সারাক্ষণ রিপোর্ট
আমস্টারডামের স্টেডেলিক মিউজিয়ামের প্রধান সিঁড়িতে বিস্তৃত নতুন ইনস্টলেশনের মাধ্যমে অ্যান্সেল্ম কিফার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই প্রদর্শনীতে যুদ্ধবিরোধী বার্তা ও অতীতের স্মৃতির স্পষ্ট ছাপ রয়েছে।
প্রদর্শনী বিবরণ
এই ইনস্টলেশন দেয়ালের প্রায় প্রতিটি কোণে অক্সিডাইজড তামা ও স্বর্ণপাতার রঙের আভা ছড়িয়ে পড়েছে। চোখের সমান্তরালে রঙিন স্প্ল্যাটারসহ সশস্ত্র ইউনিফর্ম ঝুলে আছে, আর শুকনো ফুলের পাপড়িগুলো ক্যানভাস থেকে মেঝেতে পড়ে। এক প্যানেলের তলায় যুবক কিফারের আত্মচিত্রে তাঁর বুকে থেকে একটি গাছের বৃদ্ধি দেখা যায়। প্রদর্শনীতে প্রায় ২৫টি চিত্রকলা, ১৩টি অঙ্কন এবং ৩টি চলচ্চিত্রসহ ১৯৭৩ থেকে বর্তমান সময়ের কাজগুলো উপস্থাপিত হয়েছে, সাথে রয়েছে আটটি ভ্যান গগের সৃষ্টি। শিরোনামকৃত “সাগ মির ও ডায় ব্লুমেন সিন” (“ফুলগুলো কোথায় চলে গেল?”) প্রদর্শনীটি আমস্টারডামের দুইটি বৃহত্তম আধুনিক শিল্প মিউজিয়াম – ভ্যান গগ ও স্টেডেলিকে সাজানো হয়েছে। প্রদর্শনীটি কিফারের ৮০তম জন্মদিনের ঠিক এক দিন আগে উদ্বোধন হয়েছিল এবং জুন ৯ পর্যন্ত চলবে, যা উভয় মিউজিয়ামের সহযোগিতার ফলস্বরূপ।
শিল্প ও প্রতীকী উপাদান
কিফারের কাজের মূল কেন্দ্রে রয়েছে তাঁর যুদ্ধবিরোধী মনোভাব। প্রদর্শনীটির শিরোনাম ও স্টেডেলিক মিউজিয়ামের কেন্দ্রীয় ইনস্টলেশন ১৯৫৫ সালের বিক্ষোভমূলক গানের কথাসাহিত্যের প্রভাব বহন করে – যদিও তিনি মূলত জার্মান সংস্করণ থেকে অনুপ্রাণিত। তাঁর মতে, “এই গানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাক্য হচ্ছে ‘আমরা কখন শিখব?'”। এই মন্তব্যে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ইতিহাস কেন বারংবার নিজেদের পুনরাবৃত্তি করে, তা এখনও আমাদের জন্য রহস্যে ভরা।
ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জন্মগ্রহণকারী কিফার তাঁর সৃষ্টিতে ফ্যাসিবাদ, রাজনৈতিক সহিংসতা ও সাংস্কৃতিক স্মৃতির থিমকে বারবার তুলে ধরেছেন। ১৯৬৯ সালে ২৪ বছর বয়সে ইউরোপ ভ্রমণের সময় তিনি “অকুপেশনস” নামে এক পারফরম্যান্স তৈরি করেন, যেখানে নাজি স্যালুটের মাধ্যমে যুদ্ধের কথা আলোচনার প্রতি প্রহসন ব্যক্ত করেন। তাঁর প্রথমকালের কাজগুলোতে ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব স্পষ্ট ছিল, যা তাঁকে জার্মানির ঐতিহ্যগত সীমা থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন মনে করায়।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও প্রেরণা
কিফার ছোটবেলা থেকেই ভ্যান গগের প্রভাব অনুভব করেন। ১৯৬৩ সালে ১৮ বছর বয়সে তাঁকে ইউরোপ ভ্রমণের জন্য এক অনুদান প্রদান করা হয়, যার মধ্য দিয়ে তিনি ভ্যান গগের পায়ের ছাপ অনুসরণ করেন। পরবর্তীতে, লন্ডনের টেট ব্রিটেন মিউজিয়ামে তাঁর বক্তৃতা ও ব্যাপক ভূমির চিত্রকলা সিরিজে ভ্যান গগের প্রভাব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। ভ্যান গগের ছোট আকারের শিল্পকর্মের বিপরীতে, কিফারের প্রায় ৯ মিটার প্রস্থের বিশাল ভূমির চিত্রগুলো ইতিহাসের ভার বহন করে।
সমসাময়িক প্রভাব ও বার্তা
কিফার জানান যে তাঁর কাজ সরাসরি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ঘটনা চিত্রিত করে না, বরং তা আমাদের চারপাশের বিশ্বে যুদ্ধের অমীমাংসিত absurditiy তুলে ধরে। বর্তমান সময়ে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রে ডানপন্থী স্বৈরাচারী শাসনের উত্থানের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি মিশে গেছে। তিনি বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতি আমাকে অতীতের ১৯৩৩ সালের জার্মানির সাথে তুলনীয় মনে হচ্ছে।” তাঁর মতে, যুদ্ধ এমনভাবে তাঁর শরীর থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফুটে উঠছে, যা যেন আমাদের জন্য এক সতর্কবার্তা।
উপসংহার
৮০তম জন্মদিনেও কিফার উদ্যমী ও সৃজনশীলতা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বলেন, “আমি যখন চিত্রাঙ্কন করি, তখন মাথা নয়, শরীর দিয়ে চিত্রাঙ্কন করি।” তাঁর সৃষ্টিতে অতীত ও বর্তমানের যুদ্ধের প্রভাব ও বেদনাকে একত্রে তুলে ধরা হয়েছে, যা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে আমাদেরকে ভাবতে বাধ্য করে।
Leave a Reply