১০:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫

হোলি আর্টিজান হামলায় শহীদ ওসি সালাহউদ্দিন খান

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কে অবস্থিত হোলি আর্টিজান বেকারি হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ জঙ্গি হামলার মঞ্চ। বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনের নির্মম হত্যাকাণ্ডে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো দেশ। কিন্তু সেই রাতে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা বিনা দ্বিধায় জীবন বাজি রেখে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গুলশান থানার তৎকালীন ওসি সালাহউদ্দিন খান।

সাহসিকতার শুরু

ওসি সালাহউদ্দিন খান তখন গুলশান থানার দায়িত্বে ছিলেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে জঙ্গিরা বেকারিতে ঢুকে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। খবর পেয়ে পুলিশের টহল দল ও থানা থেকে প্রথমে যারা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছেন, তাদের নেতৃত্বেই ছিলেন সালাহউদ্দিন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য ও পুলিশের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে দেখা যায়—জঙ্গিরা ভারী অস্ত্র, গ্রেনেড ও ধারালো ছুরি নিয়ে বেকারির ভেতরে অবস্থান করছিল। বাইরে থেকে গুলি ও গ্রেনেড নিক্ষেপ হচ্ছিল পুলিশের দিকে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও ওসি সালাহউদ্দিন সাহস হারাননি।

প্রথম আক্রমণ ঠেকাতে জীবন বাজি

প্রথমে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে পুলিশ। তারপর ওসি সালাহউদ্দিন নিজের নেতৃত্বে সামনে এগিয়ে যান। এক পর্যায়ে জঙ্গিরা তাদের দিকে গ্রেনেড ছোড়ে। এতে ওসি সালাহউদ্দিন গুরুতর আহত হন। আহত অবস্থাতেও সহকর্মীদের উদ্ধারের চেষ্টা করেন। পরে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলে রাতেই তিনি শহীদ হন।

এই হামলায় পুলিশের আরেক কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামও প্রাণ হারান। এছাড়া বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন।

মিডিয়া ও জাতীয় স্বীকৃতি

হামলার পর দিন দেশজুড়ে শোকের ছায়া নামে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে শুরু করে পুলিশের সদর দফতর—সব জায়গায় তাদের এই আত্মত্যাগকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

গণমাধ্যমে সালাহউদ্দিন খানের সাহসিকতার গল্প বিশেষ গুরুত্ব পায়। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে তাকে এক নিঃস্বার্থ সাহসী পুলিশ অফিসার হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান এবং সাহসিকতার জন্য পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ সম্মান ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)-মরণোত্তর’ পুরস্কার দেওয়া হয়।

পরিবার ও ব্যক্তিজীবন

ওসি সালাহউদ্দিন খান ছিলেন একজন সৎ ও দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা। বরিশালের সন্তান হলেও কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময়ই তিনি ঢাকায় দায়িত্ব পালন করেছেন।

তার পরিবারে ছিলেন স্ত্রী এবং দুই সন্তান। ছেলে পড়াশোনা করছিল স্কুলে, আর মেয়ে ছিল খুব ছোট।

হামলার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ সদর দফতর থেকে এককালীন অনুদান, জমি, এবং সন্তানদের শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়।

পরিবার এখন কেমন আছে?

আজ ৮ বছর পেরিয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যরা এখনো সালাহউদ্দিন খানের সেই আত্মত্যাগের ক্ষত বহন করছেন।

সরকারি সহায়তা ও পুলিশের তত্ত্বাবধানে সন্তানরা পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। তার ছেলে এখন কলেজে, মেয়ে মাধ্যমিকে। পরিবারকে সরকারি কলোনিতে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।

তবে, পারিবারিক সূত্রে জানা যায়—মানসিক যন্ত্রণা এখনো পিছু ছাড়েনি। স্ত্রী এখনো স্বামীর স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে আছেন।

পরিবারের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানান—“সরকারি সহায়তা আছে, পুলিশ সদর দফতর থেকেও খোঁজ রাখা হয়। কিন্তু স্বামী-ও বাবাকে হারানোর শূন্যতা তো কোনো কিছুতেই ভরাট হয় না।”

পুলিশের স্মরণ

পুলিশ সদর দফতরে শহীদদের ছবি টাঙানো রয়েছে। প্রশিক্ষণ একাডেমি ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নতুন পুলিশ সদস্যদের কাছে তাদের সাহসিকতার গল্প বলা হয়।

সহকর্মীদের চোখে সালাহউদ্দিন খান

এক সহকর্মী বলেছিলেন—“ওসি সালাহউদ্দিন ভাই খুব কঠিন মানুষ ছিলেন দায়িত্ব পালনে, কিন্তু খুব স্নেহশীল অভিভাবক ছিলেন থানার সবার জন্য। হামলার দিনও বলেছিলেন—‘আমি গেলে তোমরা সাহস পাবে’।”

আরেক পুলিশ সদস্য বলেন—“তিনি বলেছিলেন, ‘জঙ্গিরা যদি ঢাকার বুকে এই বার্তা দিতে চায় যে পুলিশ ভয় পায়, তা হবে না।’ এই কথা বলে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন।”

রাষ্ট্র ও সমাজের দায়

ওসি সালাহউদ্দিন খানের আত্মত্যাগ শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ট্র্যাজেডি নয়। এটা বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর আত্মত্যাগের প্রতীক।

সমাজের দায়িত্ব তার পরিবারের পাশে থাকা। পুলিশের দায়িত্ব সন্তানদের মানুষ করে তোলা।

সরকারি নীতিমালায় বলা হয়েছে—জঙ্গি দমনে শহীদ পুলিশ সদস্যদের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। তবে, বাস্তবায়ন নিয়ে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন ওঠে।

পরিবার সূত্রে জানা যায়—“সহায়তা পাই ঠিকই, তবে আরও বেশি মনোযোগ দরকার।”

উপসংহার

ওসি সালাহউদ্দিন খান সেই রাতের অন্ধকারে সাহসের আলো জ্বালিয়ে ছিলেন। হামলাকারীরা যেখানে সন্ত্রাসের বার্তা দিতে চেয়েছিল, তিনি নিজের রক্তে লিখে দিয়েছিলেন প্রতিরোধের গল্প।

আজ তার পরিবার বেঁচে আছে সেই গল্প বুকে নিয়ে। তার ছেলে-মেয়ে বড় হচ্ছে এই বার্তা নিয়ে যে তাদের বাবার রক্তেই দেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ার শক্তি পায়।

বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য—ওসি সালাহউদ্দিন খানের মতো শহীদদের আত্মত্যাগ কখনো ভুলে না যাওয়া। রাষ্ট্রের দায়িত্ব—তাদের পরিবারের প্রতি সবসময় দায়বদ্ধ থাকা।

হোলি আর্টিজান হামলায় শহীদ ওসি সালাহউদ্দিন খান

০৪:২০:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কে অবস্থিত হোলি আর্টিজান বেকারি হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ জঙ্গি হামলার মঞ্চ। বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনের নির্মম হত্যাকাণ্ডে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো দেশ। কিন্তু সেই রাতে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা বিনা দ্বিধায় জীবন বাজি রেখে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গুলশান থানার তৎকালীন ওসি সালাহউদ্দিন খান।

সাহসিকতার শুরু

ওসি সালাহউদ্দিন খান তখন গুলশান থানার দায়িত্বে ছিলেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে জঙ্গিরা বেকারিতে ঢুকে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। খবর পেয়ে পুলিশের টহল দল ও থানা থেকে প্রথমে যারা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছেন, তাদের নেতৃত্বেই ছিলেন সালাহউদ্দিন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য ও পুলিশের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে দেখা যায়—জঙ্গিরা ভারী অস্ত্র, গ্রেনেড ও ধারালো ছুরি নিয়ে বেকারির ভেতরে অবস্থান করছিল। বাইরে থেকে গুলি ও গ্রেনেড নিক্ষেপ হচ্ছিল পুলিশের দিকে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও ওসি সালাহউদ্দিন সাহস হারাননি।

প্রথম আক্রমণ ঠেকাতে জীবন বাজি

প্রথমে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে পুলিশ। তারপর ওসি সালাহউদ্দিন নিজের নেতৃত্বে সামনে এগিয়ে যান। এক পর্যায়ে জঙ্গিরা তাদের দিকে গ্রেনেড ছোড়ে। এতে ওসি সালাহউদ্দিন গুরুতর আহত হন। আহত অবস্থাতেও সহকর্মীদের উদ্ধারের চেষ্টা করেন। পরে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলে রাতেই তিনি শহীদ হন।

এই হামলায় পুলিশের আরেক কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামও প্রাণ হারান। এছাড়া বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন।

মিডিয়া ও জাতীয় স্বীকৃতি

হামলার পর দিন দেশজুড়ে শোকের ছায়া নামে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে শুরু করে পুলিশের সদর দফতর—সব জায়গায় তাদের এই আত্মত্যাগকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

গণমাধ্যমে সালাহউদ্দিন খানের সাহসিকতার গল্প বিশেষ গুরুত্ব পায়। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে তাকে এক নিঃস্বার্থ সাহসী পুলিশ অফিসার হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান এবং সাহসিকতার জন্য পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ সম্মান ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)-মরণোত্তর’ পুরস্কার দেওয়া হয়।

পরিবার ও ব্যক্তিজীবন

ওসি সালাহউদ্দিন খান ছিলেন একজন সৎ ও দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা। বরিশালের সন্তান হলেও কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময়ই তিনি ঢাকায় দায়িত্ব পালন করেছেন।

তার পরিবারে ছিলেন স্ত্রী এবং দুই সন্তান। ছেলে পড়াশোনা করছিল স্কুলে, আর মেয়ে ছিল খুব ছোট।

হামলার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ সদর দফতর থেকে এককালীন অনুদান, জমি, এবং সন্তানদের শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়।

পরিবার এখন কেমন আছে?

আজ ৮ বছর পেরিয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যরা এখনো সালাহউদ্দিন খানের সেই আত্মত্যাগের ক্ষত বহন করছেন।

সরকারি সহায়তা ও পুলিশের তত্ত্বাবধানে সন্তানরা পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। তার ছেলে এখন কলেজে, মেয়ে মাধ্যমিকে। পরিবারকে সরকারি কলোনিতে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।

তবে, পারিবারিক সূত্রে জানা যায়—মানসিক যন্ত্রণা এখনো পিছু ছাড়েনি। স্ত্রী এখনো স্বামীর স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে আছেন।

পরিবারের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানান—“সরকারি সহায়তা আছে, পুলিশ সদর দফতর থেকেও খোঁজ রাখা হয়। কিন্তু স্বামী-ও বাবাকে হারানোর শূন্যতা তো কোনো কিছুতেই ভরাট হয় না।”

পুলিশের স্মরণ

পুলিশ সদর দফতরে শহীদদের ছবি টাঙানো রয়েছে। প্রশিক্ষণ একাডেমি ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নতুন পুলিশ সদস্যদের কাছে তাদের সাহসিকতার গল্প বলা হয়।

সহকর্মীদের চোখে সালাহউদ্দিন খান

এক সহকর্মী বলেছিলেন—“ওসি সালাহউদ্দিন ভাই খুব কঠিন মানুষ ছিলেন দায়িত্ব পালনে, কিন্তু খুব স্নেহশীল অভিভাবক ছিলেন থানার সবার জন্য। হামলার দিনও বলেছিলেন—‘আমি গেলে তোমরা সাহস পাবে’।”

আরেক পুলিশ সদস্য বলেন—“তিনি বলেছিলেন, ‘জঙ্গিরা যদি ঢাকার বুকে এই বার্তা দিতে চায় যে পুলিশ ভয় পায়, তা হবে না।’ এই কথা বলে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন।”

রাষ্ট্র ও সমাজের দায়

ওসি সালাহউদ্দিন খানের আত্মত্যাগ শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ট্র্যাজেডি নয়। এটা বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর আত্মত্যাগের প্রতীক।

সমাজের দায়িত্ব তার পরিবারের পাশে থাকা। পুলিশের দায়িত্ব সন্তানদের মানুষ করে তোলা।

সরকারি নীতিমালায় বলা হয়েছে—জঙ্গি দমনে শহীদ পুলিশ সদস্যদের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। তবে, বাস্তবায়ন নিয়ে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন ওঠে।

পরিবার সূত্রে জানা যায়—“সহায়তা পাই ঠিকই, তবে আরও বেশি মনোযোগ দরকার।”

উপসংহার

ওসি সালাহউদ্দিন খান সেই রাতের অন্ধকারে সাহসের আলো জ্বালিয়ে ছিলেন। হামলাকারীরা যেখানে সন্ত্রাসের বার্তা দিতে চেয়েছিল, তিনি নিজের রক্তে লিখে দিয়েছিলেন প্রতিরোধের গল্প।

আজ তার পরিবার বেঁচে আছে সেই গল্প বুকে নিয়ে। তার ছেলে-মেয়ে বড় হচ্ছে এই বার্তা নিয়ে যে তাদের বাবার রক্তেই দেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ার শক্তি পায়।

বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য—ওসি সালাহউদ্দিন খানের মতো শহীদদের আত্মত্যাগ কখনো ভুলে না যাওয়া। রাষ্ট্রের দায়িত্ব—তাদের পরিবারের প্রতি সবসময় দায়বদ্ধ থাকা।