প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও প্রাথমিক অবস্থান
বাংলাদেশের নদী-মোহনা অঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী হলো ইরাবতী ডলফিন (Irrawaddy Dolphin), স্থানীয়ভাবে যাকে শুশুক বলা হয়। এই প্রজাতির ডলফিন সাধারণত মিঠাপানি এবং মোহনাজল পরিবেশে টিকে থাকে। একসময় পদ্মা-মেঘনা মোহনা, সুন্দরবন অঞ্চলের নদীজাল এবং নাফ নদীর মোহনায় এর দলবদ্ধ উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক দৃশ্য। প্রাচীন বাণিজ্য নথি, নৌ-রেকর্ড ও স্থানীয় জেলেদের বর্ণনা অনুযায়ী ২০শ শতকের শুরুতে এদের সংখ্যা ছিল হাজারেরও বেশি।
নদী ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন
১৯৫০–৬০-এর দশকে ফ্লাড কন্ট্রোল ও সেচ প্রকল্পের নামে নদীর শাখা প্রবাহ বন্ধ হতে শুরু করে। বাঁধ ও রেগুলেটর নির্মাণে স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটা এবং পানির প্রবাহ ব্যাহত হয়ে নদীর গভীরতা কমে যায়, চর জাগতে শুরু করে এবং ডলফিনের প্রিয় গভীর চ্যানেলগুলো ধ্বংস হয়।
মানবসৃষ্ট হুমকি
১৯৮০–৯০-এর দশকে ডিজেল চালিত বড় কার্গো জাহাজের শব্দ দূষণ, স্পিড ওয়েভ ও সোনার যন্ত্রের ব্যবহার ডলফিনের চলাচল ও শিকারের পদ্ধতি বিঘ্নিত করে। একই সময়ে জেলেরা ক্ষুদ্র ফাঁসের কারেন্ট জাল ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয়, যা ডলফিনের শ্বাসনালীতে আটকে মৃত্যু ডেকে আনে। শিল্পবর্জ্য ও কৃষি রাসায়নিক দূষণ নদীর পানিকে বিষাক্ত করে ডলফিনের খাদ্যচক্র এবং শারীরিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে।
জনসংখ্যা সংকট: পরিসংখ্যানে পরিণতি
গত এক শতকে নদী-মোহনায় ইরাবতী ডলফিনের সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমে এসেছে। সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবন এলাকায় আনুমানিক ৪৫০–৫৫০টি, মেঘনা মোহনায় ২০০–২৫০টি এবং নাফ নদীতে ৫০–১০০টি ডলফিন আছে বলে ধারণা করা হয়। একসময় হাজারেরও অনেক বেশি এরা ছিল, আজ তা মাত্র ৭০০–৯০০-এর সীমিত বিপন্ন জনগোষ্ঠী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংরক্ষণ উদ্যোগ
২০১২ সালে সুন্দরবনের অংশে ইরাবতী ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়, যা তাদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়। বন বিভাগ, মৎস্য বিভাগ, WWF ও WCS-এর মতো সংস্থাগুলি সচেতনতা কর্মসূচি, জরিপ এবং বিকল্প জীবিকা প্রকল্প চালু করেছে, যাতে জেলেরা ক্ষতিকর জাল ব্যবহার থেকে বিরত থাকে।
সামনে চ্যালেঞ্জ
নদীর নাব্যতা হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অনিয়ন্ত্রিত নৌযান চলাচল এবং আইন প্রয়োগের দুর্বলতা—এসব চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ইরাবতী ডলফিন শুধু একটি প্রজাতি নয়, বরং নদী-মোহনার স্বাস্থ্যের সূচক। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পরিবেশ সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার না দিলে এ প্রাচীন ও রহস্যময় প্রাণীর কণ্ঠস্বর হয়তো চিরতরে থেমে যাবে।