০৬:৪২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৬৬)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:১১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫
  • 47

অন্যান্য সেবাকাজ

তখন পাড়ায় বাহির হইলাম শ্মশানযাত্রীর খোঁজে। প্রায় সব বাড়িতেই জ্বর। দুই-একজন যাহারা ভালো আছে তাহারা কেহই শ্মশানে যাইতে রাজি হইল না। অতুলের বাবার এক বন্ধু ছিলেন বাবু অক্ষয়কুমার সেন। তিনি ফরিদপুরের এসডিও ছিলেন। বড় চাকরি করিতেন বলিয়াও গরিব বন্ধুকে ভুলেন নাই। তিনি বলিলেন, “আমি শ্মশানে যাইব।”

আমরা তিনজনে সেই খোকার মৃতদেহ লইয়া গোবিন্দপুর শ্মশানঘাটে গেলাম। শ্মশানঘাটে সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে থাকিতে আমি দেখিয়া দেখিয়া শিখিয়াছিলাম কি করিয়া চিতায় কাঠ সাজাইতে হয়। সেই অভিজ্ঞতা আজ কাজে লাগিল। আমিই কাঠ আনিয়া চিতা সাজাইয়া দিলাম। সেই চিতার উপর খোকাকে যখন শোয়াইয়া দিলাম তখন আমার চোখের পানি বাঁধ মানিল না।

ইহার পরে অতুলের আরও দুইটি ভাই মারা গেল। ইহারা সকলেই লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। গ্রামদেশে বহুলোক বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। সেজন্য তাহাদের বাপ-মায়েরা দুঃখ করে না কারণ সেখানে বহু অসুস্থ লোকেরই চিকিৎসা হয় না। কিন্তু মধ্যবিত্ত সমাজের বাপ-মা, যাহারা বর্তমান চিকিৎসাবিদ্যার সুফল জানে, তাহাদের এতগুলি ছেলে যখন বিনা চিকিৎসায় মারা গেল তাহাদের দুঃখ কল্পনাও করা যায় না।

ইহার পরে অতুলের মা ও বাবাকে ম্যালেরিয়া জ্বরে ধরিল। অতুলের অসুখও বাড়িয়া গেল। আমি সারারাত্র জাগিয়া তাহাদের দেখাশুনা করি। একদিন অতুল জ্বরের ঘোরে আমার হাতখানা বুকের উপর লইয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “বল! তুমি আমার কে?” আমি বলিলাম, “আমি তোমার বন্ধু জসীম।” অতুল বলিল, “না, তুমি মানুষ নও। মানুষের ছদ্মবেশে তুমি দেবতা।”

তখন আমার সমস্ত গায়ে রোমাঞ্চ হইল। মনে হইল, এতদিন রাত্রি জাগিয়া ইহাদের যে সেবা করিয়াছি, আজই আমি ইহার চরমতম পুরস্কার পাইলাম।

কিছুদিন পরে অতুল ভালো হইয়া উঠিল। শ্রীশবাবুর বাসার মতো অতুলদের বাসায়ও আমার অবারিত দ্বার হইল। ইহার পরে অতুলদের বাসায় কাহারও কোনো অসুখ হইলে অতুল নিজেই তাহার সেবা-শুশ্রূষা করিত। অতুলদের বাড়ি যাইয়া আমরা দুই বন্ধু একত্র পড়াশুনা করিতাম। অতুলের মতো বন্ধু পাওয়া খুবই সৌভাগ্যের বিষয়। পরের জন্য সে এত কাজ করিয়া দিত যাহার তুলনা মেলে না।

 

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৬৬)

১১:০০:১১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

অন্যান্য সেবাকাজ

তখন পাড়ায় বাহির হইলাম শ্মশানযাত্রীর খোঁজে। প্রায় সব বাড়িতেই জ্বর। দুই-একজন যাহারা ভালো আছে তাহারা কেহই শ্মশানে যাইতে রাজি হইল না। অতুলের বাবার এক বন্ধু ছিলেন বাবু অক্ষয়কুমার সেন। তিনি ফরিদপুরের এসডিও ছিলেন। বড় চাকরি করিতেন বলিয়াও গরিব বন্ধুকে ভুলেন নাই। তিনি বলিলেন, “আমি শ্মশানে যাইব।”

আমরা তিনজনে সেই খোকার মৃতদেহ লইয়া গোবিন্দপুর শ্মশানঘাটে গেলাম। শ্মশানঘাটে সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে থাকিতে আমি দেখিয়া দেখিয়া শিখিয়াছিলাম কি করিয়া চিতায় কাঠ সাজাইতে হয়। সেই অভিজ্ঞতা আজ কাজে লাগিল। আমিই কাঠ আনিয়া চিতা সাজাইয়া দিলাম। সেই চিতার উপর খোকাকে যখন শোয়াইয়া দিলাম তখন আমার চোখের পানি বাঁধ মানিল না।

ইহার পরে অতুলের আরও দুইটি ভাই মারা গেল। ইহারা সকলেই লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। গ্রামদেশে বহুলোক বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। সেজন্য তাহাদের বাপ-মায়েরা দুঃখ করে না কারণ সেখানে বহু অসুস্থ লোকেরই চিকিৎসা হয় না। কিন্তু মধ্যবিত্ত সমাজের বাপ-মা, যাহারা বর্তমান চিকিৎসাবিদ্যার সুফল জানে, তাহাদের এতগুলি ছেলে যখন বিনা চিকিৎসায় মারা গেল তাহাদের দুঃখ কল্পনাও করা যায় না।

ইহার পরে অতুলের মা ও বাবাকে ম্যালেরিয়া জ্বরে ধরিল। অতুলের অসুখও বাড়িয়া গেল। আমি সারারাত্র জাগিয়া তাহাদের দেখাশুনা করি। একদিন অতুল জ্বরের ঘোরে আমার হাতখানা বুকের উপর লইয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “বল! তুমি আমার কে?” আমি বলিলাম, “আমি তোমার বন্ধু জসীম।” অতুল বলিল, “না, তুমি মানুষ নও। মানুষের ছদ্মবেশে তুমি দেবতা।”

তখন আমার সমস্ত গায়ে রোমাঞ্চ হইল। মনে হইল, এতদিন রাত্রি জাগিয়া ইহাদের যে সেবা করিয়াছি, আজই আমি ইহার চরমতম পুরস্কার পাইলাম।

কিছুদিন পরে অতুল ভালো হইয়া উঠিল। শ্রীশবাবুর বাসার মতো অতুলদের বাসায়ও আমার অবারিত দ্বার হইল। ইহার পরে অতুলদের বাসায় কাহারও কোনো অসুখ হইলে অতুল নিজেই তাহার সেবা-শুশ্রূষা করিত। অতুলদের বাড়ি যাইয়া আমরা দুই বন্ধু একত্র পড়াশুনা করিতাম। অতুলের মতো বন্ধু পাওয়া খুবই সৌভাগ্যের বিষয়। পরের জন্য সে এত কাজ করিয়া দিত যাহার তুলনা মেলে না।

 

চলবে…..