স্বদেশ রায়
ঘটনার দিকে তাকালে মনে হবে, শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে পাঁচ আগস্ট দুপুরের দিকে হঠাৎ করেই। কিন্তু ভবিষ্যতের গবেষকরা ঠিকই বলবেন, শেখ হাসিনার পতন শুরু হয় ২০১৮ নির্বাচনের আগের দিনের রাত থেকে। ওই রাতে যখন এক শ্রেণীর আওয়ামীলীগ কর্মী ব্যালট পেপার কেটে ব্যালটবক্স ভর্তি করতে থাকে- তখন থেকেই শুধু তাঁর পতন নয়, ১৯৪৯ সালে নবাব ও জমিদারদের মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে পূর্ব বাংলার প্রজাদের সন্তানরা আসাম থেকে আগত প্রজা নেতা মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে প্রজাদের আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়ে ছিলেন, যার নেতৃত্ব হাতে নিয়ে বঙ্গবন্ধু একটি দেশ সৃষ্টি করার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন- ওই সংগঠনটিরও অবক্ষয় শুরু হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ও বিএনপি জোটের উভয়ের নির্বাচনী রাজনীতির শুরুটা খুবই চমৎকার ছিলো । বিএনপি ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নির্বাচনী জোট গড়ে। সে সময় বিএনপি নেতা ইকবাল মাহমুদ টুকুকে ব্যক্তিগত পরিবেশে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভাই, আপনারা একাই নির্বাচনে লড়ার জন্যে যথেষ্ট ছিলেন। সেখানে ড.কামাল হোসেনের মতো একজন ভীরু মানুষের নেতৃত্বে কেন নির্বাচনী জোট গড়তে গেলেন? তিনি যা উত্তর দেন, তার বিপরীতে অন্য কোন যুক্তি দেখাতে পারিনি। তিনি বলেন, দেখো, আমাদের দলটি তৈরি একজন মুক্তিযোদ্ধার, কিন্তু গত কয়েক বছরে আমাদের জোটের সঙ্গী জামায়াত ইসলামের সন্ত্রাসের কারণে বিএনপির গায়ে সরকার জঙ্গী ছাপ মেরে দিতে সমর্থ হয়েছে। এ কারণে ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট গড়া। যাতে আওয়ামী লীগ কোনমতেই এ জোটের গায়ে জঙ্গী ছাপ দিতে না পারে।
এরপরে দেখা গেলো, ড.কামাল হোসেন তার ওয়েস্টার্ন গণতান্ত্রিক চরিত্র অনুযায়ী সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখলেন এই বলে যে- তাঁর জোট নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে গোল টেবিল বৈঠক করতে চায়।
ড.কামাল হোসেনের প্রতিনিধি যখন গণভবনে এই চিঠি পৌঁছে দেন সে সময়ে সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন একটি সভায় ছিলেন। ওই সভার লাইভ তখন টেলিভিশনে দেখাচ্ছিলো, সেখানে দেখতে পাই শেখ হাসিনা তাঁর পাশে বসা মতিয়া চৌধুরির দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছেন।সাংবাদিকতার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে ধরে নেই, এতক্ষনে শেখ হাসিনা ড.কামালের ওই চিঠির খবর পেয়ে গেছেন এবং সম্ভবত সেটা নিয়েই আলোচনা করছেন। তাই ওই মিটিং শেষের খবর পেতেই মতিয়া চৌধুরিকে ফোন করে বলি, আপা, ড.কামাল হোসেনের চিঠি নিয়ে আপনাকে প্রধানমন্ত্রী কী বললেন? মতিয়া চৌধুরি একটু থমকে গিয়ে বললেন, দেখো আমাকে কোট করবে না, আর সব থেকে ভালো হয়, উনি নিজে কিছু না বলা অবধি কোন কিছু লেখা বা রিপোর্ট করানো। তাকে বলি, আপা কোন নিউজ এখনই করাবো না, আপনি অফ দ্য রেকর্ড আমাকে বলেন, তিনি তখন তার স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বলেন, সাংবাদিকদের বিশ্বাস করার কোন কারণ আছে নিউজের বিষয়ে? নিজেই সাংবাদিক ছিলাম, তাছাড়া ঘরে তো সাংবাদিক ছিলো। তখন বিনয়ের সঙ্গে বলি, আপা, বজলু ভাই ( প্রখ্যাত সাংবাদিক বজলুর রহমান) শিখিয়ে গেছেন, অফ দ্য রেকর্ড মানেই সাংবাদিকের কাছে তা অফ দ্য রেকর্ড। জেল জুলুম ও মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে সে কখনও তা প্রকাশ করবে না। মতিয়া চৌধুরি তাঁর স্বভাব সুলভ ধমকের স্বরে বললেন, রাখো ওসব কথা। বলে তিনি এবার বললেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি ওই চিঠির জবাব দেব ও তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবো।
মতিয়া চৌধুরির ওই কথা শুনে ভালো লেগেছিলো। এবং নিজে যেহেতু কিছুটা বোকা ও আবার আশাবাদী মানুষ– তাই মনে হয়েছিলো, দেশটা মনে হয় আবার সেই আগের যুগে ফিরে যাচ্ছে, যেখানে সরকারে ছিলো মুক্তিযুদ্ধের শক্তি আবার বিরোধী দলেও ছিলো জাসদ, মোজাফফর ন্যাপ, ভাসানী ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির মতো স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের শক্তি। কারণ, শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গড়া বিএনপি জোটের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। অন্যদিকে ইকবাল মাহমুদ টুকু ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন, তারা তাদের গায়ের থেকে ও জঙ্গী ও মৌলবাদী ছাপ ঝেড়ে ফেলতে চান। তাদের দল মুক্তিযোদ্ধার প্রতিষ্ঠিত তারা সেই মুক্তিযুদ্ধকেই ধারণ করে এগুতে চান।
এরপরের ইতিহাস বাংলাদেশের সকলের জানা, শেখ হাসিনার সঙ্গে ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি জোটের অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়। এমনকি সে আলোচনায় অনেকগুলো বিষয়ে দ্বিমত হলেও বিএনপি নেতা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মওদুদ আহমদ প্রমূখ শেষ পর্যন্ত একটি কথাতে আশ্বস্ত হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আপনারা আমাকে বিশ্বাস করুন, আমি বঙ্গবন্ধু’র মেয়ে। এছাড়া ড.কামালসহ অনেককে নিজ হাতে খাবার তুলে খাইয়ে শেখ হাসিনা পরিবেশকে বদলে দেন। যার ফলে শুধু বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা নয়, অনেকেই মনে করেছিলেন দেশে এবার ভালো নির্বাচন হবে।
নির্বাচনের আগের দিন সন্ধ্যা অবধি নির্বাচন সংক্রান্ত অনেকগুলো অফিসের খোঁজ খবর নিয়ে- অফিস থেকে যখন ফিরি তখনও কেন যেন ধারনা ছিলো আগামীকাল ভালো নির্বাচন হবে। বাসায় এসে ডিনার শেষ করে ডিনার টেবিলে বসে কথাবার্তা বলছি, এমন সময় পাশে রাখা মোবাইলটি বেজে ওঠে। ফোন ধরে প্রথমে তাকে চিনতে একটু কষ্ট হয়- তবে সে পরিচয় দিতেই তার ডিটেইলস মনে পড়ে যায়। নব্বই এর দশকের শেষের দিকে যে পত্রিকা অফিসে কাজ করতাম, ওই পত্রিকা অফিসে ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাঝে মাঝেই আমার সঙ্গে দেখা করতো- আরও অনেক ছাত্র ছাত্রীর মত। সে সময়ে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিলো ভিন্ন। সে মনে করতো, ইংরেজরা যেহেতু মোঘলদের কাছ থেকে ভারতবর্ষ ( তার মতে মুসলমানদের কাছ থেকে ) দখল করেছিলো তাই ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষ ত্যাগ করে গেলো তখন সমগ্র ভারতের ক্ষমতা মুসলমানদের কাছেই দেওয়া উচিত ছিলো। দিল্লির সিংহাসনের মূল দাবিদার আইনত মুসলমানরা। তার আইডিয়াটায় মনে মনে মজা পেতাম। এমনকি কখনও কখনও মজা করে বলতাম, যতদূর জানি, ইংরেজদেরও তেমন ইচ্ছা ছিলো, তবে উজবেকিস্তানে সম্রাট বাবুরের বংশধরদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি বলেই এ অবস্থা হয়। সে মজাটাকে তখনও বুঝতো না। তারপরে ২০১৬’র দিকে সে আমার ভিন্ন কর্মক্ষেত্রে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। জানায়, সে এখন তার এলাকা অর্থাত বৃহত্তর বগুড়া জেলার একটি এলাকায় লোকাল আওয়ামী লীগের খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ওই এলাকার নাম একটু বেশি পরিচিত আমার কাছে, কারণ মাহমুদুর রহমান মান্না যখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তখন তিনি ওখান থেকে নির্বাচন করেছিলেন। মাহমুদুর রহমান মান্না ও আকতারুজ্জামানের পরিচিতি স্বাধীনতা উত্তর ছাত্র রাজনীতিতে ভিন্ন। যাহোক, মূল কথায় আসি, ফোন ধরতেই সে বললো, স্যার, মাহমুদুর রহমান মান্না তো হেরে গেলেন। ঠিকমত বুঝতে না পেরে বলি, তার মানে! সে বলে, আমরা দেড় লাখ ব্যালটে নৌকা মার্কার সিল মেরে অলরেডি ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়ে ফেলেছি। তার ফোন কেটে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে অফিসে ফোন করি। অফিসের রিপোর্টাররা কনফার্ম না করতে পারলেও তারা বলে দেশের নানান প্রান্ত থেকে তারা এ ধরনের খবর পাচ্ছে।
তারপরের দিন নির্বাচনের খবর খোঁজার থেকে এই ঘটনার কারণ খোঁজার চেষ্টা করি অনেক বেশি। কেন এমনটি হলো তার কিছুটা জানতেও পারি। তবে ডকুমেন্ট ছাড়া কোন কিছু লেখা উচিত নয়। যাহোক, ওই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে নির্বাচিত হয়ে এলো আওয়ামী লীগের প্রায় সব প্রার্থী। শুধু তাই নয় নির্বাচনের চরিত্রেও যেমন পরিবর্তন দেখা গেলো তেমনি সরকারেও একই ধরনের পরিবর্তন দেখা গেলো। ২০১৮ এর নির্বাচনের পরের সরকারের অর্থমন্ত্রী ও বানিজ্যমন্ত্রী দুজনেই হলেন একটু ভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী। সাধারণত কোন দেশের অর্থমন্ত্রী, বানিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীকে করা হয় না। কারণ, তাদের নিজস্ব অনেক স্টেইক থাকে। তারা সেখানে নির্মোহ হতে পারেন না। বাংলাদেশেও পারেনি। তাই ২০১৮ থেকে শেখ হাসিনার সরকারের অনান্য উন্নয়ন ঠিক থাকলেও, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকা, জঙ্গীবাদ বিরোধীতা সবই পূর্বের মতো চললেও, ব্যাংকিং খাত ও বাজারদর এ দুটোই ক্রমেই টালমাটাল হতে থাকে।
এর পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও বেশ কয়েকটি বড় পরিবর্তন ঘটে যায়, বাংলাদেশের মাটিতে। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে পা দেবার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর মেয়ে হিসেবে বিরোধী যে কোন দলের তিনি যে আস্থায় থাকতেন, ২০১৮ এর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে তাঁর সে আস্থার জায়গাটি নড়বড়ে হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত তাঁর দলের লোক দুটো বিষয় ভুলে যায়। এক, নির্বাচন করা। দুই, কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। তারা ধরে নেয়, তাদের আর কখনও নির্বাচন করার প্রয়োজন হবে না। শেখ হাসিনা তাদের এভাবে পাস করিয়ে আনবেন। আর যেহেতু নির্বাচন করার প্রয়োজন নেই তাই অধিকাংশ এলাকার জনপ্রতিনিধি ও কেন্দ্রিয় নেতারা মূলত দলটাকে আত্মীয় স্বজন পূর্ণবাসন কেন্দ্রে পরিণত করে। যার ফলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষে আওয়ামী লীগ যেমন ডেডিকেটেড মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিয়ে তাদেরকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে- ভিন্ন গোষ্টি নিয়ে দেশ পরিচালনায় মন দেয়। ২০১৮ এর পরেও ঠিক একই অবস্থা ঘটে সারা দেশ জুড়ে, ডেডিকেটেড কর্মী ও সমর্থকরা দূরে সরে যেতে বাধ্য হয় বা তাদের ফেলে দেয়া হয়। এর বদলে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পাশে স্থান নেয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেনীর নায়িকা, গায়িকারা আর অন্যদিকে দেশ জুড়ে অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি খোলেন আত্মীয় স্বজন ও চাটুকার পূর্ণবাসন কেন্দ্র। এর পাশাপাশি, লোকাল গভর্নমেন্ট থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদের কোন আসন খালি হলে, সেখানেও ওই জনপ্রতিনিধি’র উত্তরাধিকারই মনোনীত হতে থাকে। যার ফলে নেতা কর্মীদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতেও অনেকটা নেইল ঠুকে দেয়া হয়। তাই ভবিষ্যত গবেষকরা হয়তো খুঁজে পাবেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতন ৫ আগষ্ট হলেও এর শুরুটা হয়েছিল ২০১৮ এর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে।
অন্যদিকে যে আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয় তা ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হলেও- বাস্তবে ওই সময়ে সাংবাদিক হিসেবে রাজপথে ঘুরে আন্দোলনের চরিত্র যা দেখেছি তাকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যায়।
প্রথম স্তরে আান্দোলনটি সরকারি চাকুরিতে কোটা তুলে দেবার আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়। তবে বিচার বিভাগের মাধ্যমে কোটা প্রথা বাতিল হয়ে যাবার পরে আন্দোলন থেকে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের বড় অংশ সরে যায়। তখন রাজপথে দেখেছি, বিশেষ ধরনের মোটিভেটেড কিছু ছাত্র ছাত্রী যাদের সংখ্যা মোট আন্দোলনকারীর পাঁচ ভাগ মতো হবে। আর পাঁচ ভাগকে উগ্রপন্থী মনে হয়েছে। আর দশ থেকে পণের ভাগ সাধারণ মানুষ। বাদবাকী যাদের দেখেছি তারা বিএনপি’র কর্মী ও সমর্থক। যারা ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে এই আন্দোলন করে আসছিলো। তাদের ভেতর প্রায় ৫০ থেকে ষাট হাজার কর্মী মূলত এলাকায় সরকারি দলের নির্যাতনসহ নানান কিছু এড়ানোর জন্যে দীর্ঘদিন নানাভাবে ঢাকায় থাকতো।
তাই আন্দোলনের শেষের দিকে মূলত আন্দোলনের মূলশক্তি ছিলো বিএনপি। কিন্তু ৩ আগষ্ট থেকে যখন বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে শেখ হাসিনার সরকার একটি সুক্ষ্ম সুতোর ওপর দাঁড়িয়ে গেছে- সে সময় থেকে বিএনপিকে কেন যেন অনেক বেশি অগোছালো মনে হতে থাকে। যেখানে আন্দোলনের নেতৃত্ব তাদের হাতে তুলে নেবার কথা সেখানে তারা ধীরে ধীরে মেটিকুলাস ডিজাইনারদের ফাঁদে পা দিতে থাকে। তারা তাদের ফাঁদে পা দিয়ে পুলিশহত্যা, দেশের স্থাপনা, শিল্প কারখানা ধ্বংসের কাজের অংশ হতে থাকে। তারা ভুলে যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের যদি পতন ঘটে তাহলে স্বাভাবিকই এ দেশের বৃহত অংশ জনগনের প্রতিনিধি তারা। এবং কোটা প্রথা বাতিল হয়ে যাবার পরে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের আন্দোলন বিএনপির কর্মীরা যেমন দলকে ক্ষমতায় নেবার জন্যে আন্দোলন করছে।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষের যে অংশ ওই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলো তাদেরও মূল চাহিদা ছিলো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন- যেমনটি হয়েছিলো ১৯৯০ এর পরে ১৯৯১ এ বা ১৯৯৬ ও ২০০৮ এ। আর সাধারন মানুষের ওই অংশ রাস্তায় এসেছিলো অর্থনৈতিক সেক্টরের অনিয়ম ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া, ডলারের অপ্রতুলতার কারণে ব্যবসা বানিজ্য সংকটে পড়া। আবার ডলার ও রিজার্ভ ধরে রাখতে গিয়ে মধ্যবিত্তের প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানী বন্ধ করে দেয়ায় সেগুলোর দাম বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির এই বিষয়গুলো উপলব্দি করে তাদের তখনই আন্দোলনের মূল স্টিয়ারিং- এ বসে যাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু তার বদলে দেখা গেলো বিএনপি কর্মীরা অনেকে জায়গায় মেটিকুলাস ডিজাইনের আরবান গেরিলা ওয়ার ফেয়ারের মতই পুলিশ হত্যা, শিল্প ধ্বংস ও স্থাপনা ধংস’র যে কাজটি শুরু হলো তাদের খপ্পরে পড়ে যায়। বিএনপি মাস- পিপলসের পার্টি আর মেটিকুলাস ডিজাইনে যারা ক্ষমতা দখল করে তাদের চরিত্র ভিন্ন। বিএনপি ওদের সঙ্গে নিজেকে পার্থক্য করে নিজের শক্তি বুঝতে এখানে সঠিকভাবে সমর্থ হয়েছিলো তা বলা যাবে না। কারণ, বিএনপি মাস-পিপলসের পার্টি- তাদের ক্ষমতায় আসার একমাত্র পথ নির্বাচন। আর ক্ষমতায় এসে তাদেরকে দেশ পূর্ববর্তী গভর্নমেন্টের থেকে ভালো চালাতে হবে- নিজেদের ভবিষ্যতের জন্যে। তাছাড়া পাঁচ বার ক্ষমতায় থাকা এ দলটি নিঃসন্দেহে জানে, রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা থাকে তাদের প্রধান দ্বায়িত্ব দেশের অভ্যন্তরীন স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। তা নাহলে শুধু মানুষের জীবনযাত্রা ভীতিকর পরিবেশে পড়ে না- দেশের অর্থনীতিও স্থবির হয়ে যায়। বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। আর এই স্থিতিশীলতার জন্যে প্রথমেই প্রয়োজন পড়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। একারণে বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দল কখনই সেই বাহিনীর সদস্যদের হত্যার অংশ হওয়া উচিত না। তাছাড়া তারা যেহেতু পাঁচ বার ক্ষমতায় ছিলো- তারা জানে, প্রশাসন একটি মেশিন। যে যখন কমান্ড করবে তার কাজই করবে প্রশাসন। তাই ওই মেশিনের কোন পার্টস ভেঙ্গে ফেলা মানেই দেশের একটি পার্টস ভেঙ্গে ফেলা।
কিন্তু তিন থেকে পাঁচ আগস্ট শুধু নয় তারপরেও সরকার গঠনের আগ অবধি বিএনপির যে নেতৃত্ব স্থানীয় অবস্থানে থাকার কথা ছিলো- সেই অবস্থানটি বিএনপি সঠিকভাবে কেন যেন ধরতে পারলো না? এমনকি পরে এসেও বিএনপি সজাগ হলো না যে, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবজ্ঞা করে তথাকথিত প্রাইভেট বাহিনী দেশের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে- এমন একটা ভয়াবহ বিষয় সম্পর্কেও। দেশে প্রকাশ্যে থাকা এ মুহূর্তে সব থেকে বড় দলটির এ বিষয়টি দেশের স্বার্থে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া একটি স্বাভাবিক দ্বায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
এরপরে দেখা যাচ্ছে ওই সকল প্রাইভেট বাহিনীর লোকেরা যে মূহূর্তে সেনাপ্রধান বা সেনাবাহিনীকে হুমকি দিচ্ছে সে সময়েও বিএনপি অনেকটা নীরব। অথচ এ সময়ে বিএনপির কাছ থেকে সঠিক সিদ্ধান্তটি আশা করে মানুষ। কারণ, তাদের নেতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরিচিত হলেও দেশের মধ্যবিত্ত’র কাছে গ্রহণযোগ্য হন মূলত দেশের সেনাবাহিনীর মর্যাদা রক্ষার কারণে। অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে যে সময়ে সেনাবাহিনীর নিচের দিকের একটি অংশকে ভুল বুঝিয়ে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকে কমান্ডের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়- এমনকি দেশের রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকে অবসরপ্রাপ্তদের দ্বারা ভুল বুঝিয়ে, ভিন্ন খাতেও নিয়ে যাওয়া হয়; যা ছিলো মূলত দেশের সর্বশেষ সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠানটি নষ্ট করার দিকে নিয়ে যাওয়া । এ সমেয়ে জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র ক্ষমতা নেবার থেকেও অনেক বড় কাজ ছিলো দেশের সেনাবাহিনীতে চেইন অফ কমান্ড ফেরানো। এবং সেনাবাহিনীর ওপর যেন কোন উগ্রবাদী আঘাত না আসে সেটা রক্ষা করা।
তাই এবার যখন সেনাবাহিনীকে বির্তকিত করা হচ্ছে, সেনাবাহিনীকে প্রাইভেট বাহিনীর লোকেরা চ্যালেঞ্জ করছে- সে সময়ে বিএনপির নির্লিপ্ততা ঠিক তাদের নেতার আদর্শের সঙ্গে শতভাগ যায় না।
সর্বোপরি, বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দল, যারা পাঁচ বার এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলো তাদেরকে কোন মতেই বলার প্রশ্ন আসে না, তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল দেশগুলোর স্থিতিশীলতা রক্ষার শেষ আশ্রয়স্থল সেনাবাহিনী। কারণ, এ ধরনের দেশগুলোতে সেনাবাহিনীই থাকে রাষ্ট্রের সব থেকে সুশৃঙ্খলিত অংশ। তাই দেশ ও দেশের ভবিষ্যত রাজনীতির স্বার্থে সেনাবাহিনী এ ধরনের দেশে ভিন্ন মাত্রার গুরুত্ব বহন করে। এবং বাংলাদেশকে এটাও মনে রাখতে হবে, এ দেশের রাজনৈতিক শূন্যতা পূরনে গত ৫৫ বছরে সেনাবাহিনীর ও সেনাশাসনের ভূমিকা কম নয়।
দেশের অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিএনপির মতো বড় দল সঠিকভাবে না ধরতে পেরে অনেক ভুল করে ফেলেছে। তবুও কোন কিছুই শেষ হয়ে গেছে- এমনটি যেমন ভাবার সুযোগ নেই তেমনি বিএনপিও নিজের পায়ের ওপর দাঁড়ানোকে গুরুত্ব দেবে, অপরের উচ্ছিষ্ট তাদের জন্যে বড় নয় বা অপরের পায়ের ওপর দাঁড়ানো নয়- এটা তারা আমাদের মতো ক্ষুদ্র সাংবাদিকদের থেকে অনেক ভালো জানবেন।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ, ও The Present World.
Leave a Reply