সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
- আলোচনায় না আসলে সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে বলে ট্রাম্প দাবি করেছেন
- ২০১৫ সালে, ইরান ও বিশ্বশক্তির মধ্যে নিউক্লিয়ার চুক্তি (জেসিপিওএ) স্বাক্ষরিত হয়
- ইরানের অর্থনৈতিক সংকট ও আঞ্চলিক জটিলতার কারণে ট্রাম্প আলোচনার দরজা খোলা রাখতে চাচ্ছেন
- নতুন আমেরিকান প্রস্তাব যদি চুক্তির মূল শর্তাবলী পরিবর্তন করে, তাহলে চুক্তিতে স্বাক্ষরের সম্ভাবনা কমে যাবে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন যে, তিনি ইরানের শীর্ষ নেতা আলী খামেনেইকে একটি পত্র পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি ইরানের সাথে নিউক্লিয়ার চুক্তি পুনরায় আলোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। ট্রাম্প দাবি করেন যে, আলোচনায় না আসলে সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

চুক্তির প্রেক্ষাপট
- ২০১৫ সালের নিউক্লিয়ার চুক্তি (জেসিপিওএ)
২০১৫ সালে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যসহ জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইরান ‘সংযুক্ত বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা’ (জেসিপিওএ) এ স্বাক্ষর করেছিলেন। এই চুক্তি, যা সাধারণত ইরান নিউক্লিয়ার চুক্তি নামে পরিচিত, ইরানকে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তার নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম নিয়ন্ত্রণে রাখার শর্ত আরোপ করেছিল। চুক্তির অধীনে, ইরান সম্মত হয়েছিল তার ইউরেনিয়ামের সমৃদ্ধিকরণকে ৩.৬৭% এর বেশি না বাড়াতে, যাতে তা শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যায়।
- ট্রাম্পের ২০১৮ সালের প্রত্যাহার
২০১৮ সালে, ট্রাম্প একতরফাভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করেন। তিনি এই চুক্তিকে “সবচেয়ে খারাপ ও একতরফা লেনদেন” হিসেবে মনে করতেন এবং দাবি করেছিলেন যে তিনি ওবামার তুলনায় আরও ভালো চুক্তিবিদ।

প্রত্যাহারের প্রভাব ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
- বৈশ্বিক নিন্দা ও প্রতিবাদ
চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক নিন্দা ও প্রতিবাদ শুরু হয়। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) জানায় যে, ইরান যথাযথভাবে চুক্তির বিধিনিষেধ মেনে চলেছে। ইউরোপীয় দেশগুলো চুক্তির শর্তাবলী বজায় রাখার চেষ্টা করে।
- নিষেধাজ্ঞা ও ইরানের প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্পের “সর্বাধিক চাপ” নীতির ফলে ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে প্রায় ১৫০০টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর ফলে ইরান ধীরে ধীরে চুক্তিতে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি থেকে পিছিয়ে পড়তে শুরু করে, যদিও চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও রয়ে গেছে।
চুক্তির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ দিক
- প্রযুক্তিগত মেয়াদ ও চ্যালেঞ্জ
জেসিপিওএ-এর প্রযুক্তিগত মেয়াদ অক্টোবর ২০২৫ সালে শেষ হবে। তবে ইউরোপের পুনঃপ্রবেশের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়া, নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আর ইরানের প্রতিক্রিয়ার কারণে চুক্তিটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।

- ভিয়েনাতে আলোচনার প্রচেষ্টা
জো বাইডেন প্রশাসন ২০২১ সালে ভিয়েনাতে ইরানের সাথে পরোক্ষ আলোচনা শুরু করে, কিন্তু ফলপ্রসূ সমাধান বের করতে ব্যর্থ হয়। ইরানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা যেমন অর্থনৈতিক সংকট, রিয়ালের অবনতি ও জনসাধারণের অসন্তোষও বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছে।
- ইরানের নিউক্লিয়ার কার্যক্রম ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ
ইরান তার নিউক্লিয়ার কার্যক্রম বাড়িয়েছে এবং সন্দেহজনক ইস্রায়েলি হুমকির মুখোমুখি হয়েছে। ২০২০ সালে তেহরানের শীর্ষ নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদার হত্যাকাণ্ড ও ২০২১ সালে ৬১% সমৃদ্ধিকরণের ঘোষণা এ পরিবর্তনের উদাহরণ।
- ইস্রায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব
ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক লবিং, বিশেষ করে প্যালেস্টাইনের প্রশ্নে, নতুন আমেরিকান নীতি ও সরাসরি আলোচনার প্রচেষ্টা ইরানের নিউক্লিয়ার ঝুঁকি হ্রাসের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। তবে, দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি রয়ে গেছে।

ট্রাম্পের পরিবর্তিত মনোভাব
- আর্থিক সংকট ও নীতিগত পরিবর্তন
২০২৪ সালের শেষের দিকে, ইরানের অর্থনীতি মারাত্মক সংকটে ঢুকে যায়। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের বিবৃতিতে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন খাতে গভীর সমস্যা বিদ্যমান। এ কারণেই ইরান এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা খুলে রাখার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
- আঞ্চলিক জটিলতা ও ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক লড়াই
ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব এখনও ব্যাপক। হুথিদের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও আরবের শক্তি অবকাঠামোয় আক্রমণের ক্ষমতা ইরানের নিউক্লিয়ার কার্ডকে শক্তিশালী করে। এই পরিস্থিতিতে, ট্রাম্প মনে করেন যে, যদি ইরান এবং অন্যান্য পক্ষ সমানভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তবে ইস্রায়েলের প্রতি নতুন আমেরিকান ছাড়পত্র কিছুটা হ্রাস পাবে।

- চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যতের পথে বাঁধা
২০১৫ সালের চুক্তি মূলত ইরানের নিউক্লিয়ার অস্ত্র অর্জনের পথ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ছিল না। চুক্তির “সানসেট ক্লজ”—যা ১০ বছরের পর সেন্ট্রিফিউজ সীমাবদ্ধতা ও ১৫ বছরের পর ইউরেনিয়ামের নিম্ন-সমৃদ্ধিকরণের সীমাবদ্ধতা তুলে নেবে—এই শর্তগুলোই ট্রাম্পের প্রত্যাহারের মূল কারণ ছিল। কোনো নতুন আমেরিকান প্রস্তাব যদি এই শর্তাবলী পরিবর্তন করে, তাহলে চুক্তিতে স্বাক্ষরের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।
উপসংহার
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য ইঙ্গিত করে যে, নতুন মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি ও ইরানের অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে, নিউক্লিয়ার চুক্তি পুনরায় আলোচনার দরজা খোলা যেতে পারে। তবে, ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব ও বিভিন্ন কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ এ আলোচনা সফল করা কঠিন করে তুলছে। আবার কূটনীতিতে অসম্ভব বলে যেমন কিছু নেই, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মোড় ক্রমশ যে স্পষ্ট হচ্ছে তাকেও স্বীকার করতে হবে।
Leave a Reply