সিদ্দিক আলম দয়াল
( ইউএনবি নিউজ থেকে অনূদিত)
গাইবান্ধার আলু চাষিরা এই মৌসুমে ভালো ফলন পেলেও হিমাগারের স্থানসংকটের কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
বাজারে এবং ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলু সংরক্ষণ করার পরও অনেক কৃষক তাদের অবশিষ্ট আলুর জন্য জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকে দিনরাত সড়কের ধারে অপেক্ষা করছেন, যাতে তারা হিমাগারে সংরক্ষণের সুযোগ পান। তবে পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে বাধ্য হয়ে অনেক কৃষক কম দামে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, ফলে তারা বড় ধরনের লোকসানের শিকার হচ্ছেন।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে জেলায় মোট ১৪,৪৯৭ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় চাষের পরিমাণ হলো:
- ফুলছড়ি: ৪৮ হেক্টর
- সাঘাটা: ৩২৭ হেক্টর
- সুন্দরগঞ্জ: ১,০৭৯ হেক্টর
- গোবিন্দগঞ্জ: ৯,৩১৮ হেক্টর
- পলাশবাড়ী: ১,২২০ হেক্টর
- সাদুল্লাপুর: ২,২৫০ হেক্টর
- গাইবান্ধা সদর: ২৫৫ হেক্টর
মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২,০০,০০০ মেট্রিক টনের বেশি। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পরও প্রচুর পরিমাণ আলু উদ্বৃত্ত থাকছে, যা সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে না।
চাষিরা ন্যায্য দাম পাওয়ার আশায় জেলায় অবস্থিত পাঁচটি হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করতে চাইছেন। এসব হিমাগার হলো:
- আরভি কোল্ড স্টোরেজ (সাদুল্লাপুর)
- হিমাদ্রি কোল্ড স্টোরেজ (গোবিন্দগঞ্জ)
- গোবিন্দগঞ্জ কোল্ড স্টোরেজ-১
- গোবিন্দগঞ্জ কোল্ড স্টোরেজ-২
- আশরাফ আলী কোল্ড স্টোরেজ (সুন্দরগঞ্জ)
তবে অধিকাংশ কৃষক তাদের আলু সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন না। উচ্চমূল্য সত্ত্বেও তারা হিমাগারে জায়গা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
গাইবান্ধার পাঁচটি হিমাগারের মোট ধারণক্ষমতা ৪৬,৭৬০ মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের মাত্র এক-চতুর্থাংশ সংরক্ষণ করতে পারে। ফলে প্রায় ১,৫০,০০০ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণের বাইরে থাকছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিছু হিমাগার মালিকরা সংরক্ষণ স্লিপের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, তবে কৃষকরা তবুও স্লিপ পেতে হিমশিম খাচ্ছেন।
এই সংকটের কারণে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে শত শত ট্রাক, ভ্যান ও ট্রাক্টর আলুভর্তি বস্তা নিয়ে হিমাগারের সামনে অপেক্ষা করছে।
আলু চাষি হামিদুল রহমান তার হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা আলু তোলার পর থেকে চরম বিপাকে আছি। বাজারে দাম কম। এখন বিক্রি করলে মূলধন হারিয়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। তাই আমরা রাতদিন হিমাগারের সামনে স্লিপের জন্য অপেক্ষা করছি।”
গোবিন্দগঞ্জের কৃষকেরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন, কারণ তারা রেকর্ড পরিমাণ জমিতে আলু চাষ করেছিলেন উচ্চমূল্যের প্রত্যাশায়। কিন্তু হিমাগারে জায়গা না পাওয়ায় এখন তারা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। কৃষকদের অভিযোগ, সঠিক তদারকির অভাবে সংরক্ষণের সুযোগ শুধু বিশেষ সংযোগ থাকা ব্যক্তিদের বা যারা ঘুষ দিতে পারেন তাদেরই দেওয়া হচ্ছে।
হিমাদ্রি লিমিটেডের ম্যানেজার মোজাম্মেল হক এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “বুকিং স্লিপ শেষ হয়ে গেছে। আগের বছরের মতো এবারও আমরা ব্যবসায়ীদের কাছে স্লিপ দিয়েছি, তবে সংখ্যায় কম। কোনো কালোবাজারি হয়নি।”
এদিকে, গোবিন্দগঞ্জ কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার সাজিব বলেন, “এ বছর আমরা স্থানীয় কৃষকদের অগ্রাধিকার দিচ্ছি। কোনো মজুতদারকে কার্ড দেওয়া হয়নি। কৃষকরা ৫-১০ বস্তা আলু আনলে তাদের সংরক্ষণে কোনো সমস্যা হবে না। আমাদের দুটি স্টোরেজে মোট ৩,৫০,০০০ বস্তার ধারণক্ষমতা রয়েছে। এখন পর্যন্ত ১,২০,০০০ বস্তার বুকিং হয়ে গেছে।”
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খোরশেদ আলম স্বীকার করেছেন যে, অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে কিছু আলু হিমাগারের বাইরে থেকে যেতে পারে। তবে তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে, কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে বীজ আলু সংরক্ষণের জন্য কৃষকদের সহায়তা করবে। “আমরা কৃষকদের প্রাকৃতিক সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কেও পরামর্শ দিচ্ছি, যা ব্যবহার করলে তারা তিন মাস পর্যন্ত আলু সংরক্ষণ করতে পারবেন,” তিনি যোগ করেন।
এই সংকট দীর্ঘায়িত হলে কৃষকদের ক্ষতি আরও বাড়তে পারে এবং পুরো অঞ্চলের আলু সরবরাহ ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কৃষকেরা সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন, যাতে তাদের শ্রম ও বিনিয়োগের ন্যায্য মূল্য পাওয়া নিশ্চিত হয়।