সেবা-সমিতির সভ্য হিসাবে
বন্ধু-কুটিরে যাইতেই একজন দরজা খুলিয়া দিল। বাড়ির লোকেরা সত্যই আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। দেখিলাম, দুই-তিনজন লোক রোগীকে ঘিরিয়া বসিয়া আছে। তাহারা মাঝে মাঝে ঘুমে ঝিমাইতেছে। রোগীর মাথার কাছে একটি বধূ বসিয়া বাতাস করিতেছে। প্রথমে আমি তাহাদের নিকট হইতে জানিয়া লইলাম, রাত্রে রোগীকে কি কি ঔষধ খাওয়াইতে হইবে। তারপর বাড়ির লোকদিগকে বলিলাম, “আজিকার মতো আপনারা যাইয়া ঘুমান। শেষরাত্রে আসিয়া রোগীর পাশে বসিবেন। এখনকার মতো রোগীর ভার আমার উপর ছাড়িয়া দিন।” শুনিয়া বাড়ির লোকেরা খুশি হইল। সেকালে যক্ষ্মা রোগের উপশমের জন্য এখনকার মতো পেনিসিলিন প্রভৃতি ঔষধ আবিষ্কৃত হয় নাই। ডাক্তার নির্দেশ দিয়াছিলেন নেকড়ায় জড়ানো একটি ঔষধের পোঁটলা রোগীর নাকের সামনে ধরিয়া রাখিতে হইবে। একটি লোক বসিয়া বসিয়া তাহাই করিতেছিল। রোগীর কোনো জ্ঞান নাই। মাঝে মাঝে আহা-উহু করিতেছে। শুনিলাম, গত তিন-চারদিন ধরিয়াই রোগীর এই অবস্থা। আমি সেই লোকটির হাত হইতে ঔষধের পোঁটলাটি লইয়া রোগীর নাকের কাছে ধরিলাম, বধূটির নিকট হইতে পাখাটি লইয়া অপর হাতে রোগীকে বাতাস করিতে লাগিলাম।
তারপর বাড়ির লোকদের বলিলাম, “আপনারা এখন যাইয়া ঘুমান। দরকার হইলে আপনাদিগকে আমি ডাক দিব।” একে একে বাড়ির লোকেরা সকলেই চলিয়া গেল। বধূটি কিন্তু গেল না। রোগীর পায়ের কাছে যাইয়া সে বসিয়া রহিল। আধ-ঘোমটার আড়াল হইতে তাহার রাঙা টুকুটুকে মুখখানি দেখিতে পাইলাম। সেই মুখে কতকালের বিষাদই যেন মাখিয়া রহিয়াছে। লোকে বলে দুঃখ সুন্দর মুখে বড়ই শোভা বিস্তার করে। সেই শোভাই যেন এই বধূটিকে আরও সুন্দর করিয়াছে। অযত্নবিন্যস্ত মাথার চুল রুক্ষসুক্ষ, পরনে আটপৌরে একখানা শাড়ি। সেই শাড়ির রাঙাপাড় বধূর অলক্তকবিহীন পায়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। চারিদিকে রজনীর নিস্তব্ধতা। এককোণে একটি মাটির প্রদীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলিতেছে। তারই সামনে এই মৃত্যু-পথ-যাত্রী রোগী দারুণ রোগ-যন্ত্রণার সঙ্গে ঝুঁকিতেছে। ওধারে বধূটি বসিয়া। এ যেন মৃত্যু আর সুন্দর পাশাপাশি বসিয়া আছে। দুঃখের তুহিন সাগরে যেন রক্তমৃণালটি শোভা পাইতেছে।
বারবার আমি বধুটিকে বলিলাম, “বোন। তুমি যাও-কিছুক্ষণ ঘুমাইয়া লও। কতদিন হয়তো ঘুমাও নাই। দরকার হইলে তোমাকে ডাকিয়া আনিব।”
বধূটি কোনোই উত্তর দিল না। নীরবে রোগীর পায়ের কাছে বসিয়া রহিল। ওর সমস্ত অঙ্গ ভরিয়া যেন প্রার্থনার ধূপ জ্বলিতেছে। আস্তে আস্তে রাত গড়াইয়া যাইতে লাগিল। জেলখানার বাগান হইতে একটি রাত-জাগা পাখি সহসা চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। আমি বউটিকে আবার বলিলাম, “বোন। তুমিও যদি রাত জাগিবে তবে আমি আসিলাম কেন? যাও, একটু, ঘুমাইয়া আস।”
এবার বধূটি স্বামীর পায়ের উপর তার সিন্দুর-রঞ্জিত মাথাটি বারবার ঠেকাইল। তার মাথার সিন্দুরের দাগে রোগীর পা দুইটি রাঙা হইয়া উঠিল। তারপর মাথার কাপড় গলায় লইয়া দুইহাত জোড় করিয়া কি প্রার্থনা করিয়া ধীরে ধীরে ঘর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতে লাগিল। তাও কি যাইতে চায়?-খানিক যায় আবার পিছন ফিরিয়া স্বামীর দিকে চায়।
বউটি চলিয়া গেলে আমার সমস্ত অন্তর ভরিয়া প্রার্থনার মন্ত্র বাজিতে লাগিল। এই যুবক রোগী কে জানি না। কোথায় তার বাড়ি তাহারও সন্ধান রাখি না, কিন্তু এই সুন্দর বধূটির জন্য-ওর মাথার উজ্জ্বল সিন্দুর ফোঁটার জন্য ভগবান রহমান! এই রোগীকে তুমি ভালো করিয়া দাও। জীবনে এমন সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা কোনোদিন করি নাই।
ধীরে ধীরে রাত গড়াইয়া যাইতেছিল। পাখার বাতাস করিতে করিতে এই সুন্দর বধূটির রাঙা মুখখানি বারবার আমার মনে হইতেছিল। আহা, এমন মেয়েটিকে খোদা তুমি দুঃখের সাগরে ভাসাইও না। কতদিনই বা ইহাদের বিবাহ হইয়াছে। এদের মনে একে অপরকে বলিবার জন্য কত কথারই না মুকুল হইয়াছিল। সেই কথা ভাষার ফুলে ফুটাইয়া উহারা একে অপরকে এখনও বলিতে পারে নাই। খোদা। রহমানের রহিম। এই লজ্জা-বিনম্র বধূটিকে তার মনের কথা বলিবার সুযোগ দাও। মৃত্যু! তুমি ফিরিয়া যাও।
চলবে…..
Leave a Reply