সারাক্ষণ ডেস্ক
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশ ভ্রমণে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য চ্যালেঞ্জ দিন দিন বাড়ছে। হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্সে বাংলাদেশের পাসপোর্ট বর্তমানে বিশ্বে ৯৩তম স্থানে রয়েছে। তবে এই র্যাঙ্কিংয়ের উন্নতি সত্ত্বেও বাস্তব চিত্র আরও উদ্বেগজনক। ভিসা ছাড়া ভ্রমণ করা যায় এমন দেশের সংখ্যা ৪২ থেকে কমে ৩৯-এ নেমে এসেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ফিলিস্তিন ও লিবিয়ার সঙ্গে একই র্যাঙ্কে অবস্থান করছে এবং বাংলাদেশের পাসপোর্ট উত্তর কোরিয়ার চেয়েও নিচে রয়েছে।
কেন বাংলাদেশের পাসপোর্ট দুর্বল?
একটি পাসপোর্টের শক্তি নির্ভর করে এর অধিকারীরা কতটি দেশে ভিসা ছাড়া ভ্রমণ করতে পারেন তার ওপর। বর্তমানে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা মাত্র ৩৯টি দেশে ভিসা-মুক্ত বা ভিসা-অন-অ্যারাইভাল সুবিধা পান, যা গত বছরের ৪২টি দেশের তুলনায় কম। এ অবনমন বৈশ্বিক চলাচলের সীমাবদ্ধতার ইঙ্গিত দেয় এবং বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গভীর সমস্যার প্রতিফলন।
র্যাঙ্ক বাড়ল কেন, কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হলো না
বাংলাদেশের র্যাঙ্ক ৯৭তম থেকে ৯৩তম স্থানে উন্নীত হওয়াটা দেখলে ইতিবাচক মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অন্যান্য দেশের অবস্থার অবনতির কারণে বাংলাদেশের র্যাঙ্ক সামান্য উন্নত হয়েছে, পাসপোর্টের প্রকৃত শক্তি নয়। ভিসা-মুক্ত গন্তব্য কমে যাওয়া এই অবনতির প্রমাণ।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন মালদ্বীপ (৫২তম, ৯৩টি ভিসা-মুক্ত গন্তব্য) এবং ভারত (৮০তম, ৫৬টি ভিসা-মুক্ত গন্তব্য) বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে। এমনকি নেপাল, যাদের র্যাঙ্ক বাংলাদেশের ঠিক নিচে, তারাও প্রায় একই রকম ভিসা সুবিধা দেয় (৩৮টি গন্তব্য)।
কেন এমনটা ঘটছে?
১. বিদেশি রাষ্ট্রের আস্থা কমে যাওয়া
অবৈধ অভিবাসন, অতিরিক্ত সময় থাকা এবং অনিয়মিত কার্যক্রমের অভিযোগে অনেক দেশ বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা নীতিমালা কঠোর করেছে। এর ফলে ভিসা অনুমোদন কঠিন হয়ে পড়েছে, যা প্রকৃত ভ্রমণকারীদের জন্য বড় বাধা সৃষ্টি করছে।
২. কূটনৈতিক দুর্বলতা
অন্যান্য দেশ যেখানে সক্রিয়ভাবে ভিসা চুক্তি করছে, বাংলাদেশ সেখানে উল্লেখযোগ্য ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। মালদ্বীপের মতো দেশগুলো কূটনৈতিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তাদের নাগরিকদের জন্য ব্যাপক সুবিধা অর্জন করেছে, যা বাংলাদেশ পারেনি।
৩. ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার বৃদ্ধি
ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি আবেদনকারীদের ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার বাড়ছে। দীর্ঘ ও অনিশ্চিত ভিসা প্রক্রিয়া শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রত্যাখ্যানের প্রবণতা বাংলাদেশের বৈশ্বিক সুযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে।
৪. অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবমূর্তি
একটি পাসপোর্টের শক্তি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থারও প্রতিফলন। নিয়মিত রাজনৈতিক অস্থিরতা, অসঙ্গত নীতিমালা এবং দুর্নীতির কারণে দেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে অন্যান্য দেশ বাংলাদেশিদের জন্য প্রবেশাধিকার সহজ করতে অনিচ্ছুক হয়ে ওঠে।
নাগরিকদের ওপর প্রভাব
এই চ্যালেঞ্জগুলো শিক্ষার্থী, পেশাজীবী এবং উদ্যোক্তাদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।
শিক্ষার্থীরাঃ কঠোর ভিসা প্রক্রিয়ার কারণে বিদেশে পড়াশোনা করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরাঃ আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সীমাবদ্ধ হচ্ছেন।
পর্যটক ও পরিবারের সদস্যরাঃ ভিসার অনিশ্চয়তার কারণে ভ্রমণের স্বাধীনতা হারাচ্ছেন।
বাস্তবতা হলো, আগের চেয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সীমাবদ্ধতা আরও বেশি হয়ে উঠেছে। এই সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, নীতিমালার উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক সম্পৃক্ততার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ভবিষ্যতের র্যাঙ্কিং যেন অন্যদের পতনের সুযোগে নয়, বরং প্রকৃত উন্নতির মাধ্যমে অর্জিত হয়—এটাই মূল চ্যালেঞ্জ