১১:২৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫

টাকা নিলেও ভোট দেয় নিজের মানুষকে

বাংলাদেশের রাজনীতিতে টাকার প্রভাব নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। বিশেষ করে গ্রামের রাজনীতিতে টাকার খেলা” প্রায়ই সমালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। অনেকেই অভিযোগ করেননির্বাচনের সময় টাকা বিলিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করা হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র কি এতই সরলসত্যিই কি টাকা থাকলেই একজন মানুষ গ্রামের মানুষের মন জয় করে জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠতে পারে?

গ্রামীণ সমাজের রাজনৈতিক বাস্তবতা

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তাসামাজিক সম্পর্কপারিবারিক ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিগত আস্থার উপর দাঁড়িয়ে আছে। এখানে জনপ্রিয়তা রাতারাতি তৈরি হয় না। অনেক সময় এক গ্রামের ভোটাররা জানেন কে কয়েক বছর ধরে অসুস্থের খোঁজ নিয়েছেনকে বিয়ে-শ্রাদ্ধেকুলখানিতে গিয়েছেনকে স্থানীয় স্কুল মেরামত করতে পয়সা বা শ্রম দিয়েছেন।

দীর্ঘদিনের স্থানীয় নেতা বা জনপ্রতিনিধি এই সামাজিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁদের অনেকেই হয়ত ধনী ননকিন্তু তাঁদের ওপর মানুষের আস্থা রয়েছে। এই আস্থা ভাঙা সহজ নয়।

টাকার প্রলোভন – তাৎক্ষণিক প্রভাবস্থায়ী নয়

নির্বাচনের সময় টাকার খেলা সত্যিই হয়। অনেক প্রার্থী টাকা বিলিয়ে ভোটারদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ শাড়িলুঙ্গিচাল-ডাল বা নগদ টাকাও দেন। এতে কিছু ভোটার প্রভাবিত হনবৈকি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেনএটি সাধারণত তাৎক্ষণিক বা একবারের ফল দেয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়ভোটাররা টাকা নিয়েও শেষ পর্যন্ত চেনা আস্থাভাজন প্রার্থীকে ভোট দেন। আবার অনেক সময় গ্রামের মানুষেরা বলেন—“ভোটের সময় এরা আসে টাকা দেয়এরপর খুঁজে পাওয়া যায় না।” ফলে টাকা দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা টেকসই হয় না।

দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের জোর

একজন দীর্ঘদিনের প্রতিনিধি” বা সামাজিক প্রতিনিধি” সাধারণত মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে থাকেন। তিনি বিয়ে-শ্রাদ্ধে যানরোগী দেখতে হাসপাতালে যানগরিবকে সাহায্য করেনসালিশে মধ্যস্থতা করেন। গ্রামের মানুষ তাকে নিজের লোক ভাবেন। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে টাকার ঝনঝনানি নিয়ে কেউ এলেই মানুষ প্রশ্ন করে—“ও কোথায় ছিল এতো দিন?” ফলে অনেক ক্ষেত্রেই টাকার প্রার্থীকে সামাজিক লজ্জা পেতে হয়।

তবে টাকা কি একেবারেই কাজ করে না?

রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলেনএ কথা বলাও ঠিক নয় যে টাকা একেবারেই কাজ করে না। দরিদ্র এলাকাযেখানে জীবিকার টানাপোড়েন তীব্রসেখানে অনেক সময় নগদ টাকার প্রলোভন বড় হয়ে ওঠে। তাছাড়াদলীয় শক্তিসরকারপক্ষের চাপপ্রভাবশালী নেতা বা মাদকের অর্থএমন অনেক কিছু মিলে টাকার প্রভাব বিস্তৃত হয়।

অবশ্যইটাকা থাকলেই জনপ্রিয়তা নিশ্চিতএই ধারণা ঠিক নয়। একজন প্রার্থীকে এলাকায় গ্রহণযোগ্য হতে হলে তাঁকে মানুষের কাছে যেতে হয়সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। শুধু টাকায় ভোটার কেনা সম্ভব হলেও জনপ্রিয়তা” কেনা যায় না।

নির্বাচনের ভাষ্য – স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা

ময়মনসিংহের এক ইউনিয়নের প্রবীণ শিক্ষক বললেন,

ভোটের সময় অনেকেই টাকা দেয়। গ্রামের গরিব মানুষ নেয়ও। কিন্তু ভোট দিয়ে নিজের মানুষকেই ভোট দেয়। টাকা দিয়ে ভোট কিনলে সম্পর্ক হয় না।

কুমিল্লার এক ইউপি মেম্বার প্রার্থীযিনি তিনবার হেরেছেন এবং চতুর্থবার জিতেছেনতিনি বলেন,

প্রথমবার টাকা খরচ করেছিলাম। মানুষ নিয়ে নিলেও ভোট দেয়নি। তারপর দশ বছর মানুষকে সাহায্য করেছিসালিশ করেছি। তারপর জিতেছি। টাকা একবার কাজে লাগতে পারেকিন্তু মানুষকে কিনে রাখা যায় না।

বিশেষজ্ঞদের মত

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেনবাংলাদেশে নির্বাচনী দুর্নীতি কমাতে কঠোর আইন দরকার। কিন্তু একই সঙ্গে দরকার রাজনীতির সংস্কৃতি পরিবর্তন করা। টাকায় ভোট কেনা বন্ধ করতে হলে প্রার্থীদের গ্রামীণ সমাজের সাথে সত্যিকারের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

মানুষের আস্থা ও সম্মান

বাংলাদেশের গ্রামীণ রাজনীতিতে টাকা দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা হয়এবং কিছু ক্ষেত্রে এর প্রভাবও দেখা যায়। কিন্তু জনপ্রিয়তা” মানে শুধু ভোট নয়মানুষের আস্থা ও সম্মান। সেটা রাতারাতি টাকায় কেনা যায় না। যারা দীর্ঘদিন ধরে এলাকার মানুষের সাথে ছিলেনতাঁদের বিরুদ্ধে এই টাকার প্রার্থী একসময় পরাজিত হয়েই যানএটাই বাংলাদেশের গ্রামের রাজনীতির বড় সত্য।

টাকা নিলেও ভোট দেয় নিজের মানুষকে

০৪:৪৬:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনীতিতে টাকার প্রভাব নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। বিশেষ করে গ্রামের রাজনীতিতে টাকার খেলা” প্রায়ই সমালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। অনেকেই অভিযোগ করেননির্বাচনের সময় টাকা বিলিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করা হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র কি এতই সরলসত্যিই কি টাকা থাকলেই একজন মানুষ গ্রামের মানুষের মন জয় করে জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠতে পারে?

গ্রামীণ সমাজের রাজনৈতিক বাস্তবতা

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তাসামাজিক সম্পর্কপারিবারিক ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিগত আস্থার উপর দাঁড়িয়ে আছে। এখানে জনপ্রিয়তা রাতারাতি তৈরি হয় না। অনেক সময় এক গ্রামের ভোটাররা জানেন কে কয়েক বছর ধরে অসুস্থের খোঁজ নিয়েছেনকে বিয়ে-শ্রাদ্ধেকুলখানিতে গিয়েছেনকে স্থানীয় স্কুল মেরামত করতে পয়সা বা শ্রম দিয়েছেন।

দীর্ঘদিনের স্থানীয় নেতা বা জনপ্রতিনিধি এই সামাজিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁদের অনেকেই হয়ত ধনী ননকিন্তু তাঁদের ওপর মানুষের আস্থা রয়েছে। এই আস্থা ভাঙা সহজ নয়।

টাকার প্রলোভন – তাৎক্ষণিক প্রভাবস্থায়ী নয়

নির্বাচনের সময় টাকার খেলা সত্যিই হয়। অনেক প্রার্থী টাকা বিলিয়ে ভোটারদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ শাড়িলুঙ্গিচাল-ডাল বা নগদ টাকাও দেন। এতে কিছু ভোটার প্রভাবিত হনবৈকি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেনএটি সাধারণত তাৎক্ষণিক বা একবারের ফল দেয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়ভোটাররা টাকা নিয়েও শেষ পর্যন্ত চেনা আস্থাভাজন প্রার্থীকে ভোট দেন। আবার অনেক সময় গ্রামের মানুষেরা বলেন—“ভোটের সময় এরা আসে টাকা দেয়এরপর খুঁজে পাওয়া যায় না।” ফলে টাকা দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা টেকসই হয় না।

দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের জোর

একজন দীর্ঘদিনের প্রতিনিধি” বা সামাজিক প্রতিনিধি” সাধারণত মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে থাকেন। তিনি বিয়ে-শ্রাদ্ধে যানরোগী দেখতে হাসপাতালে যানগরিবকে সাহায্য করেনসালিশে মধ্যস্থতা করেন। গ্রামের মানুষ তাকে নিজের লোক ভাবেন। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে টাকার ঝনঝনানি নিয়ে কেউ এলেই মানুষ প্রশ্ন করে—“ও কোথায় ছিল এতো দিন?” ফলে অনেক ক্ষেত্রেই টাকার প্রার্থীকে সামাজিক লজ্জা পেতে হয়।

তবে টাকা কি একেবারেই কাজ করে না?

রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলেনএ কথা বলাও ঠিক নয় যে টাকা একেবারেই কাজ করে না। দরিদ্র এলাকাযেখানে জীবিকার টানাপোড়েন তীব্রসেখানে অনেক সময় নগদ টাকার প্রলোভন বড় হয়ে ওঠে। তাছাড়াদলীয় শক্তিসরকারপক্ষের চাপপ্রভাবশালী নেতা বা মাদকের অর্থএমন অনেক কিছু মিলে টাকার প্রভাব বিস্তৃত হয়।

অবশ্যইটাকা থাকলেই জনপ্রিয়তা নিশ্চিতএই ধারণা ঠিক নয়। একজন প্রার্থীকে এলাকায় গ্রহণযোগ্য হতে হলে তাঁকে মানুষের কাছে যেতে হয়সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। শুধু টাকায় ভোটার কেনা সম্ভব হলেও জনপ্রিয়তা” কেনা যায় না।

নির্বাচনের ভাষ্য – স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা

ময়মনসিংহের এক ইউনিয়নের প্রবীণ শিক্ষক বললেন,

ভোটের সময় অনেকেই টাকা দেয়। গ্রামের গরিব মানুষ নেয়ও। কিন্তু ভোট দিয়ে নিজের মানুষকেই ভোট দেয়। টাকা দিয়ে ভোট কিনলে সম্পর্ক হয় না।

কুমিল্লার এক ইউপি মেম্বার প্রার্থীযিনি তিনবার হেরেছেন এবং চতুর্থবার জিতেছেনতিনি বলেন,

প্রথমবার টাকা খরচ করেছিলাম। মানুষ নিয়ে নিলেও ভোট দেয়নি। তারপর দশ বছর মানুষকে সাহায্য করেছিসালিশ করেছি। তারপর জিতেছি। টাকা একবার কাজে লাগতে পারেকিন্তু মানুষকে কিনে রাখা যায় না।

বিশেষজ্ঞদের মত

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেনবাংলাদেশে নির্বাচনী দুর্নীতি কমাতে কঠোর আইন দরকার। কিন্তু একই সঙ্গে দরকার রাজনীতির সংস্কৃতি পরিবর্তন করা। টাকায় ভোট কেনা বন্ধ করতে হলে প্রার্থীদের গ্রামীণ সমাজের সাথে সত্যিকারের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

মানুষের আস্থা ও সম্মান

বাংলাদেশের গ্রামীণ রাজনীতিতে টাকা দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা হয়এবং কিছু ক্ষেত্রে এর প্রভাবও দেখা যায়। কিন্তু জনপ্রিয়তা” মানে শুধু ভোট নয়মানুষের আস্থা ও সম্মান। সেটা রাতারাতি টাকায় কেনা যায় না। যারা দীর্ঘদিন ধরে এলাকার মানুষের সাথে ছিলেনতাঁদের বিরুদ্ধে এই টাকার প্রার্থী একসময় পরাজিত হয়েই যানএটাই বাংলাদেশের গ্রামের রাজনীতির বড় সত্য।