মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:১৫ অপরাহ্ন

‘পোশাক শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে মালিকদের আর্থিক সহায়তা দেবে না সরকার, অস্থিরতা হলে ব্যবস্থা’

  • Update Time : শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০২৫, ৩.৫৬ পিএম

মরিয়ম সুলতানা

প্রতিবারের মতো এবারও ঈদের আগে বকেয়া বেতন ও বোনাসের দাবিতে পোশাক খাতের শ্রমিকদের রাস্তায় বিক্ষোভ করতে হচ্ছে। সরকার বলছে, পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব মালিকদের।

অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “শ্রমিকের বেতন-বোনাস দেওয়ার জন্য মালিকদের কোনো আর্থিক সহায়তা দেবে না সরকার। তবে শ্রমিক অসন্তোষে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বা অস্থিরতা হলে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে।”

তৈরি পোশাক খাতের মালিকেরা আবার শ্রমিকদের দাবি ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের বিষয়কে অযৌক্তিক বলে বর্ণনা করছেন। তারা ব্যাংক থেকে অর্থ না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন।

তারা বলছেন, ব্যাংক তাদেরকে টাকা দিচ্ছে না বলে বেতন-বোনাস দিতে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া সরকার তাদেরকে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে কোনো প্রকার সহযোগিতা করছে না।

সরকারও আর্থিক সহায়তা না করার অবস্থান নিয়েছে। সেটা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা।

এদিকে, শ্রমিকরা এবার বেতন-বোনাসের পাশাপাশি ঈদের ছুটি বৃদ্ধির দাবিও জানাচ্ছেন। এসব দাবি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই তারা রাস্তা অবরোধ, বিক্ষোভ করছেন।

সম্প্রতি আলোচিত নায়ক ও গার্মেন্টস মালিক অনন্ত জলিলের মালিকানাধীন সাভারের হেমায়েতপুরের এজে আই ও এবি গ্রুপেও শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল বুধবার অনন্ত জলিল এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রমিক সংগঠন ও মালিকদের সংগঠনের একাংশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন।

তিনি বলেছেন, লাগাতর শ্রমিক অসন্তোষের জন্য শ্রমিক সংগঠন এবং বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএ’র একাংশ দায়ী।

তার ভাষ্য, “বিজিএমই-তে দুই শতাংশ লোক আছে, যারা এই শ্রমিক নেতাদের সাথে মিশে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করে, দলাদলির চেষ্টা করে। গার্মেন্টস কোনও রাজনীতির বস্তু না। এটা ইন্ডাস্ট্রি, এইটা কোনও রাজনীতির খেলার মাঠ না।”

তিনি আরও অভিযোগ করেন, পোশাক কারখানা সংশ্লিষ্ট ২৪০টি গ্রুপ অব কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হওয়ায় দেশে ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা বেড়ে গেছে।

যদিও তার এই কোম্পানি বন্ধের দাবিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

প্রেস সচিব লিখেছেন, গত সাত মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই সপ্তাহে গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভারের প্রায় ৯৯ শতাংশ কারখানা খোলা ছিল।

তবে শ্রমিক নেতারা ও বিজিএমই বিবিসিকে জানিয়েছেন, অনেক কারখানা সম্প্রতি বন্ধ হয়েছে। এছাড়া, কারখানাগুলোতে যা হচ্ছে, এর জন্য মালিকপক্ষ ও সরকারকে দুষছেন শ্রমিক নেতারা।

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তৈরি পোশাক খাত গুরুত্বপূর্ণ

এবার ঈদেও বেতন-বোনাসের সমস্যা

শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের শিল্পকারখানায় তাদের চারটি দাবি না মানায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রথমত ছুটি বাড়ানো, আরেকটি হলো ঈদ বোনাস।এরসঙ্গে চলতি মাসের অগ্রিম বেতন এবং বকেয়া বেতন ইছেন তারা।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আক্তার বিবিসিকে বলেন, “আজকে যে আনরেস্ট (অস্থিরতা) হয়েছে, তা ঈদের ছুটি নিয়ে। কারণ ঈদের ছুটি কতদিন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর শ্রম আইনেও উৎসব ছুটি কম।”

“কোনও কোনও কারখানায় ঈদ বোনাস সংক্রান্ত ঝামেলা হচ্ছে। কিন্তু এর চেয়ে বড় সমস্যা হলো, গত পাঁচই অগাস্টের পর বেশ কিছু বড় বড় কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সেইসব কারখানার শ্রমিকদের পাওনাদি নিয়েই গণ্ডগোল হচ্ছে,” বলে জানান তিনি।

তার মতে, প্রত্যেকটা কোম্পানিকেই ঈদের সময় আগের ও চলতি মাসের বেতন এবং বোনাস দিতে হয়। এই নিয়ম নিয়ে কারখানাগুলোয় সমস্যা হওয়ার কথা নয়। মালিকপক্ষ ও সরকার শ্রমিকদের দাবিকে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় এই অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে।

“তারা যদি শুরু থেকেই শ্রমিকদের দাবী-দাওয়াকে গুরুত্ব দেয়, তাহলে এই ধরনের পরিস্থিতি হয় না। শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে মালিক ও সরকারের আগ্রহ কম,” বলেন শ্রমিক নেতা বাবুল আক্তার।

কারখানাগুলোতে কার্যকর কোনও ট্রেড ইউনিয়ন নেই, সেটিও অস্থিরতার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারা।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি’র সভাপতি তাসলিমা আখতার বিবিসি বাংলাকে বলেন, এ বছরও যেন শ্রমিকদেরকে ঈদের বেতন বোনাসের দাবিতে রাস্তায় নামতে না হয়, সেজন্য শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের সাথে এক মাস আগেই বৈঠক হয়।

“২০ তারিখের মাঝে যেন বেতন বোনাস দেয়, ঈদের আগে যেন শ্রমিক না ছাঁটাই করে‒ তাদেরকে এই আহ্বান করা হয়। তারা তাতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হতে দেখিনি। কয়েকটি কারখানায় বোনাস নিয়ে উদ্বেগ চলছে,” বলেন তিনি।

তার মতে, “মালিকেরা চাইলে নিশ্চয়ই বেতন বোনাস দিতে পারেন। না পারার তো কিছু নাই। দিতে চায় না বলেই সমস্যা হয়। প্রতিবছরই কিছু কিছু কারখানা এই কাজ করে।”

ঈদের আগে প্রায় প্রতিবছর-ই বিক্ষোভ করেন পোশাক শ্রমিকরা

কেন বেতন দিতে পারছে না কারখানাগুলো?

গতকালের সংবাদ সম্মেলনে অনন্ত জলিল বলেছেন, তারা আশা করেছিলেন, ঈদের সময় অন্তত বেতন দেওয়ার জন্য ব্যাংক ঋণ দেবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি।

তার প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক কাজ করে জানিয়ে তিনি বলেন, “এই মার্চ মাসে ফেব্রুয়ারির বেতন দিতে হবে, ঈদের বোনাস দিতে হবে, আবার মার্চ মাসের ৫০ শতাংশ বেতনও অগ্রিম দিতে হবে। একটা গার্মেন্টস মালিক এই তিন জিনিস একসাথে কোথায় পাবে?”

বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল নিজেও গার্মেন্টস মালিক।

তার সাথে কথা হলে তিনিও এই একই সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “সব ঈদে তিনটা বেতন-বোনাস একসাথে পড়ে না। এবার গত মাসের বেতন দিতে হইছে। ঈদের বোনাস এবং রানিং মাসের অগ্রিমও দিতে হচ্ছে। তাই চাপ বেশি পড়ছে।”

তিনিও এখানে ব্যাংকের ওপর দায় চাপান। তিনি বলেন, “ব্যাংকিং খাত এখন অস্থিরতার মাঝে আছে। কারখানাগুলো ব্যাংকের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। মালিকেরা সাধারণত টাকা ম্যানেজ না করতে পারলে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। কিন্তু ব্যাংক এখন সহজে লোন দেয় না।”

মালিকেরা “ব্যাংক থেকে অর্থ জোগাড় করতে না পারলে অ্যাসোসিয়েশনের কাছে সাহায্য চায়” জানিয়ে মহিউদ্দিন রুবেল এও বলেন, “প্রতিবছরই ঈদের আগে এই শ্রমিক অসন্তোষ আমরা দেখি, এটি সত্যি। কিন্তু এই দেখাটা ঈদের আগে শেষ হয়ে যায়, এটাও সত্যি।”

বাংলাদেশে বর্তমানে তিন হাজার গার্মেন্টস আছে। এসব কারখানার বেশিরভাগই কিছুটা দেরিতে হলেও ঈদের আগে বেতন-বোনাস দিয়ে দেয় বলে মত তার।

“যারা একটু টানাপোড়েনের মাঝে থাকে, মানে যারা ফিন্যান্সিয়ালি স্ট্রং না, তারা সময়মতো দিতে পারে না। কিন্তু যাদের এই ঝামেলা নেই, তারা সহজেই দিতে পারে,” বলেন মহিউদ্দিন রুবেল ।

“বাংলাদেশে অনেকগুলো ব্যাংক ছিল। কিন্তু সেগুলোর প্রায় ১০টা দেউলিয়া হয়ে গেল। সেখানে তিন হাজার গার্মেন্টসের ৫০-১০০টায় সমস্যা হতে পারে না?” তিনি প্রশ্ন করেন।

নানা দাবি-দাওয়া আদায়ে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা (ফাইল ফটো)

এছাড়া, কারখানাগুলোয় রপ্তানির হার বাড়লেও খরচ কমেনি বলেও তিনি জানান। কারণ বর্তমানে একদিকে যেমন সবকিছুর দাম বাড়তি, অপরদিকে ব্যাংকের সুদের হারও বেড়েছে। তাই, এইসময়ে “যে পরিমাণ টাকা জেনারেট করা দরকার, মালিকরা তা পারছেন না।”

তবে বর্তমানে শ্রমিকরা কথায় কথায় রাস্তায় নেমে আসছে বলেও মন্তব্য করেন মহিউদ্দিন রুবেল।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম শ্রমিকদের আন্দোলনের সমালোচনা করে বলেন, “এই সরকারের আমলে দাবী আদায়ের উৎসব শুরু হয়েছে। তারা দেখছে যে রাস্তা বন্ধ করে দাবি আদায় করতে পারছে। আর্মি, পুলিশ, কেউ তাদেরকে কিছু বলছে না।”

তিনি জানান, শ্রমিকরা এখন বেতনের সমান বোনাস চাচ্ছে। কিন্তু শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি ঈদে মালিকরা শ্রমিকদেরকে মূল বেতনের (বেসিক) নীচে বোনাস দিতে পারবে এবং বোনাস পাওয়ার জন্য ন্যূনতম এক বছর কাজ করতে হবে। “কিন্তু এখানে শ্রমিকরা একঘেয়েমি করছে।”

সরকার থেকে কারখানা মালিকদের বলা হয়েছে যে চলতি মাসের অর্ধেক বেতন অগ্রিম দিতে হবে।

“কিন্তু আমরা আইনগতভাবে এটা দিতে বাধ্য নয়। কারণ আমরা প্রতি মাসের সাত কর্মদিবসের মাঝে বেতন দেই। এই ঈদে সাত কর্মদিবসের আগেই হবে,” যোগ করেন তিনি।

তার মতে, আইন অনুযায়ী বাধ্য না হলেও মানবিকতার খাতিরে তারা যার যার সাধ্যমতো অগ্রিম বেতন দিচ্ছেন। কিন্তু শ্রমিকরা তাতে সন্তুষ্ট না। তারা বিক্ষোভ চালিয়েই যাচ্ছে।

শ্রমিকদের আন্দোলন প্রায়ই সহিংস আকার ধারণ করে

গত এক বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকায় কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। একইসাথে, গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত না থাকায় কারখানা বন্ধ থেকেছে এবং ঈদের সময় পাওনাদাররাও তাদের টাকা চায় বলে জানান মোহাম্মদ হাতেম।

সবমিলিয়ে এতদিন ঠিকভাবে উৎপাদন করতে না পারায় কারখানাগুলো লাভ করতে পারেনি। তাই, অনেক কারখানা নিয়মিত বেতন দিলেও এখন একসাথে এত টাকা বেতন দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে এবং সমস্যা সমাধানে “ব্যাংকের কাছে গিয়ে বসে আছে।”

কিন্তু ব্যাংক “নানা অজুহাত দেখিয়ে” বলছে যে টাকা দিবে না, অভিযোগ মি. হাতেমেরও।

টাকা দিতে না চাওয়া সংক্রান্ত এই কমন অভিযোগ নিয়ে সরকারের উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, “তারা (পোশাক খাতের মালিকেরা) ব্যাংকে ওভারলোন করে রাখছে। ওভারডিউ রয়ে গেছে। ব্যাংক ডিফল্টার। ব্যাংক এখন টাকা কেটে রাখতেছে। তাদের ব্যাংকের সাথে বোঝাপড়া করা উচিত।”

সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বক্তব্যে এটা পরিস্কার করে বলা যাচ্ছে না যে, শেষপর্যন্ত পোশাক খাতের সমস্যার সমাধান কিভাবে হবে।

বিবিসি নিউজ বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024