সেবা-সমিতির সভ্য হিসাবে
জেলখানার ঘড়িতে যখন রাত চারটা বাজিল তখন বাড়ির লোকেরা জাগিয়া উঠিল। বউটি ঘুমে-ভরা চোখ মুছিতে মুছিতে স্বামীর পাশে আসিয়া বসিল। মনে মনে ভাবিলাম, “তোমার স্বামীকে যে আবার তোমার হাত ফিরাইয়া দিতে পারিলাম, ইহাও আমার সৌভাগ্যের কথা।”
আমি ধীরে ধীরে আসিয়া শ্রীশের দরজায় ঘা দিতে লাগিলাম। অনেক ডাকাডাকির পর শ্রীশ উঠিয়া বাতি জ্বালাইল, কিন্তু দরজা খুলিয়া দিল না। ভিতর হইতেই বলিল, “তুমি এই যক্ষ্মারোগীর সেবা করিয়া শেষরাত্রে যে আমার বিছানায় ঠাঁই লইবে ইহা কখনও হইবার নয়।”
আমি বলিলাম, “এ রোগীর তো যক্ষ্মা হয় নাই। পুরেসিস হইয়াছে।” শ্রীশ বলিল, “যাহা গুরেসিস তাহাই যক্ষ্মা। ও-বাড়ির লোকেরা তোমাকে ভুল সংবাদ দিয়াছে। তুমি যাওয়ার পর আমি রোগীর বিষয়ে সকল খবর লইয়াছি। তার সাংঘাতিক যক্ষ্মা। আর ডাক্তরেরা বলিয়াছে, রোগীর বাঁচিবার আশা নাই।” এই বলিয়া শ্রীশ বাতি নিবাইয়া দিল। শ্রীশের ঘরের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলাম। এত রাত পর্যন্ত তবে আমি একজন যক্ষ্মারোগীর সেবা করিয়াছি। যে যক্ষ্মারোগের জীবাণু বাতাসে উড়িয়া ভালো মানুষকে সংক্রামিত করে। আর আমি কিনা সেই রোগীকে হাত দিয়া স্পর্শ করিয়াছি। সেই হাতে আবার নিজের মুখ-চোখ মুছিয়াছি। তবে তো আমার সকল অঙ্গ ভরিয়া যক্ষ্মারোগের জীবাণু।
কিন্তু এত রাত্রে এখন আমি কোথায় যাই? শহর হইতে প্রায় আড়াই মাইল দূরে আমার বাড়ি। সেই সুদীর্ঘ জনশূন্য পথে একা যাইতে সাহসে কুলায় না। কত বছর আগে আমি শ্মশানে-মশানে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছি। তখন অভ্যাস ছিল। ভয়কে জয় করিতে পারিতাম। এখন অভ্যাস হারাইয়া ফেলিয়াছি। রেল-সড়ক পার হইলে হদু মল্লিকের তালগাছতলা দিয়া বাড়ির পথ। সেই তালগাছে হদু মল্লিকের পুতের বউ গলায় দড়ি দিয়া মরিয়াছিল। সেই পথে বাড়ি ফিরিতে মোটেই সাহসে কুলাইতেছিল না।
তখন স্থির করিলাম, রাজেন্দ্র কলেজের বারান্দায় যাইয়া শুইয়া থাকিব। অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া তাহাই করিলাম। শেষরাত্রে বেশ ঠাণ্ডা পড়িয়াছে। গায়ে দেওয়ার কোনো কাপড় নাই। কোঁচার খোঁটের অর্ধেকটা শানের উপর বিছাইয়া শুইয়া পড়িলাম। একে তো গায়ে কোনো কাপড় নাই, তার উপর চারিধারের উন্মুক্ত প্রান্তরের যত মশা আসিয়া আমাকে আক্রমণ করিল। যদিবা একটু তন্দ্রা আসিতে চায়, ভয়ে ভয়ে ঘুমাই না। কলেজের দারোয়ান মারু যদি এখানে অপরিচিত লোককে শুইয়া থাকিতে দেখিয়া মাথায় লাঠির বাড়ি মারে তবে কি উপায় হইবে! তাহা ছাড়া শ্রীশের বর্ণিত যক্ষ্মারোগ যেন আমার আধ-তন্দ্রার ঘোরে জীবন্ত হইয়া আমার সামনে আসিয়া দাঁড়ায়। আর সামান্য ঘণ্টা দুই মাত্র রাত আছে। কিন্তু এই ঘণ্টা দুই কি আমার কাটিতে চাহে।
পুব আকাশে যখন আবছা আবিরের রেখা দেখা দিল তখন আমি উঠিয়া বাড়ির পথে রওয়ানা হইলাম। এই এত সকালেই গায়ে সাবান মাখিয়া স্নান করিয়া লইলাম। তারপর সেই বন্ধু-কুটিরের রোগীটির আর কোনো খবরই লই নাই।
সাত-আট দিন পরে সকাল দশটা-এগারোটার সময় আমাদের অম্বিকাপুর স্টেশনে ঘুরিতেছি। দেখিলাম, সেই বন্ধু-কুটিরের লোকগুলি একটি কামরায় বসিয়া। জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছিলাম, সেই রোগীর অবস্থা এখন কেমন। আর জিজ্ঞাসা করিতে হইল না। কামরার এককোণে সাদা থান পরিধানে সেই বউটি বসিয়া। আজ তার কপালে এয়োতির প্রতীক চিহ্নস্বরূপ সেই সিন্দুরবিন্দুটি আর শোভা পাইতেছে না। রোগীর সেবা করিবার রাত্রেও বউটিকে বিষাদময়ীই দেখিয়াছিলাম। সেই বিষাদের অন্যরূপ। স্বামীকে বাঁচাইবার দুরন্ত আশা সেদিন এই বিষাদময়ীকে সুন্দরের রূপ দিয়াছিল। আজকের এই বিষাদময়ী একেবারে ভিন্ন। এই শ্বেত বসন পরিহিতা বিধবা মেয়েটির সারা অঙ্গ হইতে যেন কোন সপ্ত আকাশের করুণার শব্দহীন রাগিণী সমস্ত আকাশে-বাতাসে ছড়াইয়া পড়িতেছিল। সেই তো প্রায় চল্লিশ বৎসরের ঘটনা। কিন্তু বউটিকে যেন আজও মনে মনে স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি।
চলবে…..