সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
১। উচ্চ বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে লোকজনকে থাইল্যান্ডে এনে পরে জোরপূর্বক মিয়ানমারে পাচার করা হয়, যেখানে তারা প্রতারণামূলক কাজে বাধ্য হন।
২। আন্তর্জাতিক চাপে থাই কর্তৃপক্ষ সীমান্ত নজরদারি বাড়িয়ে উদ্ধার অভিযান জোরদার করেছে, যার ফলে সাম্প্রতিক অভিযানে ৩৫ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে।
৩। কঠোর নিরাপত্তার কারণে প্রতারণা চক্রগুলো মিয়ানমার থেকে লাওস ও কম্বোডিয়ায় ঘাঁটি স্থানান্তরের চেষ্টা করছে, যা থাইল্যান্ডের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
থাইল্যান্ড সম্প্রতি মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় কাজ করে এমন প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান আরও শক্তিশালী করেছে। এই চক্রগুলো মূলত বিপুল বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষজনকে থাইল্যান্ডে নিয়ে আসে। পরে তাদের অজান্তে সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারের গভীর জঙ্গল বা কিছু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে আটকে রাখা হয়। সেখানে জোর করে বিভিন্ন প্রতারণামূলক কাজে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়।
. নিখোঁজ ও প্রতারণার শিকার
সঞ্জয় (ছদ্মনাম): ২২ বছরের এক বাংলাদেশি যুবক। গত সেপ্টেম্বর ব্যাংককে পৌঁছে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানান, তার ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং শিগগিরই অফিসের কাজে নিয়ে যাওয়া হবে। এরপর এক মাসেরও বেশি সময় তার কোনো খবর মেলেনি। পরে সঞ্জয় গোপনে জানিয়েছেন, তাকে থাইল্যান্ডের জঙ্গল পেরিয়ে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে উচ্চ আয়ের কাজের লোভ দেখানো হলেও, সেখানে বাস্তবে প্রতারণামূলক কাজে যুক্ত হতে বাধ্য করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক উদ্ধারের ঘটনা
চলতি সপ্তাহে সঞ্জয়সহ মোট ৩৫ জনকে মিয়ানমারের ওই প্রতারণা চক্র থেকে উদ্ধার করা হয়। তবে তাদের থাইল্যান্ডে ফেরানোর বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। মিয়ানমারের সামরিক সরকার, থাইল্যান্ডের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং কিছু জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যকার আলোচনা এখনো জটিল অবস্থায় আছে। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে অন্তত ২০টি দেশের হাজার হাজার নাগরিক এভাবে আটক রয়েছেন। এখনো আনুমানিক ৭০০০ মানুষ এই চক্রগুলোর হাতে বন্দি।
সীমান্ত এলাকায় বড় ধরণের অভিযান
থাই কর্তৃপক্ষ জানুয়ারি থেকে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়িয়েছে। চীনের পক্ষ থেকেও চাপ ও সহায়তা থাকায় থাইল্যান্ড এখন মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী সন্দেহজনক অঞ্চলগুলোতে কড়া নজর রাখছে। সম্প্রতি ডেমোক্রেটিক কারেন বৌদ্ধ আর্মি (ডিকেবিএ) নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ২৬০ জনেরও বেশি মানুষকে উদ্ধার করে থাইল্যান্ডের হাতে তুলে দেয়। তাদের মধ্যে এথিওপিয়া, ফিলিপাইন, ব্রাজিল, তাইওয়ান, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের নাগরিকও ছিলেন।
কৌশল ও প্রতারণার ধরন
অধিকাংশ ভুক্তভোগীই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা সরাসরি মেসেজের মাধ্যমে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রস্তাব পেয়ে থাইল্যান্ডে আসেন। তারা সাধারণত বৈধ ভিসায় ব্যাংককে প্রবেশ করে পর্যটক সেজে অবস্থান করেন। এরপর সীমান্ত এলাকায় (মেয় সোত নামের শহর, উদাহরণস্বরূপ) গিয়ে অজান্তে মিয়ানমারে পাচার হন। অভিযোগ রয়েছে যে, এসব অঞ্চলের কিছু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনা অপরাধচক্রের বিনিয়োগ রয়েছে।
চীনের ভূমিকা ও থাইল্যান্ডের উদ্বেগ
এই চক্রের হাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চীনা নাগরিকও জিম্মি আছেন। চীনা সরকারের চাপের মুখে থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সরবরাহ বন্ধের মাধ্যমে চক্রগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে, চীনের ভ্রমণ-সহজীকরণ নীতির আওতায় বহু চীনা পর্যটক বিনা ভিসায় থাইল্যান্ডে প্রবেশ করেন। থাই কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করছে, কিছু অপরাধচক্র এই সুযোগের অপব্যবহার করছে।
আন্তর্জাতিক চাপে সক্রিয় পদক্ষেপ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক Trafficking in Persons (TIP) প্রতিবেদনে ভালো অবস্থান ধরে রাখতে থাইল্যান্ড বাড়তি সতর্কতা নিচ্ছে। প্রতিবেদনটি সাধারণত জুন মাসে প্রকাশিত হয় এবং এতে একটি দেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। এ কারণেই থাইল্যান্ড এখন অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজে আরও জোর দিয়েছে।
উদ্ধারকৃতদের পরিচয় যাচাই ও ভবিষ্যৎ
উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের অনেকেই তদন্তের স্বার্থে প্রাথমিকভাবে আটক অবস্থায় ছিলেন, যাতে তাদের আসল পরিচয় ও ঘটনার বিশদ তথ্য সংগ্রহ করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে যখন কেউ দাবি করেন—তার মতো মানুষ জনবহুল বিমানবন্দর এলাকা থেকেই অপহৃত হয়েছেন।
অন্যদিকে সঞ্জয়ের মতো বেশ কয়েকজন এখনো মিয়ানমারে ডিকেবিএ গোষ্ঠীর আলাদা ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। অনেকেরই ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে জানা গেছে। সেখানে আরও ৯ জন বাংলাদেশি এবং প্রায় ৮০ জন ফিলিপিনো নিখোঁজ রয়েছেন বলে তথ্য উঠে এসেছে।
চক্রের অবস্থান পরিবর্তন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
এখনকার কঠোর অভিযানের মুখে প্রতারণা চক্রগুলো মিয়ানমারের সীমান্ত ছেড়ে লাওস ও কম্বোডিয়ায় ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। থাই সেনা ও পুলিশের দলগুলো সীমান্ত এলাকায় টহল বাড়িয়েছে, যাতে তারা এই স্থানান্তরের পথ বন্ধ রাখতে পারে। একইসঙ্গে লাওস ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে থাকা সীমান্ত পয়েন্টগুলোতেও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে, যাতে থাইল্যান্ডকে ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ হিসেবে আর ব্যবহার করতে না পারে।
শেষ কথা
এশিয়াজুড়ে প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে বহু মানুষ উচ্চ বেতনের লোভে বিদেশে পাড়ি জমায়, যা এই ধরনের অপরাধচক্রের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি বাড়ায়। থাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক কঠোর অভিযান অবশ্যই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে মিয়ানমারের ভেতরে এবং আশপাশের অঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করা এখনো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে উদ্ধারকাজ অব্যাহত রাখা এবং ভুক্তভোগীদের দেশে ফেরানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে।