পঞ্চান্ন বছর বাঙালি স্বাধীন হলেও তার স্বাধীনতা দিবসটি সব সময় একই ভাবে আসেনি। কেন আসেনি সে প্রশ্নটি বাঙালি জীবনে অনেক বড়। কিন্তু ক্ষমতা লোভ, রাজনৈতিক অস্থিশীলতা, যে পাকিস্তানের বর্বরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে দেশ স্বাধীন হয়েছিলো, সেই পাকিস্তানের প্রতি এক ধরনের প্রেমে আটকে থাকা একটি গোষ্টি- সব মিলে স্বাধীনতা দিবসটি বাঙালির কাছে কখনও একইভাবে এলো না গত ৫৫ বছরে।
কেন একই ভাবে এলনা এ নিয়ে বাঙালির কোন প্রজম্ম এ প্রশ্ন করবে বা এর উত্তর খুঁজবে -তা এখনও কেউ বলতে পারে না। কারণ একটি সুস্থির, জ্ঞান-ভিত্তিক প্রজম্ম ছাড়া কখনই স্বাধীনতাকে উপলব্দি করা ও তাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাঙালির সব থেকে বড় দুর্ভাগ্য হলো, বাঙালি সেই প্রজম্ম গড়ে তুলতে পারেনি। বাঙালি ৩০, ৪০ ও ৫০ এর দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে জ্ঞান ভিত্তিক প্রজম্ম গড়ে তোলা থেকে দূরে যেতে শুরু করেছে।
তাই কখনও দেখা যায় এ দেশে স্বাধীনতা দিবস এলে রাজপথে জাতীয় পতাকা বিক্রির হিড়িক পড়ে যায় আবার কখনও কখনও দেখা যায়- যারা রাজপথে জাতীয় পতাকা বিক্রি করতো তারা অন্য ব্যবসায়ে চলে গেছে। আর যারা পতাকা কিনতো তারা নীরব হয়ে গেছে।
এ সবের পরেও বাঙালি জাতির স্বাধীনতার দীর্ঘ বাইশ বছরের সংগ্রাম এক গৌরবময় সংগ্রাম। সেখানে ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আছে, সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আছে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের আন্দোলন আছে, সর্বোপরি আছে স্বাধীনতা ও মুক্তির যুদ্ধ।
বাঙালির এই দীর্ঘ বাইশ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা হিসেবে, ধাপে ধাপে শীর্ষে উঠে এসেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যেমন ১৯৭০ এর নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে জন-রায়ের মাধ্যমে বাঙালির শীর্ষ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তেমনি লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ভাষায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন, “ বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামী চেতনার শীর্ষ বিন্দু”। আর সেই সংগ্রামী চেতনা ছিলো মূলত একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টির মাধ্যমে এক পশ্চাদপদ জাতিগোষ্টিকে পৃথিবীর পথে পা রাখার সুযোগ করা দেয়া।
পৃথিবীর অনেক নরগোষ্টিতে এমনই গেইম চেঞ্জার আসেন। যিনি তার জাতি বা নরগোষ্টিকে একটি মুক্ত আকাশ দিয়ে যান। এর পরে তিনি বেঁচে থাকলেন, কী মারা গেলেন -এমনকি তাকে কেউ স্মরণ করলো, কি করলো না- এ নিয়ে তার কিছু যায় আসে না। এমনকি বাতাসের মাঝে বসে যেমন বাতাসকে বোঝা যায় না, তেমনি কোন জাতির স্বাধীন ভূখন্ড, স্বাধীন মনোজগত তৈরির এই গেইম চেঞ্জাররাও এক ধরনের বায়ুমন্ডলের বাতাসের মতো। তাকে এড়ানোও যেমন কঠিন উপলব্দি ও ধারণ করাও তেমনি কঠিন।
যেমন আজ যে বাঙালি সহজ ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে, এ যে বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সারা জীবন সংগ্রামের ফল তা বাঙালি একবারও না ভাবলে রবীন্দ্রনাথের কোন ক্ষতি নেই। তার হাতে বাংলা ভাষার রূপান্তরের আগের বাংলাকে পেছনে ফেলে- তার হাত বেয়ে আসা বাংলা ভাষা যেমন একটি নতুন পৃথিবী দিয়েছে- একটি ভাষার মানুষকে- তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের সংগ্রামের ও নেতৃত্বের ফসল একটি স্বাধীন ভূখন্ড- এই জাতিকে একটি নতুন পৃথিবী দিয়ে গেছে।
তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি না থাকুক, পাকিস্তানী হানাদারদেরকেও যদি আড়াল করা হয়- তারপরেও বলা যায়, বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালিকে একটি নতুন বায়ুমন্ডল দিয়ে গেছে। যে বায়ুমন্ডলে কখনও কখনও দূষণ নামতে পারে, কখনও নির্মল বায়ূ আসতে পারে- তারপরেও সত্য, ওই বায়ুমন্ডলের বাতাসেই বাঙালি চিরকাল শ্বাস গ্রহন করবে।