০৫:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৭০)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫
  • 42

তেহের ফকির

দাউদাউ করিয়া ধামাইলের কাঠ জ্বলিতে লাগিল। ফকির তখন হাতে সুন্দরী কাঠের একখানা রুল লইয়া সেই আগুনের চারিদিকে ঘুরিতে লাগিলেন। ঢাকের বাদ্য প্রায় গম্ভীর হইয়া আসিল। আগুন দাউদাউ করিয়া জ্বলিয়া শত লেলিহান জিহ্বা মেলিল। সহসা ফকির

সেই আগুনের মধ্যে একঘটি দুধ ঢালিয়া দিলেন। চারিদিকের লোকজন ঘন ঘন আল্লার ধ্বনি দিতে লাগিল। ফকির তখন পা দিয়া সেই মানুষসমান আগুন উছলাইয়া দিলেন। বাঁশ-নাচুয়ে লোকেরা সঙ্গে সঙ্গে সেই আগুনের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া নাচিতে আরম্ভ করিল। সেকি নাচ-আর সেকি ঢোলের বাদ্য। আমার বুক কি এক উত্তেজনায় দুরু দুরু করিয়া কাঁপিতে লাগিল। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন নিবিয়া গেল। বাঁশ-নাচুয়ের দলের লোকেরা তখন ঢোলবাদ্য সহকারে শ্মশানঘাটের নিকট মরা পদ্মায় যাইয়া যার যার বাঁশ পানিতে ছাড়িয়া দিয়া স্নান করিয়া ঘরে ফিরিল।

তেহের ফকিরের মৃত্যুর পর আর আমাদের গ্রামে ধামাইল হয় না। লোকে বলে তেহের ফকির মন্ত্র-তন্ত্র জানিতেন। সেই মন্ত্রের বলে তিনি আগুনের তেজ নষ্ট করিয়া দিতেন। অবিশ্বাসীরা বলে, মন্ত্র-তন্ত্র কিছুই না। আগুনের উপর নাচিবার আগে নাচের দলের লোকেরা নদীতে স্নান করিয়া আসিত। একে তো মাঘমাসের শীত। তার উপর ঠাণ্ডা কাদা-মাটিতে অনেকক্ষণ পা রাখিয়া দিত। ভিজা পায়ে তাহারা বাঁশ লইয়া সেই আগুনের উপরে এমনই দ্রুত তালে নাচিত যে আগুনের তাপ তাহাদের পায়ে লাগিত না।

তেহের ফকিরের ছেলে রহিম মল্লিকের কথা আগেই একাধিকবার বলিয়াছি। তাকে আমি গ্রাম-সম্পর্কে চাচা বলিয়া ডাকিতাম। চাচা বিবাহ করিলেন অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়েকে। এই মেয়েটির পূর্ব-স্বামী একজন শিক্ষিত চাকুরে ছিলেন। গরিব বিধবাদের যা হয়, বহু অভিভাবকের কৌশল-জাল ছিন্ন করিয়া চাচা এই মেয়েটিকে বিবাহ করিলেন। এজন্য তাঁহার বহু টাকা খরচ করিতে হইল। গ্রামে রটনা হইল, কি চাই, প্রতিমার মতো দেখিতে এমন একটি মেয়েকে রহিম মল্লিক বিবাহ করিয়াছে। সেই মেয়েকে একদিন দেখিতে গেলাম। যাইয়া দেখি, সত্যিই তিনি প্রতিমার মতো। সম্পর্কে তিনি আমার চাচি হন। চাচি আমাকে পিঁড়ি আনিয়া বসিতে দিলেন। ঘর হইতে মুড়ি আনিয়া খাইতে দিলেন।

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৭০)

১১:০০:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

তেহের ফকির

দাউদাউ করিয়া ধামাইলের কাঠ জ্বলিতে লাগিল। ফকির তখন হাতে সুন্দরী কাঠের একখানা রুল লইয়া সেই আগুনের চারিদিকে ঘুরিতে লাগিলেন। ঢাকের বাদ্য প্রায় গম্ভীর হইয়া আসিল। আগুন দাউদাউ করিয়া জ্বলিয়া শত লেলিহান জিহ্বা মেলিল। সহসা ফকির

সেই আগুনের মধ্যে একঘটি দুধ ঢালিয়া দিলেন। চারিদিকের লোকজন ঘন ঘন আল্লার ধ্বনি দিতে লাগিল। ফকির তখন পা দিয়া সেই মানুষসমান আগুন উছলাইয়া দিলেন। বাঁশ-নাচুয়ে লোকেরা সঙ্গে সঙ্গে সেই আগুনের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া নাচিতে আরম্ভ করিল। সেকি নাচ-আর সেকি ঢোলের বাদ্য। আমার বুক কি এক উত্তেজনায় দুরু দুরু করিয়া কাঁপিতে লাগিল। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন নিবিয়া গেল। বাঁশ-নাচুয়ের দলের লোকেরা তখন ঢোলবাদ্য সহকারে শ্মশানঘাটের নিকট মরা পদ্মায় যাইয়া যার যার বাঁশ পানিতে ছাড়িয়া দিয়া স্নান করিয়া ঘরে ফিরিল।

তেহের ফকিরের মৃত্যুর পর আর আমাদের গ্রামে ধামাইল হয় না। লোকে বলে তেহের ফকির মন্ত্র-তন্ত্র জানিতেন। সেই মন্ত্রের বলে তিনি আগুনের তেজ নষ্ট করিয়া দিতেন। অবিশ্বাসীরা বলে, মন্ত্র-তন্ত্র কিছুই না। আগুনের উপর নাচিবার আগে নাচের দলের লোকেরা নদীতে স্নান করিয়া আসিত। একে তো মাঘমাসের শীত। তার উপর ঠাণ্ডা কাদা-মাটিতে অনেকক্ষণ পা রাখিয়া দিত। ভিজা পায়ে তাহারা বাঁশ লইয়া সেই আগুনের উপরে এমনই দ্রুত তালে নাচিত যে আগুনের তাপ তাহাদের পায়ে লাগিত না।

তেহের ফকিরের ছেলে রহিম মল্লিকের কথা আগেই একাধিকবার বলিয়াছি। তাকে আমি গ্রাম-সম্পর্কে চাচা বলিয়া ডাকিতাম। চাচা বিবাহ করিলেন অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়েকে। এই মেয়েটির পূর্ব-স্বামী একজন শিক্ষিত চাকুরে ছিলেন। গরিব বিধবাদের যা হয়, বহু অভিভাবকের কৌশল-জাল ছিন্ন করিয়া চাচা এই মেয়েটিকে বিবাহ করিলেন। এজন্য তাঁহার বহু টাকা খরচ করিতে হইল। গ্রামে রটনা হইল, কি চাই, প্রতিমার মতো দেখিতে এমন একটি মেয়েকে রহিম মল্লিক বিবাহ করিয়াছে। সেই মেয়েকে একদিন দেখিতে গেলাম। যাইয়া দেখি, সত্যিই তিনি প্রতিমার মতো। সম্পর্কে তিনি আমার চাচি হন। চাচি আমাকে পিঁড়ি আনিয়া বসিতে দিলেন। ঘর হইতে মুড়ি আনিয়া খাইতে দিলেন।

চলবে…..