জার্মানির সার্বিক সংসদীয় নির্বাচন, যা রবিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে, পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা এবং এর কেন্দ্রীয় ভিত্তি হিসেবে কাজ করা ট্রান্সআটলান্টিক জোটের সমর্থকদের মধ্যে সমানভাবে উচ্ছ্বাস ও আশঙ্কা নিয়ে এসেছে।
“ফ্রিডরিখ মার্জ এবং তাঁর [সেন্টার-রাইট] ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটস (সিডিইউ)-এর বিজয় … জার্মানিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সাফল্যের ভঙ্গুর ভিত পুনর্গঠনের একটি সুযোগ করে দিল,” ফিনান্সিয়াল টাইমসের সম্পাদকীয় বোর্ড লিখেছে। “ইউরোপের জন্য মার্জকে সফল হওয়া খুবই জরুরি,” পত্রিকাটি মন্তব্য করেছে।
কারণগুলো স্পষ্ট। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি উষ্ণতা দেখিয়েছে, ইউরোপীয় মিত্রদের পাশ কাটিয়েছে এবং ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে। সে অনুযায়ী, মার্জ—যিনি এখন জার্মানির পরবর্তী চ্যান্সেলর হওয়ার পথে—নিজের বিজয় নিশ্চিত করার পর বললেন যে ইউরোপকে “যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতা” অর্জন করতে হবে।
সিডিইউ-এর এই জয় কিছু মানুষের কাছে স্বস্তির কারণ হয়েছে। দ্য স্পেক্টেটরের কাটিয়া হোয়ার মনে করেছিলেন, জার্মানির রাজনৈতিক অচলাবস্থার সময়টা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ সম্পর্ক নতুনভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে। ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনের কারণে চ্যান্সেলর ওলাফ শলজ ও তাঁর ত্রিদলী জোট সরকার কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল; এদিকে প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে শলজের অনীহা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। হোয়ারের যুক্তি, মার্জ ইউরোপীয় নিরাপত্তায় জোর দিতে পারবেন এবং ইইউ নেতৃত্বে জার্মানিকে আবারও গুরুত্বপূর্ণ আসনে ফিরিয়ে আনবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিম জার্মান সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে সিডিইউ কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিয়েছিল, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ন্যাটোর প্রতিরোধের প্রধান স্তম্ভ ছিল। এখন সিডিইউ নতুন সরকার গঠনে অন্য কোনো মূলধারার দলের সঙ্গে জোট গঠনের আলোচনা করবে।
পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা ক্রমশ যে নড়বড়ে হয়ে উঠছে, সেটির সমর্থকদের কাছে এটি ছিল সুখবর। কিন্তু খারাপ খবরটির ধাক্কা আরো বড়: ডানপন্থী অলটারনেটিভ ফর জার্মানি (আএফডি) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট (২০.৮%) পেয়েছে, যেখানে সিডিইউ পেয়েছে ২৮.৬%। “২০২১ সালের নির্বাচনে দলটি পেয়েছিল ১০.৩%, অর্থাৎ এখন প্রায় দ্বিগুণ,” সিএনএন-এর সোফি ট্যানো ও নাদিন শমিড্ট লিখেছেন। নির্বাচনী মানচিত্রে পুরনো ভৌগোলিক বিভাজন আবারও স্পষ্ট: বিবিসি’র পল কার্বি দেখিয়েছেন, পূর্ব জার্মানি প্রায় পুরোটাই আএফডি-র হালকা নীল রঙে চিহ্নিত, আর পশ্চিম জার্মানি প্রায় পুরোটাই সিডিইউ-র কালো রঙে।
এই নির্বাচনে আসল নাটক ছিল কেন্দ্রপন্থী দলগুলোর—সিডিইউ, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস (এসপিডি) ও ফ্রি ডেমোক্র্যাটস—অবনমন, হেনরি ওলসেন ব্রাসেলস সিগনালে লিখেছেন। তাঁর বিশ্লেষণ মতে, সিডিইউ জিতলেও দলটির ভোট শতাংশ কিছু পূর্বাভাসের তুলনায় কম ছিল।
অভিবাসনবিরোধী ও ইসলামবিরোধী আএফডি এখন জার্মানির মূলধারায় ঢুকে পড়েছে। বার্লিন-ভিত্তিক সাংবাদিক পল হকেনোস ফরেন পলিসিতে লেখা এক মতামত নিবন্ধে উল্লেখ করেন, অন্য দলগুলোও তাদের কাছ থেকে কিছু অভিবাসন-নীতি ধার নিয়েছে। “এটাই জার্মানি: একটি দেশ যা গণতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক চরম রক্ষণশীলদের মধ্যে বিভক্ত,” লিখেছেন হকেনোস। “আএফডির দৃষ্টিতে, রক্ষণশীলদের সঙ্গে (চরম ডান) জোট গড়া খুবই যৌক্তিক। অভিবাসন প্রসঙ্গে তাদের মধ্যে বিস্তৃত মিল রয়েছে, ভোটারদের উদ্বেগও একরকম। কিন্তু খ্রিস্টীয় রক্ষণশীলরা এখনও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে এমনটা হবে না,” কারণ জার্মানির মূলধারার দলগুলো বরাবরই চরম ডানপন্থী দলের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে। “‘আর কখনো নয়’—এটাই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের প্রজন্মের প্রতিশ্রুতি যে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি আর ফিরে আসবে না। অল্প কিছুদিন আগে জার্মানির বিভিন্ন স্থানে ডানপন্থী বিরোধী বিক্ষোভে এক প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল: ‘আর কখনো নয় এখনই।’”
কঠিন স্রোতে ইউক্রেন
ইউক্রেনের অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। ট্রাম্প সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন এবং জেলেনস্কির বিরুদ্ধাচরণ করছেন—তিনি জেলেনস্কিকে ভুলভাবে “স্বৈরশাসক” বলে অভিহিত করছেন এবং হুমকি দিচ্ছেন যে শান্তিচুক্তি না করলে তাঁর দেশ হারাতে হবে।
ফারিদের যুক্তি, এটি মূলত ব্যক্তিগত আক্রোশের ফল। জেলেনস্কি ট্রাম্পের সেই কুখ্যাত ফোনালাপে জো ও হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় তদন্তের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যা ট্রাম্পের প্রথম অভিশংসন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে ছিল। ফারিদ বলেন, ট্রাম্প সম্ভবত এটাকে নিজে অপমানিত হওয়া হিসেবে দেখেছেন। তবু, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের অ্যান্ড্রু ই. ক্রেমার প্রশ্ন তুলেছেন, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জেলেনস্কির পাল্টা অবস্থান সঠিক ছিল কি না: “ট্রাম্প মিথ্যা অভিযোগ তুলেছিলেন যে ইউক্রেনই রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছে, সেই অভিযোগের জবাবে জেলেনস্কি তাকে প্রকাশ্যে সংশোধন করেন এবং বলেন যে তিনি ক্রেমলিন-সৃষ্ট বিভ্রান্তির জালে আটকা পড়েছেন। এটি কি জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় জরুরি ছিল, নাকি একজন ক্ষমতাধর নেতার সঙ্গে—যিনি কোনো সমালোচনা পছন্দ করেন না এবং কার্যত ইউক্রেনের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন—আরও কূটনৈতিকভাবে সতর্ক ব্যবহার করা উচিত ছিল?”
ইউক্রেন ও ইউরোপ রাশিয়ার সঙ্গে কোনো শান্তিচুক্তি নিয়ে শঙ্কিত হলে, সেটার যথেষ্ট কারণ আছে। রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর মিনস্কে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে আবার হামলা শুরু করে। তাই ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রয়োজনীয়তা—বিশেষ করে ন্যাটোর কাছ থেকে—ইতিমধ্যেই স্বীকৃত। “এতসব উথাল-পাথালে এখনও পর্যন্ত কোনো চুক্তির লক্ষণ নেই,” দ্য ইকোনমিস্ট বলছে। “কিন্তু এখন পর্যন্ত যা ঘটছে, তা ইউক্রেনের সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কাই দৃঢ় করছে। ইউক্রেনের অনেক নীতিনির্ধারক মনে করছেন, ট্রাম্প শিবিরের বক্তব্য রাশিয়ান ফাঁদের অনুরূপ: নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া যুদ্ধবিরতি, সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন—যা ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ সংহতি ধ্বংস করবে। ‘মিস্টার ট্রাম্প সম্ভবত জেলেনস্কিকে সরিয়ে দিতে চান; তিনি কখনোই জেলেনস্কিকে পছন্দ করেননি এবং তাকে জটিল মনে করেন,’ বললেন এক সাবেক কূটনীতিক। ‘এটি নির্বাচনের বিষয় নয়, বরং জেলেনস্কিকে সরানোর বিষয়।’”
সামরিক স্তরে দেখলে, কেউই এই যুদ্ধ স্পষ্টভাবে জিতছে না—অবসরপ্রাপ্ত অস্ট্রেলীয় সেনা মেজর জেনারেল মিক রায়ান ফরেন অ্যাফেয়ার্সে লিখেছেন। রাশিয়ার জনসংখ্যা ও অর্থনীতি বড় হলেও, ইউক্রেন যুদ্ধ বেশি দক্ষতার সঙ্গে চালাচ্ছে। “ইউক্রেন এখন ভাবছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না—সম্প্রতি জেলেনস্কি বলেছেন, সেই সম্ভাবনা কম। কিন্তু যদি পুতিন-ট্রাম্প চুক্তি ইউক্রেনের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব হয়, তাহলে তাদের একাই লড়তে হবে। … কোনো পক্ষই অনির্দিষ্টকাল ধরে বিপুল হতাহত মেনে নিতে পারবে না। তবে দুই পক্ষেরই কিছু নির্দিষ্ট সুবিধা রয়েছে। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে সেটি হলো অনুপাত: তারা রাশিয়ানদের তুলনায় অনেক বেশি সামরিক ক্ষতি সাধন করছে। এর ফলে আগামি মাসগুলোতে রাশিয়ার অগ্রসরতা শ্লথ হয়ে আসতে পারে। … ইউক্রেনের মানুষের বিরাট আত্মত্যাগ তাদের স্বাধীনভাবে রাশিয়ান প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজের ইতিহাস ও সংস্কৃতি উদযাপন করার পূর্ণ অধিকার দিয়েছে। তবে সেটি অর্জনে তাদের আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ধারাবাহিক সহায়তা প্রয়োজন হবে। ইউক্রেন তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ৪০ শতাংশ নিজেরাই তৈরি করতে পারলেও এখনও অনেক কিছুই দরকার, যা তাদের অংশীদারদের সরবরাহ করতে হবে।”
সহায়তার সমাপ্তি?
ট্রাম্প প্রশাসন যখন ইউএসএইড প্রায় বিলুপ্ত করে দিতে চায় এবং সব ধরনের মার্কিন বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগিতা বন্ধের পথ নিচ্ছে, তখন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন খাতে পেশা খোঁজার বাসনা থাকলে তরুণদের বেশি করে স্থানীয় বা বেসরকারি খাতের দিকে ঝুঁকতে হবে—বিশেষত নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। কেন ওপালো তাঁর “অ্যান আফ্রিকানিস্ট পারস্পেকটিভ” নামের সাবস্ট্যাক নিউজলেটারে এ কথা লিখেছেন। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক সাহায্যের ধরন দীর্ঘমেয়াদে বদলে যেতে পারে।
এর আগেও ওপালো আফ্রিকায় ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে অপেক্ষাকৃত আশাবাদী ছিলেন। ফোরেন অ্যাফেয়ার্সে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে লেখা এক প্রবন্ধে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, কূটনৈতিক সাহায্যের বদলে সরাসরি ব্যবসায়িক চুক্তিগুলো আফ্রিকার দুর্বল অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলোকে বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে। তাঁর ভাষায়, এটি অনুদাননির্ভর ব্যবস্থার অচলাবস্থায় একটা কার্যকর ধাক্কা দেবে।
সাবস্ট্যাক নিউজলেটারে ওপালো লেখেন, “সবাইকে এটা মেনে নিতে হবে যে আমরা সহায়তার যুগের সমাপ্তির মুখে এবং সামনে যা আসছে তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুত হতে হবে। আগে যা ছিল, তা আর ফিরিয়ে আনার কোনো সুযোগ নেই—স্বাস্থ্য ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক ফল পাওয়া গেলেও সামগ্রিকভাবে এটি নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে কাঠামোগত পরিবর্তন বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারেনি। তাছাড়া, বর্তমানে যে সহায়তা কর্তন শুরু হয়েছে, তার বড় অংশই স্থায়ী হবে; দাতাদেশগুলো এই সামান্য বাকি সহায়তাও তাদের সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করবে। … সুতরাং যারা এখনো সহায়তার ওপর নির্ভরশীল, তারা যদি পথ না পাল্টায়, তাহলে বিভিন্ন দিক থেকে চাপে পড়তে হবে।”