স্বদেশ রায়
তখনও আমাদের প্রকৃত অর্থে বাড়ি ছিলো। আমিও ছোট ছিলাম। পাকিস্তান হলেও তখনও স্টিমার বন্ধ হয়নি। তাই সে বাড়িতে সকলে আসার একটা আমেজ মাঝে মাঝে মনে আসে। মাঝে মাঝে ওই স্মৃতির সঙ্গে শিল্পীর হাতের রঙ মেলানোর জন্যে শিল্পী পরিতোষ সেনের সেই পূজোয় বাড়ি ফেরার স্মৃতি পড়ি বার বার।
ওই সময়ে বাড়ির দুর্গা পূজোটি ছিলো বসন্তকালীন দুর্গা পূজো বা বাসন্তী পূজো । এই পূজোর প্রায় দুই সপ্তাহ আগে থেকে বাড়িতে আত্মীয় স্বজনে ভরে যেতো। কেউ আসতো স্টিমারে, কেউ লঞ্চে আবার কেউ গহনা নৌকা, কেউবা নিজেদের বজরা বা পানসি নৌকায় । তখন ছোটদের দিন ও রাত এক হয়ে যেতো। বসন্তকাল, শীতও নয়, গরমও নয়। কেবল দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস এসে সারা বাড়ি ভরে দিতো। বড় পুকুর পাড়ের সাত রঙের জবাগুলোর পাপড়ি অবধি নড়ে উঠতো ওই বাতাসে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা, হলুদ, শাদা ও রক্ত করবীগুলো চাঁদের আলোতেও যেন দেখা যেতো।
আজ সেই রক্ত করবীগুলোর কথা মনে হলে- মনে হয়, তখন যদি রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী পড়া থাকতো – তাহলে মনে মনে ভাবতে পারতাম, নন্দীনি তোকে দেবার জন্য এই রক্তকরবীটি থাক, আমার একান্ত গোপন, আমার একার। যাহোক, যখন রক্তকরবী পড়লাম, তখন কিশোর হলেও হাতে গোলাপ। রক্তকরবী পড়ে গেছে অনেক পিছে। পুকুর পাড়ের সেই ক্যালকাটা রেলিংও উঠে গেছে। এটাই মনে হয় নিয়তি। ভাগ্যবাদে বিশ্বাসী না হলেও এটা তো বুঝি- সময় যদি পথ রোধ করে দাঁড়ায়, তখন নিজের হাতও ছুরিতে না হলেও গোলাপের কাঁটায় রক্তাক্ত হয়।
ওই পনেরো দিনে প্রতি মুহূর্তে বাসন্তী দেবী বা বসন্তের দুর্গা এগতে থাকতো বড় জ্যাঠামহাশয়ের পূজো মণ্ডপে । জ্যাঠামহাশয়কে তাঁর এক তলার বারন্দা থেকে আরাম কেদারাটা এনে মন্ডপের সামনে ছোট ছাদনিতে বসার ব্যবস্থা করা হতো। তিনি সেখানে বসে প্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়া দেখতেন। আমিও তার আরাম কেদারা ছুঁয়ে বসে দেখতাম এক দলা কালো মাটি কীভাবে ভাস্করের আঙুলের চাপে মুহূর্তে একটি শুলো ইঁদুর হয়ে যায়। ততদিনে অবন ঠাকুর প্রায় পড়া শেষ। তাই হৃদয়ের সেই শুলো ইঁদুর থেকে খোঁড়া হাঁস সবই পরিচিত।
পূজোর একদিন আগে যখন বাসন্তী দেবী অপরূপা হয়ে উঠতেন, সেখানে তার তেজের থেকে বেশী সৌন্দর্য থাকতো। তখন বিস্ময়ে চেয়ে থাকতাম। আর এখন মনে পড়লে ভাবি, ভাস্কর কীভাবে খড় কুটো আর কাদা মাটিকে এমন পরিপূর্ণ সুন্দরতম প্রতিমায় পরিণত করতেন। এখনও সে প্রতিমা মনে পড়লে মনে হয়, ওই দেবী কোন যুদ্ধের দেবী নয়, ওই দেবী গড়ার ও সৃষ্টির দেবী। তার হাতে ত্রিশুল আছে ঠিকই, তবে তিনি লাস্যময়ী। তিনি মাতৃরূপী, ভগ্নিরূপী, কন্যারূপী।
এই বাসন্তী পূজোর পরে বাড়িতে দ্বিতীয় উৎসব ছিলো হেমন্তের রক্ষাকালী পূজো। এ পুজো হতো ন’ জ্যাঠামহাশয়ের মণ্ডপে । সেখানেও প্রায় একমাস না হলেও পনেরো থেকে বিশ দিন আগে ভাস্কর আসতেন। প্রথমে দেবীর দেহ গড়া হতো। তার পরে মুখাকৃতি। পূজোর একদিন আগে যখন শেষ রঙ তুলির টান পড়তো। তখন ভয়ে তার দিকে তাকাতে পারতাম না। তার চোখ দুটো ভয়ংকর। মুখে ও দাঁতে রক্ত লাগানো। হাতে খড়গ-কৃপান, গলায় নরমুণ্ডের মালা।
ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম সে মূর্তি দেখে খুব ছোটবেলা থেকেই। আবার অদ্ভুতভাবে দেখতাম বাসন্তী পূজো ঘিরে থাকতো কেবলই আনন্দ আর এই ভয়ংকর কালী মূর্তিকে ঘিরে যেন থাকতো এক গলবস্ত্র প্রার্থনা। সবার সকল মুশকিল আসান, সকল বিপদ থেকে মুক্তির জন্যে তার কাছে আহ্বান । যেন তিনি নিজে এসে সকল বিপদ মুক্ত করে দেবেন। এবং কেবল তিনিই পারেন এই বিপদ মুক্ত করতে।
কেন তার কাছে সকলে গলবস্ত্র হতো তা ঠিক বুঝতাম না ওই বয়সে। বরং ভয় পেতাম ওই মূর্তি দেখে। তবে ভয়ের থেকেও বেশি অবাক হয়ে গেলাম যখন জানলাম বসন্তের বা শরতের দুর্গা আর হেমন্তের এই ভয়ংকররূপী কালী একই।
কেমন করে বসন্তের ওই স্নিগ্ধা ও হেমন্তের ওই ভয়ংকরী একই হয়! এবং স্নিগ্ধার থেকে ভয়ংকরীর কাছে সকলের কেন বেশি প্রার্থনা!
“ আমার মা সব জানেন ঠিকই” – তারপরে মা ছিলেন রাশভারী। তাছাড়া মা, বাবামহাশয় ও জ্যাঠাইমা, জ্যাঠামহাশয়দের বাইরে যে নির্ভরতার স্থানটি থাকে দাদাঠাকুর ওই দাদাঠাকুর আমার জন্মের অনেক আগেই পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। আমরা কেবল সেই বিদ্রোহী মানুষটির গল্প শুনেছি। তবে দাদাঠাকুর মহাশয়ের এই স্থানটি পূরণ করেছিলেন, কুলপুরোহিত দাদাঠাকুর মহাশয়। তিনি তার সকল স্নেহ দিয়ে আমাকে আগলে রাখতেন। এখন বুঝি তার জ্ঞানের ভাণ্ডার ছিলো অপরিসীম। আমার অক্ষমতার কারণে তাঁর কাছ থেকে কিছুই নিতে পারিনি। তাঁর কোলের ভেতর গিয়ে একদিন কালীপূজোর আগে জিজ্ঞেস করি, কালী মা দুর্গা হলেও কেন এমন ভয়ংকরূপ।
তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ভয়ংকর নয়, এটাও পৃথিবীর আরেকটি সৌন্দর্য। পৃথিবী যখন দানব কবলিত হয়। মানবাত্মা যখন অসহায় হয়ে পড়ে। তখন তাকে পরাজিত করতে হলে নিজেকেও হতে হয় তার থেকে আরও বেশি ভয়ংকর। তাই শরতের বা বসন্তের দেবী যখন পৃথিবীতে অন্ধকার নামে তখন এমনি রুদ্ররূপিণী ভয়ংকর মা কালী হন। আর দেখনা যে কারণে এই পূজো হয় ঘোর অমাবস্যায়। অর্থাৎ পৃথিবীকে যখন নিকষ কালো অন্ধকারে বা অন্ধত্বে ঢেকে দেবার চেষ্টা হয় তখনই দেবীকে এমনিই ভয়ংকর রূপ নিতে হয়। আরেকটু বড় হও, তখন বুঝতে পারবে পৃথিবীতে স্নিগ্ধার মাঝে ও ভয়ংকরের মাঝে একই সৌন্দর্য । পৃথিবীতে দানবীয় শক্তি, মূঢ় অন্ধ শক্তি দূর না করতে পারলে কখনও সুন্দর ও স্নিগ্ধ পরিবেশ আসে না। তাই মানুষের প্রয়োজনেই মানুষের ত্রাতাকে ভয়ংকর হতে হয়। এজন্য কখনও কোন স্নিগ্ধও কল্যাণকর মূর্তিকে ভয়ংকর রূপে দেখলে বুঝবে, তাকে আসতে হবে দানব কবলিত অসহায় মানুষের মুক্তির জন্যে এই ভয়ংকর রূপ নিয়েই। হয়তো এর পরে দাদাঠাকুর মহাশয় আরো কিছু বলেছিলেন, তবে তার সবটুকু আর শোনা হয়নি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তার কোলে। মানুষের ঘুম এমনিভাবে মানুষকে অনেক কিছুই শেষ অবধি জানতে বা বুঝতে দেয় না। আর কালঘুম হলে তো কালনাগ মানুষের শরীরে বিষ ঢেলে দেবার সুযোগ পায়।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply