পায়েল সামন্ত
মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য বড় ঘোষণা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বাজেটে। বিপুল বরাদ্দ, স্মার্ট ক্লাস, শিক্ষার আধুনিকীকরণের ঘোষণা।
রাজ্যের শিক্ষা পরিকাঠামোর অন্যতম অংশ মাদ্রাসা। সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর ধরে বিকল্প ধারা হিসেবে চলে আসছে। তার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে এ বারের রাজ্য বাজেটে।
পশ্চিমবঙ্গের বাজেটে মাদ্রাসা শিক্ষা
ভারতের সংবিধান অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির পাশাপাশি তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর বাইরেও রাষ্ট্রের অনুমোদন ও প্রত্যক্ষ অনুদানে অনেক মাদ্রাসা চলে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবা হয়েছে বাজেটে।
বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস তার বক্তৃতায় ছয়শটি নতুন মাদ্রাসার কথা বলেছিলেন। সেই ধারায় পশ্চিমবঙ্গের অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বুধবার ঘোষণা করেছেন, মাদ্রাসাগুলির পরিকাঠামো আরও আধুনিক করা হবে। উন্নত করা হবে পঠনপাঠনের মান।
এ বারের বাজেটে সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তরের জন্য পাঁচ হাজার ৬০২ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা ব্যয় বরাদ্দের প্রস্তাব রয়েছে।
বাজেটের ঘোষণা অনুযায়ী, মাদ্রাসা পরিকাঠামোর খোলনলচে বদলে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আরো বেশি সংখ্যক মাদ্রাসায় গড়ে উঠবে স্মার্ট ক্লাসরুম। সেখানে আধুনিক গ্যাজেটের মাধ্যমে পঠনপাঠন করানো হবে। এর জন্য থাকবে ই-বুক। একই সঙ্গে আরো বেশি মাদ্রাসায় কম্পিউটার ল্যাব গড়ে তোলার ভাবনা রয়েছে।
চলতি অর্থবর্ষে মাদ্রাসাগুলিতে ৬০০টি স্মার্ট ক্লাসরুম, ১০০টি ডিজিট্যাল ল্যাবরেটরি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এর পাশাপাশি ৭৬টি মাদ্রাসায় সায়েন্স ল্যাবের মানোন্নয়ন করা হবে। এই সংক্রান্ত অনুমোদন ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন।
রাজ্যে মাদ্রাসা শিক্ষা
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম শ্রেণির মাদ্রাসাগুলি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থারই অংশ৷ তবে চরিত্র অনুযায়ী একাধিক শ্রেণিতে ভাগ করা যায় এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে। সরকারি অনুমোদন ও অনুদান উভয়ই পায় এমন মাদ্রাসার সংখ্যা ৬১৪৷
এর মধ্যে ‘হাই মাদ্রাসা’ ৫১২, সিনিয়র মাদ্রাসা ১০২৷ হাই মাদ্রাসার মধ্যে ১২টি জুনিয়র হাই মাদ্রাসা৷ এ সব হাই মাদ্রাসা পরিচালনা করে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড৷ অন্যান্য মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের মতো পঠনপাঠনের সঙ্গে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম ও আরবি ভাষা শিক্ষার সুযোগ এখানে আছে৷
তবে হাই মাদ্রাসায় উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ইসলামিক শিক্ষার সুযোগ নেই। এই পর্যায়টি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ পরিচালনা করে৷ ২১০টি হাই মাদ্রাসাকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করা হয়েছে৷
পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের হিসেব অনুযায়ী, অনুমোদিত ৬১৪টি মাদ্রাসার মধ্যে ৫৫৪টিতে ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে পড়ে। ৫৭টি মাদ্রাসা শুধু মেয়েদের জন্য, তিনটি শুধু ছেলেদের জন্য৷ ১৭টি মাদ্রাসা উর্দু মাধ্যমের৷ অনুমোদিত মাদ্রাসার মধ্যে ১৮৩টিতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া হয়৷ এই দিকটি পরিচালনা করে কারিগরি শিক্ষা দপ্তর।
কলকাতায় সরকার স্বীকৃত ও অনুদানপ্রাপ্ত মাদ্রাসা নয়টি৷ এর মধ্যে আটটি হাই মাদ্রাসা, একটি সিনিয়র মাদ্রাসা৷
মাদ্রাসা মানে শুধু সংখ্যালঘু পড়ুয়ারা সেখানে পড়াশোনা করে না। অমুসলিম অন্যান্য সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরাও এখানে পড়ে। এমন মাদ্রাসা পশ্চিমবঙ্গে আছে যার অর্ধেকের বেশি পড়ুয়া অমুসলমান পরিবারের।
সরকারের অনুমোদন ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া হাজার হাজার মাদ্রাসা পশ্চিমবঙ্গে চলছে এর সঠিক সংখ্যাও জানা যায় না। এগুলিকে বলে খারিজি মাদ্রাসা। বেসরকারি হিসেবে হাজার ছয়েক এমন মাদ্রাসা রয়েছে।
ঘোষণা ও বাস্তবায়ন
মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক করার দাবি অনেক পুরোনো। বাম সরকারের আমলে সেই কাজ শুরু হয়েছিল। সেই কাজ চলতি সরকারের আমলেও তা এগিয়েছে।
বাজেট ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন তৃণমূল সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি ও বিধায়ক মোশারফ হোসেন। তিনি বলেন, ”মাদ্রাসাগুলির জন্য অনুদান জরুরি ছিল। অনেক মুসলমান পড়ুয়া মাদ্রাসা থেকেই পাশ করে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। অনেক মুসলমান ছাত্র মাদ্রাসার জন্য এগিয়ে গিয়েছেন শিক্ষা ক্ষেত্রে।”
ভাঙড়ের বিরোধী বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকি প্রযুক্তির পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় মাদ্রাসাকে সমৃদ্ধ করার কথা বলছেন। তার বক্তব্য, ”মাদ্রাসায় শুধু আরবি আর ইসলাম ধর্ম না পড়িয়ে পদার্থবিদ্যা, গণিত, ইংরেজিও শেখানো হোক। নতুন প্রকল্প নিয়ে এগোনোর আগে পুরোনো ৬১৪টি মাদ্রাসার পরিকাঠামো আগে ঠিক করুক রাজ্য সরকার।”
রাজ্যের মাদ্রাসা শিক্ষায় স্মার্ট ক্লাসরুম বা কম্পিউটার ল্যাব নতুন বিষয় নয়। এর আগে যে প্রতিষ্ঠানে এগুলি তৈরি করা হয়েছিল, তার এখন কী অবস্থা? নিউটাউনের হাতিয়াড়া হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক এসকার আলি শেখ ডিডব্লিউকে বলেন, ”আমার মাদ্রাসায় তিনটি স্মার্ট ক্লাসরুম আছে। পাঁচ-ছয়টি ল্যাব আছে। এগুলি কোভিডের আগেই শুরু হয়েছিল। অতিমারির জেরে বছর দুয়েক বন্ধ ছিল এসব। কিন্তু তারপর আর চালু হয়নি। এগুলি চালু করার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তা আমাদের কাছে নেই। তাই নতুন তৈরি করার পাশাপাশি পুরোনো যেগুলি বন্ধ আছে, সেগুলির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন।”
শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের বরাদ্দ করা হয়েছে রাজ্য বাজেটে। উচ্চশিক্ষা খাতে ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে বরাদ্দ ৬ হাজার ৫৯৩ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা। এছাড়া রাজ্যের চলমান একাধিক প্রকল্পে উপকৃত হয়েছে ছাত্রছাত্রীরা, যে টাকা সরাসরি শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নয়। দরিদ্র এবং মেধাবী পড়ুয়াদের জন্য ঐক্যশ্রী প্রকল্প চালু হয়েছে। এই প্রকল্পে ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ কোটি ছাত্রছাত্রী উপকৃত হয়েছে বলে রাজ্য হিসেব। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ৪৫ লক্ষ আবেদনের মধ্যে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬ লক্ষ স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন মন্ত্রী।
বেঙ্গল মাদ্রাসা এডুকেশন ফোরামের সভাপতি ইসারুল হক মণ্ডল বলেন, ”সরকারি ব্যয় বরাদ্দ যা হয়, সেটা কতটা খরচ হচ্ছে বোঝা যায় না। যে টাকা সরকার ঢালছে, সেটা ঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে নজরদারি দরকার। সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের স্কলারশিপের টাকা ঠিকঠাক তারা পায়। কিন্তু সার্বিক খরচের কতটা ঠিক মানুষের কাছে পৌঁছয়, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।”
চ্যালেঞ্জও আছে
বিপুল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে এসকার বলেন, ”সরকারের পদক্ষেপ প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু তার বাস্তবায়ন দেখতে হবে। আমার স্কুল শহরে বলে এখানে শিক্ষকের ঘাটতি নেই। কিন্তু জেলার অনেক মাদ্রাসা স্কুলে শিক্ষক নেই। গেটম্যান ও সাফাই কর্মী রাখার সামর্থ্য নেই। আমার মাদ্রাসাতেই গেটম্যান ও সাফাই কর্মীদের বেতন দেওয়ার জন্য পড়ুয়াদের কাছ থেকে ১১ হাজার টাকা তুলতে হয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এর মোকাবিলা করতে হবে।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমানুল হক ডিডাব্লিউকে বলেন, ”মাদ্রাসা স্কুলগুলোকে আধুনিকীকরণ করলে তা নিশ্চয়ই সাধুবাদ যোগ্য। তার থেকেও বেশি জরুরি সংখ্যালঘুদের চাকরি সহ তাদের কাজের জায়গা সুনিশ্চিত করা। ওবিসি কোটা বাতিলের আদেশ হয়েছে, তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে লড়াই করতে হবে সরকারকে। খারিজি মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের ভূমিকা থাকুক আমি সেটা চাই না। কারণ সেগুলির ধর্ম সম্প্রদায়ের।”
খারিজি মাদ্রাসা নিয়ে নানা প্রশ্ন মাঝেমধ্যেই ওঠে। অতীতে এই মাদ্রাসাগুলিকে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লাগানোর অভিযোগ উঠেছিল। ইসারুল বলেন, ”একটা দোকান খুলতে গেলেও ট্রেড লাইসেন্স লাগে। সরকারের খাতায় নাম থাকে। একইভাবে খারিজি মাদ্রাসার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকুক, স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা হোক। তাহলে এই ধরনের মাদ্রাসা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায়, সেটা বন্ধ হবে।”
ডিডাব্লিউ ডটকম
Leave a Reply