎ করে কেরু মন্ডল নামে এক বাঙালী দাবি করেন তিনি চেক দাখিলা মূলে এ জমির মালিক হয়েছেন। এ নিয়ে বৃটিশ সরেনদের পূর্ব পুরুষদের সাথে একটি মামলা হয় তাতে ১৯৮০ সালে সাঁওতালরা তাদের পক্ষে রায়ও পেয়েছেন। কিন্তু তারপরও তারা তাদের জমি ভোগ দখল করতে পারেনি। কেরু মন্ডলের নামে এস এ খতিয়ান হলেও আদালতের রায়ে তার মালিক বৃটিশ সরেনরা। কিন্তু বি আর এস খতিয়ান হবার সময় কেরু মন্ডল আদালতের রায় গোঁপন করে তার নামে করে নেয়। কিন্তু পরবর্তীতে যখন কেরু মন্ডল বুঝতে পারে কোন অবস্থায়ই সে এ জমি পাবে না তখন সে বৃটিশ সরেনদের নামে রেজিস্ট্রি করে তা ফেরত দিয়েছে। এখানেও মূলত: চালাকি করা হয়েছে। সে মূলত: প্রমান করতে চেয়েছে এ জমির মালিক কেরু সরেন। এরপর ঐ জমিই কেরু মন্ডলের ছেলে হবিবুর মন্ডল ঐ জমি রাজাহার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের কাছে বিক্রি করে দেন। এবং সেই অবৈধ কাগজের বলে চেয়ারম্যান এ জমির মালিক দাবি করে আসছে। যার আদতে কোন ভিত্তি নেই।
বৃটিশ সরেন জানায়, গত ৩ জানুয়ারি,২০২৫ সকাল ১০টার দিকে আাদিবাসীদের ভোগদখলীয় জমিতে রাজাহার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ও তার লোকেরা মাটি ভরাট করতে শুরু করলে তার খালাতো ভাইরা তাতে বাধা দেন। তখন চেয়ারম্যান ও তাঁর লোকজন নেকোলাস মুর্মুকে মারধর করে। খবর শুনে ব্রিটিশ সরেন প্রতিবাদ করতে গেলে চেয়ারম্যান তাঁকেও লাঠি দিয়ে মারধর করার হুমকি দেয়। এ সময় ব্রিটিশ সরেনের মা ফিলোমিনা হাঁসদা তার ছেলেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে। এ সময় চেয়ারম্যান তার বৃদ্ধ মায়ের কানে সজোরে চর মারে এবং ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। তার কান দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। এবং পড়ে গিয়ে হাত ও পায়ে মারাত্মক আঘাত পান। ্এ সময় বৃটিশের খালাতো বোন নয়নী মুরমু ফিলেমিনাকে বাঁচাতে এলে চেয়ারম্যানের লোকেরা তার গায়ের শাড়ী ধরে টানাটানি শুরু করে এবং শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। সে চিৎকার শুরু করলে পাশের অন্যান্য নারীরা এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করেন। এছাড়াও চেয়ারম্যানের লোকেরা লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বৃটিশকে ধাওয়া করলে দৌড়ে এলাকা ত্যাগ করে। প¦ার্শবর্তী সাঁওতাল অন্যান্য নারীরা ফিলেমিনা হাঁসদাকে উদ্ধার করে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেসে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ফিলেমিনাকে বগুড়া জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজে রেফার করে দেন। তখনও তার কান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল এবং তিনি কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না। বর্তমানে তিনি বগুড়ার জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এ ঘটনার জের ধরে ঐদিনই রাত সাড়ে ১১টার দিকে ব্রিটিশ সরেনের বাড়িতে চেয়ারম্যানের লোকজন আগুন ধরিয়ে দেয়। বৃটিশ সরেনের ভাই জুলিয়াস সরেন বলেন, হঠাৎ শুনতে পা বাইরে কয়েকজন মানুষের পায়র আওয়াজ। প্রথমে মনে করেছিলাম চোর এসেছে বোধহয়্। এরপর দেখতে পাই বাড়ীর চালে আগুন জ¦লছে। আমি ও আমার স্ত্রী দৌড়ে ঘর থেকে বের হই। তখন দেখি দুইজন লোক দৌড়ে পালাচ্ছে। একজনের হাতে একটি বোতল ছিল। আমার চিৎকারে প¦ার্শবর্তী ঘর থেকে লোকজন বেড়িয়ে আসে। তাদের মধ্যে রূপ সরেন, রেজাউল, জয়ন্তসহ আরো অনেকে আগুন নেভাবার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু ততক্ষনে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। বোধহয় কেরোসিন বা পেট্রোলের সাথে খড় দিয়ে তারা টিনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমি তৎক্ষনাৎ ৯৯৯ এ কল দেই তারাই আমাকে ফায়ার ব্রিগেডের সাথে কথা বলিয়ে দেয়। এর কিছুক্ষণ পর আগুন নেভানোর গাড়ী এসে পুরো আগুন নিভায়। ততক্ষনে খাট পালং, কাপড় চোপর, লেপ কম্বল সব পুড়ে গেছে। এরও কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসে।
বৃটিশ সরেন বলেন, পরদিন ৪ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখ গাইবান্ধা ও গোবিন্দগঞ্জ থেকে এ্যাড. সিরাজুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বে মানবাধিকার কর্মী ও কিছু রাজনৈতিক দলের নেতারা আমাদের বাড়ীতে আসেন। এর আগ পর্যন্ত চেয়ারম্যানের ভাই সহ তার লোকেরা এ বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে হুমকি ধামকি দিয়ে আসছিল। তারা বলে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে এখানে আমাদের জ্যান্ত পুটে রাখবে। পুলিশকে প্রথমেই আগুন দেবার জন্য তাদেরকে সন্দেহের কথা বললেও পুলিশ তাদের কাউকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। ৪ তারিখ সন্ধ্যায় জুলিয়াস সরেন বাদী হয়ে চেয়ামরম্যান, তার ভাই, বাবাসহ ৬ জনের নাম উল্লেখ করে আরো অজ্ঞাতনামা ২০/২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। কিন্তু আমরা এরপরও পুলিশের কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখিনি। কারণ চেয়ারম্যান স্থানীয় বি এন পি’র প্রভাবশালী নেতা। পরদিন ৫ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখ গাইবান্ধা জেলা বিএনপি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে।
আশ্চর্যের বিষয় ৩ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখ ঘটনা ঘটলেও পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা জনাব শাহজাহান আলী ৯ জানুযারি, ২০২৫ তারিখ বিকেলে সিজার লিষ্ট তৈরী করতে যায়। তাও একটি সাদা কাগজে তাদের স্বাক্ষর করতে বলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে বৃটিশ সরেনের পরিবার স্বাক্ষর করতে অপারগতা প্রকাশ করে ১০ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখ গাইবান্ধা পুলিশ সুপার জনাব নিশাত অ্যাঞ্জেলার নিকট “নো কনফিডেন্স” চিঠি প্রদান করেন। পরবর্তীতে তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হযেছে।
এখানেই চেয়ারম্যানের কুকীর্তি শেষ হয়নি। কথা হয় বৃটিশ সরেনে জ্যাঠাতো বোন শ্যামবালা হেমব্রমের সাথে। তিনি জানান, তার ১৯ বিঘা সম্পত্তি চেয়ারম্যান জাল কাগজপত্র তৈরী করে দখল করে নিয়েছে। চেয়ারম্যান দেখিয়েছে, শ্যামবালা সরেনের বাবার কাছ থেকে দলিল মুলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে এই জমি চেয়ারম্যান কিনেছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক অফিসে আবেদন করলে জেলা প্রশাসকের অফিস রায় দেয় চেয়ারম্যান জেলা প্রশাসকের অনুমতির জাল কাগজপত্র তৈরী করেছেন। সুতারং যেহেতু জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেই এই উছিলায়ই তার দলিল টেকে না। কিন্তু সে জমি দখল করে কাটা তারের বেড়া দিয়ে কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়না। এছাড়া আদিবাসীদের কবরস্থানও সে দখল করে কাটা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। কবর দেয়াতো দুরে থাক সেখানে কেউ যেতে পারেনা।
আদিবাসীদের বাড়ীর পাশে খাস খতিয়ানভুক্ত একটি পুকুর রয়েছে যা সি এস খতিয়ান, এস এ খতিয়ান, বি আর এস খতিয়ান সব জরিপেই খাস দেখানো হয়েছে। চেয়ারম্যান সেই পুকুরেরও জাল কাগজ তৈরী করে নিজের নামে করে নিয়েছে এবং সেখানে কাউকে যেতে দেয়না। অনেক আগে থেকেই আদিবাসীরা এই খাস পুকুর লীজ নেবার জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন করলেও তারা তা পায়নি বরং প্রশাসন কোন এক অজানা কারনে চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামকেই সাপোর্ট করে গেছে। এ নিয়ে এলাকাবাসীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে।
প্রতিনিধিদল গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা ইয়াসমিন সুলতানা’র সাথে সাক্ষাৎ করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, তিনি নিজে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। এবং ভুক্তভোগী পরিবারকে সরকারীভাবে আর্থিক সহায়তা করেছেন। এছাড়াও তিনি তারা যাতে ঘর মেরামত করতে পারেন সে জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থা খাত থেকে তাদের টিন দেবার ব্যবস্থাও করছেন। তিনি বলেন, আমি পুলিশ প্রশাসনের সাথেও কথা বলেছি তারা যেন ঐ অঞ্চলে বসবাসরত সাঁওতালদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আমরা বৃটিশ সরেনের মা ফিলেমিনা’র সাথেও কথা বলে তার শারিরীক অবস্থার খোঁজ খবর নিয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার আইন অনুসারে কোন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যদি নৈতিক স্খলন বা ফৌজদারী মামলা হয় তবে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের বিধান রয়েছে। আমি অফিসিয়ালি এখনও তার গ্রেফতার হবার কাগজপত্র পাইনি। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র হাতে পেলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। খাস পুকুর দখলের বিষয় বলেন, আমি এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার জন্য এসি (ল্যান্ড) কে বলব।
প্রতিনিধিদল গোবিন্দগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ বুলবুল ইসলামের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তখন সি সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপারও উপস্থিত ছিলেন। ইনচার্জ বুলবুল ইসলাম বলেন আমরা ঘটনা ঘটনার সাথে সাথেই সেখানে গিয়েছি। সাঁওতালরা সন্দেহকারী হিসেবে চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের নাম আমাদের জানিয়েছে। আমরা ফায়ার সার্ভিস বিভাগের সাথেও কথা বলেছি তারা আমাদের জানিয়েছে কোন দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে আগুন দেয়া হয়ে থাকতে পারে। এ বিষয়ে তারা একটি রিপোর্ট দিবে। দেরীতে সিজার লিস্টের বিষয় জানতে চাইলে ওসি বলেন, আমাদের উপর আসামী ধরার চাপ ছিল। আমরা তাকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করেছি এছাড়াও পরের দিন তাকে কোর্টে তোলা হয়েছে সেখানে তদন্তকারী কর্মকর্তা ব্যাস্ত ছিলেন। তাই সিজার লিষ্ট করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়া প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন বেশ কিছু ব্যবহার্য বিষয় আমরা তাদের জিম্মায় দিয়ে এসেছি। যেখন খাট, তোষক এ জাতীয় জিনিষপত্র সেজন্য তাদের স্বাক্ষর নেয়ার প্রয়োজন ছিল । এটা আসলে একটা ভুল বোঝাবুঝি। তবে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, পুলিশের উপর সাঁওতালদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে মামলাটি তদন্ত করে চার্জশীট প্রদান করবেন।
প্রতিনিধিদল গাইবান্ধা পুলিশ সুপার নিশাত অ্যাঞ্জেলা’র সাথেও সাক্ষাৎ করেন। এ বিষয়ে তিনি জানান, আমি নিজেও অত্র এলাকা পরিবদর্শন করেছি এছাড়া ডি আই জি স্যারও ঐ এলাকা পরিদর্শন করেছেন। আপনারা জানেন, ৫ই আগস্টের পর থেকে পুলিশ প্রশাসন বেশ কঠিন সময় পার করছে। আমাদের এখনও যথেষ্ট জনবল নেই। এছাড়া বিভিন্ন পারিপাশির্^ক কারনে আমরা জনগণের আশা অনুযায়ী সব করতে পারছিনা। তবে আমরা আন্তরিকভাবে এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠে আরো সক্রিয়ভাবে কাজ করার চেষ্টা করছি। এই মামলাটি নিয়ে আমাদেরকে সর্বোচ্চ মহল থেকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমি আপনাদের আশ^স্ত করতে চাই, এ বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলার তদন্ত করব। এবং খুব শিঘ্রই আমরা চার্জশীট প্রদান করব। ২০১৬ সালের ঘটনার পর পুলিশের উপর সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা সচেষ্ট আছি।
প্রতিনিধিদল গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক জনাব চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমদের সাথেও সাক্ষাৎ করেছেন। প্রতিনিধিদলের কাছে সাঁওতাল আদিবাসীদের প্রতি তার আচরণ অসন্তোষজনক মনে হয়েছে। প্রতিনিধিদলের প্রতিও তার আচরণ মোটেই সন্তোষজনক ছিলনা। তিনি প্রথমেই প্রতিনিধিদলের সদস্য বাগদা ফার্ম ভ‚মি উদ্ধার কমিটি সভাপতি ডা. ফিলিমন বাস্কেকে কেন তারা ইপিজেড করতে বাধা দিচ্ছেন সে বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে থাকেন। তিনি বলেন, সাঁওতালদের কারনে সেখানে ইপিজেড করা যাচ্ছে না তাই কোন উন্নয়ন হচ্ছেনা। প্রতিনিধিদল রাজাহার ইউনিয়নের ঘটনাটি নিয়ে কথা বলতে চাইলেও সে বিষয়ে তিনি খুব বেশী আগ্রহ দেখাননি। তিনি বলেন, আমরা যথাবিহিত ব্যবস্থা নিচ্ছি। চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামকে বরখাস্তের বিষয় জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, চার্জশীট না আসলে আমরা কোন ব্যবস্থা নেবনা। প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য বলেন, রাষ্ট্রের নীতি অনুযায়ী ৩ বা ৪ ফসলী জমিতে কোন প্রকল্প নেয়া যায় না, তাই আপনি বাগদা ফার্মের ৪ ফসলী জমিতে আপনি ইপিজেড করতে পারেননা বললে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আপনি কিছুই জানেন না, উন্নয়ন হলে আপনি চাল ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনে খাবেন। সিঙ্গাপুরতো শস্য উৎপাদন করে না, কিন্তু তাদের অবস্থা দেখেছেন। দায়িত্বশীল পদে থেকে তার এই বক্তব্য আমাদের হতবিম্বিত করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে তিনি নতুন করে সাঁওতালদের এই ৪ ফসলী জমিতে নতুন করে ইপিজেড তৈরী করার বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের মতো পাঁয়তারা করছে। এ বিষয়ে জনগনের ইচ্ছা বা রাষ্ট্রের পলিসির তোয়াক্কা তিনি করেননা। এ ক্ষেত্রে এর সাথে অন্য কোন মহল জড়িত কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার। সর্বশেষে তিনি সবচেয়ে আপত্তিকর মন্তব্যটি করেন, “কিছু মানুষ ভ‚মি অধিকারের নামে ব্যবসা খুলে বসেছেন”। প্রতিনিধিদল তাদের উপস্থিতির প্রমান সরূপ তার সাথে ছবি তুলতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন।
এটা তো ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, পাকিস্তান আমল থেকে অন্য অঞ্চলের মতো বারংবার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের উপর প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলের নেতা বা তাদের মদদপুষ্ট ব্যক্তিরা সাঁওতালদের ভূসম্পত্তির দখল নিতে তৎপর থেকেছে । কখনও রাষ্ট্র তাদের জমি কেড়ে নিয়েছে চিনিকলের নামে আবার কখনও পুলিশ প্রশাসন তাদের বাড়ী ঘরে আগুন দিয়ে এলাকা ছাড়া করেছে। সেইসাথে স্থানীয় বাঙালী প্রভাবশালীরা তাদেরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের বাড়ী ঘর দখল করার ফন্দি-ফিকির বাস্তবায়ন করেছে।
সুপারিশসমূহ:
১। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজাহার ইউনিয়নের রাজাবিরাট এলাকায় গত ৩ জানুয়ারি,২০২৫ ঘটে যাওয়া ঘটনাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পুলিশকে তদন্ত করতে হবে। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বরের গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মের সাঁওতাল পল্লীতে আক্রমনের কারণে পুলিশের উপর আস্থাহীনতা সিৃষ্টি হয়েছে। তাই তা ফিরিয়ে আনার জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া অতীব জরুরী।
২। সাঁওতাল নারীদের মারধর শ্লীলতাহানির ঘটনায় গ্রেফতারকৃত চেয়ারম্যান ও তাঁর সাথে সম্পৃক্ত সকল অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দ্রæত নিশ্চিত করতে হবে।
৩। চেয়ারম্যান ও তাঁর লোকজনের জোরপূর্বক সাঁওতাল আদিবাসীদের জমি দখলকে কেন্দ্র করে হত্যার উদ্দেশ্যে রাতের বেলায় সাঁওতাল বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনা তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
৪। রাজাহার ইউনিয়রন পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে রফিকুল ইসলামকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করতে হবে।
৫। সাঁওতালদের পৈতৃক জমি চেয়ারম্যান থেকে উদ্ধার করে সাওতালদের তা ফিরিয়ে দিতে হবে। চেয়ারম্যানের অবৈধ দখলে রাখা খাস পুকুর উদ্ধার করে সাঁওতাল আদিবাসীদের লিজ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৬। সাঁওতাল আদিবাসীদের কবর স্থান উদ্ধার করে তাদের ফিরিয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক কবর স্থান রক্ষনাবেক্ষণের জন্য স্থায়ী দেয়াল নির্মাণ করতে হবে।
৭। গাইবান্ধার বর্তমান জেলা প্রশাসক সাঁওতাল আদিবাসীদের প্রতি যে বিদ্বেষমূলক আচরণ প্রদর্শণ, ক্ষমতার দম্ভ প্রদর্শন এবং রাষ্ট্রীয় নীতির তোয়াক্কা না করে ৪ ফসলী জমিতে ইপিজেড করার চক্রান্তে লিপ্ত হবার জন্য অবিলম্বে তাকে অপসারণ করতে হবে।