সেবা-সমিতির সভ্য হিসাবে
পড়বি তো পড়-পরিশেষে বাজানের চক্ষেই আমি আগে পড়িলাম। তিনি হাত ধরিয়া সেই ঝোপের ভিতর হইতে আমাকে টানিয়া আনিলেন। বোঁচকাটি তখনও ঝোপের ভিতর। সমস্ত ব্যাপারটি তখন পরিষ্কার হইয়া গেল। জসীম সাধু বলিয়া গ্রামে আমার নাম ছিল। বাজানের বন্ধুরা সেই বুড়া-বুড়িকে সমস্ত খুলিয়া বলিলেন। তবু তাঁহারা আমাকে আর মাল বহিয়া লইয়া যাইতে দিলেন না। বাজান ঘাড় ধরিয়া ঠেলিতে ঠেলিতে আমাকে বাড়ি লইয়া আসিলেন। পথে বলিতে বলিতে আসিলেন, “পড়াশুনার নাম নাই, কেবল আজেবাজে কাজ লইয়া সময় কাটাও।” কিন্তু মনে মনে তিনি আমার এই ব্যাপারে খুশিই হইয়াছিলেন। ইহার পরে বহু বন্ধু সমাগমে তিনি প্রায়ই এই কাহিনীটি অতি সমারোহ করিয়া বলিতেন।
সেবা-সমিতির সঙ্গীরা অনেকেই ছিলেন বিপ্লবী দলের সভ্য। তাঁহারা রোগীর সেবা করিতেন কর্তব্যবোধে; মনের সহজ মমতাপ্রবণতা লইয়া নয়। কোনো রোগীর অবস্থা সঙ্গিন হইলে আত্মীয়-স্বজনেরা যখন কান্নাকাটি করিত তখন তাঁহারা পরস্পরে হাসি-তামাশা করিতেন। পাছে তাহাদের দুঃখে অনুপ্রাণিত হইয়া কর্তব্যকার্যে অবহেলা হয় এই ভয়ে তাঁহারা এরূপ করিতেন।
একবার একটি ছোট ছেলের মৃত্যু হয়। মা কিছুতেই তাহাকে কোল হইতে ছাড়িয়া দিবেন না। শ্মশানযাত্রীরা অপেক্ষা করিতেছে। কেহই মায়ের বুক হইতে বাছাকে ছিনাইয়া আনিতে পারে না। মা বারবার বলিতেছে, “আমার বাছা ঘুমাইয়া আছে। কে বলে সে মরিয়াছে? এখনই ডাক দিলে জাগিবে।” সেবা-সমিতির সভ্যেরা দুই-তিনজনে জোর করিয়া মায়ের
কোল হইতে মৃত ছেলেটিকে কাড়িয়া লইয়া আসিল। তারপর পরস্পরে হাসি বিনিময় করিল। ইহা আমার ভালো লাগিত না। রোগীর সামনে বসিয়া আমি সেবা করিতে করিতে আল্লার কাছে প্রার্থনা করিতাম। যদি কোনো রোগী আমার হাতে মারা যাইত, মনে মনে ভাবিতাম, আমার প্রার্থনায় বুঝি ভুল হইয়াছে। অমুক সময় আমি রোগীর কাছে ছিলাম না। তখনও যদি থাকিয়া প্রার্থনা করিতাম তবে রোগী মরিত না। একবার আমার সেবায় অনেকগুলি রোগী ভালো হইয়া উঠিল। আমার বন্ধু ধীরেনের তখন ধারণা হইল, আমি যে-রোগীর সেবা করিব, সে নিশ্চয়ই ভালো হইয়া উঠিবে। তাহাদের বাসায় কাহারও কোনো অসুখ হইলে সে তাই আমাকে সেবা করিবার ভার দিত। একবার আমার হাতে পাঁচ-ছয়টি রোগী মারা গেল।
তারপর ধীরেনদের বাসায় কোনো রোগীর সেবা করিতে আসিলে সে আমাকে নিষেধ ফরিদপুরের বন্ধু-কুটিরে একটি নতুন ভাড়াটে আসিল। সেই বাসার সামনে দিয়া আমার কলেজে যাওয়ার পথ। রোজ দেখিতাম শহরের বড় বড় ডাক্তারেরা সেই বাড়িতে আনাগোনা করে। ভাবিলাম, এই বাড়িতে নিশ্চয় কোনো গুরুতর ব্যাধিগ্রস্ত রোগী আছে। নিশ্চয়ই এই রোগীর সেবা করিবার লোকের অভাব। একদিন বৈকালে সেই বাড়িতে যাইয়া কড়া নাড়িলাম। একজন যুবক আসিয়া দরজা খুলিয়া দিল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনাদের বাড়িতে কাহারও অসুখ হইয়াছে কি?” যুবকটি বলিল, “আমার বড় ভাইয়ের ঘুরেসিস। দেখুন, এই বিদেশে তাহাকে চিকিৎসার জন্য লইয়া আসিয়াছি। কয়েক রাত জাগিয়া আমরা একেবারে হয়রান হইয়া পড়িয়াছি। দেশে থাকিলে আত্মীয়-স্বজনেরা আসিয়া সাহায্য করিত।
এই বিদেশে কাকেই বা চিনি আর কারই বা সাহায্য চাই?” আমি বলিলাম, “আজ রাতে আসিয়া আমি রোগীর সেবা করিব। আপনারা আজিকার মতো ঘুমাইয়া লইতে পারিবেন।”
বাড়ি হইতে খাইয়া-দাইয়া রাত আটটার সময় বন্ধু-কুটিরের সামনে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। বন্ধু-কুটিরের পাশেই ছিল হেল্থ অফিসারের বাসা। সেখানে আমার সহপাঠী শ্রীশ ঘোষ থাকিত। আমি শ্রীশের সঙ্গে দেখা করিয়া বলিলাম, “পাশের বাড়িতে আমি রোগীর সেবা করিতে আসিয়াছি। শেষরাতে আসিয়া তোমার বিছানায় শুইয়া খানিক ঘুমাইব। আমি আসিয়া ডাক দিলে দরজা খুলিয়া দিও।” শ্রীশ বলিল, “আচ্ছা! তুমি আসিয়া আমাকে ডাক দিও।”
চলবে…..
Leave a Reply