ধীরেনদের বাসায়
পুলিশ ইন্সপেক্টরেরা কাহারও বিরুদ্ধে মিথ্যা মোকদ্দমা সাজাইয়া আনিলে তাহার প্রতি তিনি মারমুখী হইতেন। একবার এক ইন্সপেক্টর কোনো মামলায় গভর্নমেন্টপক্ষীয় সাক্ষীদিগকে তাঁহার বাড়িতে আনিয়া উপস্থিত করিলেন। সেই ইন্সপেক্টরকে তিনি এমনই ধমকাইয়াছিলেন যে তাহার জীবনে বোধহয় সে এমন ধমক খায় নাই। তিনি বলিতেন, “যাহা সত্য, সাক্ষীরা তাহাই আদালতে বলিবে। সাক্ষীদিগকে কি বলিতে হইবে তাহা শিখাইয়া দিবার জন্য তিনি গভর্নমেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত হন নাই।”
তাঁহার বাড়িতে প্রায়ই দুইজন করিয়া ছাত্র আহার ও বাসস্থান পাইত। তাহারা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াইত। দূর-সম্পর্কীয় ভাইপোরাও কেহ কেহ তাঁহার বাড়িতে থাকিতেন।
তাঁহাকে কখনও কাহারও জন্য শোক করিতে দেখি নাই। একবার তাঁর একটি মেয়ে মরিয়া গেল। তখনও তাঁহার চোখে এক ফোঁটা জল দেখিলাম না। তাঁহার প্রথমপক্ষীয় স্ত্রীর একটি মেয়ে ছিল। কি কারণে যেন তিনি সেই মেয়ের কোনো খোঁজ লইতেন না। সেই মেয়েটির যেদিন মৃত্যুসংবাদ আসিল, সেদিন বাড়ির সবাই খুব শঙ্কিত হইল এই সংবাদ পাইয়া তিনি কি করিবেন। টেলিগ্রামটি হাতে পাইয়া কিছুক্ষণ তিনি গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন। এই চিরগম্ভীর লোকটির মনে সেদিন কি হইতেছিল, সেই গভীর সমুদ্র তলদেশের কোনো খবরই কেহ পাইল না।
এই বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকটির কোনো বন্ধু ছিল না। ছেলেমেয়ে আত্মীয়-স্বজনে ঘর ভর্তি থাকিলেও তাঁহার যেন কেহ ছিল না। সবাই তাঁহাকে ভয় করিয়া চলিত। কিন্তু একমাত্র ধীরেনের সেজদিদি পঙ্কজিনী তাঁকে এতটুকুও ভয় করিয়া চলিতেন না। তখনকার দিনে আমি কিইবা কবিতা লিখিয়াছি। কতবার পঙ্কজিনী দিদি (সেজদি) আমার কোনো কবিতা সুন্দর করিয়া লিখিয়া লইয়া তাঁর বাবাকে পড়িয়া শুনাইয়াছেন। তিনি আমাকে ডাকিয়া লইয়া সস্নেহে বলিয়াছেন, “বেশ হইয়াছে, ভালো হইয়াছে।” এত বড় রাশভারী মানুষ, জীবনে বোধহয় আর কাহারও এমন করিয়া তারিফ করেন নাই। সেই অল্প বয়সে কবিতা রচনায় এই বিরাট ব্যক্তিটির তারিফ পাইয়া যত ভালো লাগিয়াছে, জীবনে বহু সাহিত্যিক সুনাম পাইয়াও তত ভালো লাগে নাই।
শ্রীশবাবুর মেজো ছেলে কিরণদাদা আমাকে বড়ই ভালবাসিতেন। ছেলেবেলা হইতেই তিনি সাধু-সন্ন্যাসীতে অনুরক্ত ছিলেন। আমাকে সঙ্গে করিয়া তিনি তেতালার চিলেকোঠার ঘরে বসিয়া ধ্যান-ধারণা করিতেন। কতদিন সেখানে সারারাত ভরিয়া আমরা নানারকম ধর্ম-পুস্তক পড়িয়াছি। সেকালে স্কুল-কলেজের ছেলেদের মধ্যে বিশেষ করিয়া হিন্দু ছেলেদের মধ্যে ধর্ম-কর্মের প্রতি বড়ই আকর্ষণ দেখা যাইত। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের সবে তিরোধান হইয়াছে। দেশে বিপ্লবীদের মধ্যে গীতা ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রের আলোচনা হইতেছে। তাহা ছাড়া সেই সময়ে ফরিদপুরে জগদ্বন্ধু ঠাকুর বারো বৎসর ধরিয়া একখানা রুদ্ধদ্বার ঘরের মধ্যে বসিয়া সাধনা করিতেছেন। তাঁহার শিষ্যেরা নানারকম ধর্ম-পুস্তক প্রণয়ন করিয়া ছাত্রদের মধ্যে প্রচার করিতেছেন। এই সকলের প্রভাব কিরণদাদার উপর বিশেষভাবে পড়িয়াছিল। তিনি আমাকে নানা উপদেশ দিয়া তাঁহার মনের মতো করিয়া গড়িয়া লইতে চেষ্টা করিতেন। তেতলার সেই ছাদে আমি তাঁহার সঙ্গে ধ্যান-ধারণা করিয়া সময় কাটাই, আর অবসরমতো পড়াশুনাও করি।
চলবে…