আদিত্য নারায়ণ
২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের পদে ফিরে এসে নির্বাহী আদেশের ঢল নামানোর পর, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার ধনকুবের বন্ধু ও উপদেষ্টা ইলন মাস্ক ৯০ দিনের জন্য সমস্ত বিদেশি তহবিল স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেন। এই পদক্ষেপের প্রভাব সুদূরপ্রসারী ছিল, যার ফলে সিরিয়া, থাইল্যান্ড, ইউক্রেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মানবিক সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডি (USAID) সক্রিয়ভাবে কাজ করছিল।
সেখানেই থেমে না থেকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং নতুন গঠিত ডিপার্টমেন্ট ফর গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি (DOGE)-এর প্রধান ইলন মাস্ক, USAID-এর কর্মীসংখ্যা ১০,০০০ থেকে মাত্র ২৯৪-তে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করেন—যা শুক্রবার আদালত সাময়িকভাবে স্থগিত করে।
এর মধ্যেই, USAID-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ছুটিতে পাঠানো হয়, কারণ তারা DOGE-এর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন, একটি সংস্থা যার ক্ষমতার পরিধি এখনও অস্পষ্ট। DOGE USAID-এর সংবেদনশীল তথ্যের অ্যাক্সেস চাওয়ার পর, USAID-এর ওয়েবসাইট অন্ধকারে চলে যায় এবং ওয়াশিংটন অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়, ফলে কর্মীরা বাইরে প্রতিবাদ করতে বাধ্য হন।
USAID বন্ধের পরিকল্পনা
ট্রাম্প-মাস্ক জুটির মূল পরিকল্পনা USAID সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া, যা আগেই টেসলা প্রতিষ্ঠাতা মাস্ক ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমাদের কাছে এটা একটা কেঁচোর বলের মতো। আপনাকে পুরো ব্যাপারটাই মূল থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে। এটি আর মেরামতযোগ্য নয়।”
পরবর্তী বিকল্প হিসেবে, USAID-কে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অধীনে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, যিনি এজেন্সির ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, USAID-কে ‘অবাধ্যতা’র অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।
নানা অভিযোগ
এই সিদ্ধান্তকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য, ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তি দিয়েছে যে USAID-এর কার্যক্রম প্রেসিডেন্টের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, সংস্থাটি সার্বিয়ার একটি LGBTQ গোষ্ঠীর জন্য ১.৫ মিলিয়ন ডলার এবং ভিয়েতনামের একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থার জন্য ২.৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছিল।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প USAID-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন। তিনি দাবি করেছেন, সংস্থাটি ৫০ মিলিয়ন ডলারের কনডম গাজায় পাঠিয়েছে, যা পরে বোমা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও গার্ডিয়ান-এর এক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম এশিয়ার কোথাও কনডম পাঠায়নি, শুধুমাত্র জর্ডান ব্যতীত।
বৈশ্বিক সাহায্য এবং USAID-এর ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বের বৃহত্তম বৈদেশিক সাহায্য প্রদানকারী দেশ, যদিও তার বাজেটের মাত্র ০.৬% (৬.৭৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে) এই খাতে ব্যয় হয়। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য ৬৮ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৪০ বিলিয়ন ডলার USAID-এর মাধ্যমে ব্যয় হয়েছে।
USAID-এর কার্যক্রম ১৩০টি দেশে বিস্তৃত। এটি তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানে স্কুলছাত্রীদের শিক্ষার দায়িত্ব পালন করে, উগান্ডায় ইবোলা মহামারী পর্যবেক্ষণ করে এবং আফ্রিকায় PEPFAR (এইচআইভি/এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি) পরিচালনা করে, যা ২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলে শুরু হয়েছিল এবং ২০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে, সংস্থার মূল লক্ষ্য ইউক্রেন, যেখানে এটি কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে বিশ্ববাজারে বিক্রি করে এবং আহত সৈন্যদের কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সরবরাহ করে। এছাড়া, এটি দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কর্মসূচি পরিচালনা করে, যা সংকটের পূর্বাভাস দিতে পারে। ভারতে, সংস্থাটি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্যানিটেশন ও পরিবেশ সংক্রান্ত প্রকল্প চালায়।
USAID বনাম চীনের ‘সফট পাওয়ার’
USAID প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে, ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি-র শাসনামলে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময় রাশিয়ার প্রভাব মোকাবিলা করতে। শুরুতে এটি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অধীনে কাজ করলেও, ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস একে একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে, USAID বন্ধ করার ক্ষমতা কেবলমাত্র কংগ্রেসের হাতেই রয়েছে।
এই স্বাধীন অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো ‘অমিত্র’ দেশের সঙ্গেও সংযোগ বজায় রাখার সুযোগ দিয়েছে, যেখানে সংস্থাটি মানবিক কার্যক্রম চালায়। তবে মার্কিন জনসাধারণ, বিশেষত রিপাবলিকানরা, সবসময় বিদেশি ব্যয় কমানোর পক্ষে ছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প ও মাস্ক যৌথভাবে USAID ‘খরচ কমানোর’ লক্ষ্যে ছাঁটাই করলেও, এর শূন্যস্থান পূরণে চীন দ্রুত এগিয়ে আসবে। তবে, চীন মূলত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর মাধ্যমে অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, যা USAID-এর মানবিক সহায়তার প্রকল্পগুলোর সমতুল্য হতে পারে না।
বিশ্বজুড়ে ক্ষতির আশঙ্কা
দুর্ভাগ্যবশত, ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ স্বার্থের খেসারত দিতে হচ্ছে বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে।
( লেখাটি ভারতীয় সেন্টার লেফট সমর্থক সংবাদপত্র হি হিন্দু থেকে সংক্ষেপতি অনুবাদ)