সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
- রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বিদেশি সাহায্য কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ বর্তমানে আর্থিক চাপের মধ্যে রয়েছে
- যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সহায়তায় বড় অনুদানদাতা ছিল, কিন্তু বর্তমানে তারা অনুদান স্থগিত করেছে
- ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় অনুদানের পরিমাণ ও প্রকৃত চাহিদার মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে
- আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও উচিত, এই বিপুল বোঝা শুধু বাংলাদেশের ওপর না চাপিয়ে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা
এমনিতেই নানান কারণে রোহঙ্গিাদের জন্যে বিদেশী সাহায্য কমে আসছিলো। তারপরে মার্কিন সাহায্য বন্ধ’র প্রভাব পড়েছে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও। ফলে বাংলাদেশ বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার জন্য আরও বেশি আর্থিক ও কূটনৈতিক সহায়তা চেয়ে আসছে। ঢাকায় ইইউ-বাংলাদেশ যৌথ কমিশনের সাম্প্রতিক বৈঠকেও এই বিষয়ে জোর দেওয়া হয়।
যদিও প্রশ্ন থেকে যায়—নতুনভাবে ইইউর কাছ থেকে আসলে কী প্রত্যাশা রয়েছে, আর কেনই বা এটি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে? তাছাড়া ইইউ এর সাহায্য বাড়ানোর সমর্থও বা কতটুকু আছে। এ কারণে অনেক কূটনীতিক মনে করেন এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে ভারত এবং তার সঙ্গে চায়নাকে সংযুক্ত করা প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান স্থগিত: কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই রোহিঙ্গা সহায়তায় বড় অনুদানদাতা। কিন্তু সম্প্রতি তারা সব বিদেশি অনুদানে সাময়িক ‘স্টপ-ওয়ার্ক’ নির্দেশ জারি করেছে। এর প্রভাবে আগে থেকেই তহবিল-সংকটে থাকা রোহিঙ্গা সহায়তার পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর রোহিঙ্গা সহায়তা পরিকল্পনা (জেআরপি) অনুযায়ী:
- ২০২৪ সালে চাওয়া মোট ৮৫২.৪ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৫৪৮.৯ মিলিয়ন ডলার জোগাড় হয়েছিল (৬৪.৪%)।
- যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে দিয়েছে ৩০১ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ মোট সংগ্রহের ৫৫%।
- ইইউর অবদান ২০২৪ সালে ছিল প্রায় ৬২.৪৭ মিলিয়ন ডলার (১১%)।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২৫ সালে প্রায় ৯৩৪ মিলিয়ন ডলার লাগবে এই সংকট মোকাবিলায়। ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার (এর মধ্যে ২.১ বিলিয়ন শুধু বাংলাদেশে) দিয়েছে। সুতরাং তাদের অনুদান বন্ধ হওয়া মানে বাংলাদেশের ওপর আর্থিক চাপ অনেক বাড়বে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপে কেন?
বাংলাদেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি উচ্চমাত্রায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ধীর, আর রাজস্ব আয় আশানুরূপ বাড়ছে না। উপরন্তু বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ও বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বহন করা দেশটির পক্ষে ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা কার্যক্রমে সহায়তা পেতে বিশ্বব্যাংক থেকে ৪০৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ কতদিন এই বোঝা বয়ে নিতে পারবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
জাতিসংঘের সতর্কতা
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুইন লুইস-এর বরাতে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান স্থগিতের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখনও বহুলাংশে সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক অনুদান ছাড়া এই সেবা সচল রাখা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
জাতিসংঘ জানায়:
- বিভিন্ন সেবা কার্যক্রম—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন ও সুরক্ষা—বন্ধ বা স্থগিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
- রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
- অনুদানের ঘাটতির কারণে অনেক প্রকল্প বন্ধ হওয়ায় সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
কেন তহবিল সংকট তীব্র হচ্ছে?
২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহযোগিতা করলেও, প্রতি বছর অনুদানের পরিমাণ ও প্রকৃত চাহিদার মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে।
- ২০১৭ সালে দরকারি তহবিল ও প্রাপ্ত অনুদানের মধ্যে ফারাক ছিল ২৭%।
- ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১%-এ।
এই ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ভাসানচরে অবকাঠামো গড়ে তুলতে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। তবু সমস্যা সমাধান হচ্ছে না, কারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ক্রমাগত বাড়ছে এবং মিয়ানমারে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ায় আরও অনুপ্রবেশ ঘটছে।
এনজিও কর্মী ছাটাই ও সেবা সংকোচন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নেওয়ার পরপরই ৯০ দিনের জন্য সব বিদেশি সহায়তা স্থগিতের নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। এর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে।
- আইসিডিডিআর,বি প্রায় ১,০০০ কর্মীকে ছাটাইয়ের নোটিশ দিয়েছে।
- যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক অর্থায়নপুষ্ট আরও কয়েকটি সংস্থা ইতোমধ্যে কর্মী ছাটাই শুরু করেছে।
- জাতিসংঘ ও বিভিন্ন এনজিওর কর্মকর্তারা বলছেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরের সেবা।
- স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবিকা নির্বাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলোর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।
এদিকে ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, ২০২৫ সালে তারা ১৮% কর্মী ছাটাইয়ের পরিকল্পনা করেছে। হিউম্যানিটি ইন্টারন্যাশনাল ইতোমধ্যে ১০০ জন কর্মী কমিয়েছে। আরও অনেক সংস্থা কার্যক্রম সীমিত করার কথা ভাবছে।
বাংলাদেশের বর্তমান ব্যয় ও ভবিষ্যৎ প্রশ্ন
- ২০১৭ সালের পর থেকে বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারে ৩৩টি শিবিরে ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে।
- প্রতি বছর সেখানে প্রায় ৩২ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে; ২০১৭ সালের পর থেকে জন্মেছে মোট ২ লাখের বেশি শিশু।
- ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে।
বাংলাদেশ সরকার বা স্থানীয় সংস্থাগুলোকে ছাড়াও বিশ্বব্যাংক থেকে রোহিঙ্গা সহায়তায় ৪০৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপে থাকা বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে কতটা অর্থের জোগান দিতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
তহবিলের বিশাল ঘাটতি কে পূরণ করবে?
বাংলাদেশের আশা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন করে বড় আকারে এগিয়ে আসবে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় বেড়েছে, এবং যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের সামরিক খাতে আরও বেশি অর্থ বিনিয়োগ করুক।
একজন প্রাক্তন কূটনীতিক বলেন, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিকল্প সীমিত। তাছাড়া ইইউর সাহায্য বাড়ানোর সত্যি অর্থে সমর্থ নেই। তাই ইইউর পাশাপাশি চীন ও ভারতকেও এই সংকটে সম্পৃক্ত করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। আর এজন্য ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা প্রয়োজন ও চায়নাকে আস্থায় নেয়া অতি জরুরী। তবে তার মতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও উচিত, এই বিপুল বোঝা শুধু বাংলাদেশের ওপর না চাপিয়ে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা।
উপসংহার
রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য আর্থিক ও মানবিক চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান স্থগিতের বিষয়টি পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে। ইইউ, চীন, ভারতসহ বৈশ্বিক শক্তিগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা করে যাওয়া বাংলাদেশের পক্ষে ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।