সেজদি
এবার সেজদির বর গণেশবাবু কলিকাতা হইতে বি এ পাশ করিয়া আসিলেন। আর সেজদিকে শ্বশুরবাড়ি যাইতে হইবে না। গণেশবাবু এখানে থাকিয়াই চাকরি-বাকরির চেষ্টা করিবেন।
আমি যে-ঘরে থাকিয়া পড়াশুনা করি, সেজদিরা থাকেন তারই পাশের ঘরে। আমাদের পড়াশুনা শেষ হইলে মাঝে মাঝে সেজদি আসিয়া আমাদের সঙ্গে গল্প করেন।
সেবার সেজদির খুব আমাশা হইল। ঘণ্টায় ঘণ্টায় তাঁহাকে বাথরুমে যাইতে হয়। সেই বাথরুম শোয়ার ঘর হইতে অনেক দূরে। সঙ্গে হারিকেন ধরিয়া দাঁড়াইয়া থাকি বাথরুমের বাহিরে। হাত-মুখ ধুইয়া সেজদি আবার ঘরে প্রবেশ করেন। রাত গভীর হইতে গভীরতম হয়। পূর্ব আকাশে উদয়তারা দেখা দেয়। চারিদিকে জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নাই। অন্ধকারে হারিকেন ধরিয়া থাকি। সেজদির জন্য রাত জাগিতেও ভালো লাগে। এই নিস্তব্ধ রজনী সাক্ষ্য হইয়া থাকে এই দুইটি রক্তসম্পর্কহীন ভ্রাতা-ভগিনীর স্নেহমমতার; সেজদির বর গণেশবাবু তখনও অঘোরে ঘুমাইয়া। এত কথা আজ এমন করিয়া লিখিতাম না। সেকালে মানুষের প্রতি মানুষের কত বিশ্বাস ছিল; আজকের বিশ্বাসহীন সমাজের লোকেরা একথা জানিয়া রাখুক, এইজন্যই এ প্রসঙ্গের অবতারণা।
সেজদির একটি মেয়ে হইল। এমন সুন্দর ফুলের মতো রাঙা টুকটুকে মেয়েটি। হঠাৎ তার অসুখ হইল। এই অসুখে আমি সেজদির সঙ্গে সারারাত জাগিতাম। মেয়েটি মৃত্যুর কোলে চলিয়া পড়িল। একমাত্র আমি আর সেজদিই তার জন্য কাঁদিলাম। আত্মীয়-স্বজনেরা বলিল, “কুলীনের ঘরের মেয়ে। মরিয়া ভালোই হইয়াছে। এই মেয়ে বিবাহ দিতে বরকে মোটা টাকার পণ দিয়া বাপ-মাকে ফতুর হইতে হইত।” সেকালে হিন্দুসমাজের পিতা-মাতা মেয়ে হইলে মুখ ভার করিয়া বসিয়া থাকিতেন। কারণ মেয়ের বিবাহে বাপ-মাকে গহনাসহ বহু টাকা জামাইকে পণ দিতে হয়। এখনও হিন্দুসমাজে এই রীতির পরিবর্তন হয় নাই। আমাদের মুসলিম সমাজে আগেকার দিনে মেয়ের বিবাহ দেওয়ায় বাপ-মাকে কোনো সমস্যারই সম্মুখীন হইতে হইত না। আমরা পরপর তিন ভাই জন্মিলাম। মাঝখানে, আমার একটি বোন মারা
গেল। একটি মেয়ের জন্য মা আমার আকুলি-বিকুলি করিতেন। বাড়িতে চুড়িওয়ালা আসিলে মা অন্যান্য প্রতিবেশিনীদের মতো মেয়ের জন্য চুড়ি কিনিতে পারিতেন না। আমার ছোট ভাই সৈয়দ উদ্দীনকে ছেলেবেলায় মা চুড়ি পরাইয়া সেই শখ মিটাইতেন। এরপর আমার বোনদের জন্ম হইলে মা’র সেই সাধ ষোলকলায় পূর্ণ হইয়াছিল। সেকালে আমাদের সমাজে এমনই মেয়ের আদর ছিল। আজও বোধহয় তাহা কমে নাই।
সেজদি সুন্দর গান গাহিতে পারিতেন। তাঁর গাওয়া একটি গান আজও আমার মনে পড়িতেছে:
“কেন দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও-পারে, আমার সুরগুলি পায় চরণ তোমার পাইনে তোমারে।”
আজও যেন সেজদির কণ্ঠে এই গান শুনিতে পাইতেছি। বছর বিশেক আগে সেজদিরা পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া গিয়াছেন। কোথায় কোন ঠিকানায় তাঁহারা আছেন জানি না। বহুকাল তাঁহাদের সঙ্গে দেখাশোনা হয় না। আজও দুর্গাপূজার ঢোলের বাদ্য শুনিলে আমার সেজদি আর মেজদিকে আমি মানসচক্ষে দেখিতে পাই। কপালে কাঁচপোকার ফোঁটা, মাথায় সুন্দর সিন্দুরের শোভা আর আলতায় রঞ্জিত রাঙা টুকটুকে পা দু’খানি। আর কি জীবনে তাঁহাদের সঙ্গে দেখা হইবে? সেই স্নেহ-ভরা ভাই ডাকটি শুনিবার জন্য আজও আমার মন আকুলি-বিকুলি করে।
চলবে…..