স্বদেশ রায়
ইন্দিরা গান্ধী প্রথম বিদেশী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বাংলাদেশে সফর শেষে দেশে ফিরে যাবার সময় বিমান বন্দরে তাকে বিদায় জানাতে যান- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেগম মুজিবও। ইন্দিরা গান্ধী যখন বেগম মুজিবের কাছ থেকে বিদায় নিতে যান সে সময় বেগম মুজিব তাকে বলেন, “ আমাদের কামালের আব্বাকে একটু বলে যান, যেন সময় মতো খাওয়া দাওয়া করে”। ইন্দিরা গান্ধী শান্তিনিকেতনে পড়ার কারণে বাংলা বুঝতেন, তবে ঠিক মতো বলতে পারতেন না। তারপরেও তিনি কনফিউজড হয়ে যান, “কামালের আব্বা” কে সেটা বুঝতে। তাই তিনি কিছুটা বিস্মিত হয়ে পাশে দাঁড়ানো সাংবাদিক এম.আর.আকতার মুকুলের দিকে তাঁকান। এম আর আকতার মুকুল তাঁকে ব্যাখা করেন, বাঙালি নারীরা সাধারণত স্বামীর নাম না বলে, কোন এক সন্তানের বাবা হিসেবে তাকে সম্বোধন করেন। আর উনি বলতে চাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু তো রাজনীতি ও দেশ নিয়ে থাকলেন সারা জীবন। এখন যেন একটু শরীরের দিকে খেয়াল দেন, সময় মতো তাঁর খাবার নেন। এটা একটু আপনি তাঁকে বলে যান। তাঁর বিশ্বাস, আপানার কথা তিনি রাখবেন। তাছাড়া, নিজের স্বামীর ভালোর জন্য এ ধরনের অুনরোধ পরামাত্মীয়র কাছে সব সময়ই এ দেশের স্ত্রীরা করে থাকেন। ইন্দিরা গান্ধী এ কথা শুনে স্বগতভাবে বলেছিলেন, “How wonderful Bengali housewives” ।
দুই দিন আগে যখন ঢাকার উত্তরাতে কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা একজন ব্যক্তিকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কোপাতে যায় তখন বার বার তার স্ত্রী (পরবর্তীতে কোন কোন মিডিয়া আউটলেট বলছে তারা স্বামী স্ত্রী নন, ভিন্ন ধরনের সম্পর্ক আছে তাদের মধ্যে।) যাহোক সেই মানুষটিকে পেছনে রেখে নিজে কোপের সামনে দাঁড়িয়ে বাঁচাতে চায় এই বাঙালি নারী। আর কেউ সেখানে এগিয়ে আসে না। তখন মনে পড়ছিলো ইন্দিরা গান্ধীর বাঙালি গৃহবঁধু সম্পর্কে বেগম মুজিবকে ঘিরে ওই মন্তব্য। ওই ভদ্রমহিলার স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক নিয়ে এ প্রশ্ন উঠেছে ঠিকই কিন্তু এ সত্য কে স্বীকার করতেই হবে, বাঙালি গৃহবঁধুরা এখনও স্বামীর জীবন ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। উত্তরার এ ভদ্র মহিলার পরিচয় নিয়ে যে প্রশ্নই উঠুক না কেন, বাস্তবে অন্য সকল বাঙালি স্ত্রীর কাছে এখনও তার স্বামীই তার পৃথিবী। আর এমনই স্ত্রীর সামনে স্বামী বিপদে পড়ছে এ ধরনের ঘটনা গত কয়েক বছর ধরে এ সমাজে ও রাষ্ট্রে যে চলছে তা নিয়ে তো দ্বিমত নেই কারো। তাই মনে হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের কেউ যখন এগিয়ে আসে না সে সময় একজন স্ত্রী কতক্ষণ তার স্বামীকে রক্ষা করতে পারে? স্ত্রীর এ অসহায়ত্ব মূলত কি একটা বড় প্রতীক নয়?
এই কিশোর গ্যাং এর দৌরাত্ম্য শুধু ঢাকার সব ক’টি এলাকায় নয়- সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যতদূর মনে পড়ে ২০২৪ এর শুরুর দিকে সারাদেশের কিশোর গ্যাং এর দৌরাত্ম্য নিয়ে এই কলামে লিখেছিলাম। তার কয়েকদিন পরে ওই সময়ের সরকার প্রধানও তার একটি ভাষণের বড় অংশ কিশোর গ্যাং নিয়ে বলেন। কিন্তু তারপরেও কিশোর গ্যাং-এর দৌরাত্ম্য বিন্দুমাত্র কমেনি। আর না কমারও কারণ ছিলো, ওই সময়ে বেশিভাগ কিশোর গ্যাং এর নিয়ন্ত্রক ছিলো বিভিন্ন এলাকার জনপ্রিতিনিধরা। এমপি, মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, ই্উপি চেয়ারম্যান, এমনকি সরকারি রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন ইউনিটের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারীরারও নিজ নিজ স্বার্থে কিশোর গ্যাং তৈরি করেছিলেন। পুলিশ ও প্রশাসন ছিলো ওই কিশোর গ্যাং এর কাছে অসহায়। ২০২৪ এর শুরুর দিকে লেখায় এ কথাও লিখেছিলাম।
এ মুহূর্তে ওই জনপ্রতিনিধিরা পলাতক। ওই সময়ের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারাও পলাতক। অথচ কিশোর গ্যাং বহাল তবিয়তে আছে। তাদের কর্মকান্ড নিয়ে শুধু পত্র পত্রিকায় রিপোর্ট হচ্ছে না। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ভিডিও ক্লিপসহ প্রচার হচ্ছে। তাই কিশোর গ্যাং এর এই শক্তিশালী উপস্থিতি থেকে এটা প্রমানিত হয়, নিশ্চয়ই কিশোর গ্যাং এর নিয়ন্ত্রক পরিবর্তিত হয়েছে। এবং নতুন নিয়ন্ত্রকরা আগের নিয়ন্ত্রকদের মতই ক্ষমতাশালী বলে কিশোর গ্যাংরাও স্বদর্পেই তাদের কাজ করে যাচ্ছে।
সৈয়দ মুজতবা আলী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভূট্টোর কূটনীতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, ভূট্টোর বিলেত ফেরত শিক্ষার কূটনীতিতে তিনি না বুঝলেও শেখ মুজিব গাঁয়ের ছেলে, তাঁর কূটনীতিতে তিনি সহজেই বুঝেছিলেন- কারণ, গ্রামের ছেলে শেখ জানতেন, “ কত সের ধানে কত সের চাল হয়” । বাংলাদেশের বেশিভাগ মানুষই গ্রামেরই মানুষ। এই বাংলাদেশ বা অতীতের “পূর্ববাংলা” বাস্তবে এখনও “গ্রাম বাংলা”। এখানকার মানুষ তাই এই কিশোর গ্যাং-এর দর্পপূর্ণ উপস্থিতি দেখে নিশ্চয়ই গ্রামের প্রবাদ অনুযায়ীই হিসেব করবে, “উনুনে চড়ানো ভাতের হাড়ির একটি চাল টিপলেই, বোঝা যায় বাকি চালের অবস্থা”। তাই বাদবাকী অনিয়ম যেগুলো সমাজে ছিলো তাদের যে কেবলমাত্র নিয়ন্ত্রক পরিবর্তন হয়েছে- এটা শিক্ষিত মানুষরা না বুঝলেও গ্রামের মানুষরা ঠিকই বুঝতে পারছেন।
যাহোক, সার্বিক বিষয়ে না গিয়ে এ মুহূর্তে শুধু বলা যেতে পারে, যেহেতু নিয়ন্ত্রক পরিবর্তন হয়েছে, তাই কিশোর গ্যাং থাকবেই। ক্ষমতাবানরা তাদেরকে রাখবে। কিন্তু তারপরেও যে পরিবারের সন্তানরা কিশোর গ্যাং-এর সদস্য হচ্ছে সে পরিবারের পিতা মাতার অসহায়ত্বটা তো অসহনীয়।
তাই কোন কিছু যখন স্বাভাবিক পথে বা রাষ্ট্রীয় এবং সমাজের ক্ষমতার দ্বারা সমাধান হয় না তখনও তো কিছু মানুষকে, কিছু পরিবারকে ভিন্নভাবে বাঁচতে হয় বা টিকে থাকতে হয়। এই টিকে থাকার পদ্ধতিটি পৃথিবীর আদি প্রাণীটি সবাইকে শেখায়। পৃথিবীর আদি প্রাণী এ্যামিবা যখনই তার থেকে শক্তিশালী শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং পরিবেশ তাকে সাহায্য করে না- তখন সে নিজেই নিজের শীররের চারপাশে একটা শক্ত দেয়াল গড়ে তোলে। জীববিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে “অ্যামিবার সিস্ট অবস্থা” । আর ওই সিস্ট এর জোরেই তাকে টিকে থাকতে হয়।
পৃথিবীর দেশে দেশে যে কোন ধরনের সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত মানুষের সংস্কৃতি, সম্পদ, ও জীবনের বৃদ্ধি যখন রাষ্ট্র বা সংখ্যাগুরু দ্বারা আক্রান্ত হয়- তখনও কিন্তু সে এমনই তারা চারপাশে সিস্ট তৈরি করে নেয়। এবং নিজের তৈরি দেয়ালের মধ্যেই বাস করে। আবার অনুকূল পরিবেশ পেলে সিস্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসে, যেমনটি আসে অ্যামিবা।
অ্যামিবাকে এই সিস্ট তৈরি করার আগে তাকে বুঝতে হয়, তার জন্যে প্রতিকূল পরিবেশ কোন কোন দিক থেকে আসছে। বাংলাদেশের মানুষের- বিশেষ করে যে ধরনের পরিবার গুলো থেকে এই কিশোর গ্যাং -এর সদস্য হচ্ছে তাদেরকেও এ্যামিবার মতো বুঝতে হবে, কোন পরিবেশের বিপরীতে তারা সিস্ট তৈরি করবে?
প্রতিটি পরিবার বা দেশের মানুষ বুঝতে পারছে, রাষ্ট্র ক্ষমতা ও রাষ্ট্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক বা রাষ্ট্র ক্ষমতার আনুকূল্য প্রাপ্ত রাজনীতি- এই সব কিশোর বা সদ্য কৈশোরোর্ত্তীন তরুণকে কিশোর গ্যাং এর সদস্য তৈরি করছে। তাই পরিবারগুলোকে তাদের সন্তানের জন্যে এমন একটি দেয়াল তৈরি করতে হবে- যাতে তাদের সন্তানরা ওদিকে না যায়।
তবে এই রাষ্ট্রক্ষমতা বা রাষ্ট্র ক্ষমতার আনুকূল্যপ্রাপ্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইরেও আরো কয়েকটি সমস্যা এর সঙ্গে যোগ হয়েছে। যেমন কোভিডের কারণে দুই বছর পড়াশুনা বন্ধ থাকার ফলে একটি বড় অংশ ছেলে মেয়ে কম পড়াশুনা বা পড়াশুনা না করার মধ্যে ঢুকে গেছে। অন্যদিকে কোভিডের মধ্য দিয়ে তাদের সময়ও চলে যায়, শিক্ষাগ্রহন হয়না। কিন্তু শেষেরটা অর্থাৎ তাদের যে শিক্ষা গ্রহন হয়নি, সে চিন্তা না করে শুধু মাত্র সময়ের চিন্তা করে তাদের শর্ট কোর্সে পরীক্ষা নেয়া হয়। যা মূলত কোন পরীক্ষা ছিলো না।
এ থেকেই কিন্তু বাংলাদেশে স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনা ছাড়া, পরীক্ষা ছাড়া পাশ করার একটি ছোঁয়াছে রোগের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। যার চরম প্রকাশ দেখা যাচ্ছে গত কয়েকমাস জুড়ে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও দীর্ঘদিন ধরে দেশের শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন, রাশেদা কে চৌধুরি বলেছেন, সাম্প্রতিককালে সুচিন্তিতভাবে শিক্ষা নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। সবগুলো সিদ্ধান্ত হয়েছে দাবী দাওয়ার ভিত্তিতে। আর এই সব দাবী দাওয়ার রুটে গেলে দেখা যাবে, ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা ও প্রকৃত পরীক্ষা দেয়ার প্রতি অনীহা।
আর কিশোর ও তরুণরা যদি লেখাপড়া না করে তাহলে তো তারা বখে যাবেই। বখে যাওয়া কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণীরা যে কোন অন্যায় করতে পারে। কোন গোষ্টি স্বার্থের জন্য কেউ তাদের ভালোও বলতে পারে। কিন্তু একটি পরিবারের জন্যে সে যে কতবড় কান্না এবং ভবিষ্যতের একটি ভালো রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য সে যে কত বড় বোঝা- তা আর কিছুদিন পরেই স্পষ্ট হবে। আর এর ফল ভোগ করতে হবে রাষ্ট্র ও জাতিকে দীর্ঘ সময় ধরে।
এই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও একটি অশিক্ষিত কিশোর ও তরুণ শ্রেণী কিশোর গ্যাং-এ যোগ দিচ্ছে। এর মূল কারণ, বেকারত্ব। দীর্ঘদিন ধরে দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। আর গত কয়েক মাসে একের পর এক কারখানা ও ছোট খাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সারা দেশে বন্ধ হয়ে এই শ্রেণীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বেকার হয়েছে। তাই আবার গ্রাম বাংলার সেই প্রবাদে যেতে হয়, “বেকার বা অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা” । আর বেকার মস্তিষ্কই তাদেরকে মানুষ থেকে শয়তানির প্রবৃত্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তবে কখনও কখনও একটি পরিবারের কাছে রাষ্ট্র ও সমাজের থেকে তার নিজ পরিবারকেই বড় মনে করতে হয়। তাই পরিবারের স্বার্থে, নিজের সন্তানের স্বার্থে তাকে এখন অ্যামিবার সিস্ট তৈরির পথ নিতে হবে। হ্যা, রাষ্ট্র ও সমাজ নামক বিশাল স্রোতের সামনে একটি পরিবার বা একজন পিতা মাতা সকলে অসহায়ের সাগর তীরে দাঁড়িয়ে। বাঙালি গৃহবঁধু তার স্বামীকে নিজের আড়ালে রেখে বাঁচানোর জন্যে মহাসাগরের আকৃতির থেকেও বড় অসহায়ত্ব নিয়েও চেষ্টা করে এমনি সব বিপদে। এ মুহূর্তে তাই পরিবার গুলো’র জন্য অসহায় বাঙালি গৃহবঁধুর পথ ছাড়া এখন আর কিবা খোলা আছে? আর পথ খোলা অ্যামিবার মত সিস্ট তৈরি করে নিজেকে নিজের দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে ফেলা। হয়তো কেউ লালনের কথা নিয়ে বলতে পারেন, “ সময় গেলে সাধন হবে না” । সময় যখন ভারী হয়- সাধন কি তখন পাথরের গভীর মুখ লুকায় না ?
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ, The Present World.
Leave a Reply