মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ১১:২২ অপরাহ্ন

বাংলাদেশ-পাকিস্তান গভীর সম্পর্ক: লাভ-ক্ষতির হিসাব

  • Update Time : শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫, ৩.৩৭ পিএম

স্বদেশ রায়

এ মুহূর্তে বলা হচ্ছে পনের বছর পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক আবার শুরু হচ্ছে। বাস্তবতা তা বলে না। গত পনের বছরে যেমন বাংলাদেশ-ভারত আম কূটনীতি ছিল তেমনি বাংলাদেশ-পাকিস্তান আম কূটনীতিও ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগের দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাঁকে ফোন করতেন। আবার স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন উৎসবের প্রধান অতিথি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য শেষ হলেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছাবাণী ভার্চুয়ালি শোনানো হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের শুভেচ্ছাবাণী পরে শোনায়

তারপরও বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে পনেরো বছরের ফ্রিজড সম্পর্ক এবার নতুন মাত্রায় নেওয়া হচ্ছে। প্রথম মুল্যায়ন পাওয়া গেল এই মাসেপাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আসার আগে ১৮ এপ্রিলের বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে সমুদ্রপথ ও আকাশপথের কানেকটিভিটি (স্থলপথে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কোনো সুযোগ নেই) এবং স্ট্র্যাটেজিক অংশীদারিত্ব। সমুদ্রপথের কানেকটিভিটি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছেসে পথে আসা পণ্যগুলোর ফিজিক্যাল সার্চ পদ্ধতিও বাতিল করা হয়েছে। আকাশপথে যেটা আসবে সেখানে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। আর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপের পরিধি অনেক বিস্তৃত।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশের এই সম্পর্ক উন্নয়ন দক্ষিণ এশিয়ায় এবং আরও বিস্তৃতভাবে পৃথিবীতে কী প্রভাব ফেলতে পারেদক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে বড় ল্যান্ড বর্ডার ভারতেরযা পৃথিবীর পঞ্চম দীর্ঘতমদৈর্ঘ্য ৪০৯৬ কিলোমিটার। অন্যদিকেবাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৩.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারযার মধ্যে বাংলাদেশ রফতানি করে ২.১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ রফতানি পণ্য নেবার ক্ষেত্রে আমেরিকা শীর্ষে,  যার পরিমান ৯৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের অবস্থান সপ্তম। এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভারতেই সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ।

বর্তমান এই ইন্টারিম সরকার আসার আগে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল ভারতের। তবে এ মুহূর্তে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এতটাই শীতলবাংলাদেশের ৫৫ বছর ইতিহাসে কখনো এমনটি ছিল না। ইন্টারিম ব্যবস্থাপনা দায়িত্ব নেওয়ার আগে ও পরে ভারতে নিরাপত্তা ও সীমানা নিয়ে দ্বায়িত্বশীলদের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য এবং সামাজিক মিডিয়ায় পোস্ট দেখা গেছে। বিপরীতেভারতের উচ্চ পর্যায়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুবিশেষ করে হিন্দুবৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়েরনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এ ইস্যুতে মতের স্পষ্ট পার্থক্য এখনও চলছে

তবুও নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী ইন্টারিম এর পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের জন্য মুহাম্মদ ইউনূসের ভারত সফরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বার বার। পরে বিষয়টি এ পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়া যে, এ মুহূর্তে কোনো দ্বিপাক্ষিক আনুষ্ঠানিক বৈঠক নয়এটি পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সঙ্গেই হবে। সে সময়ে আসন্ন BIMSTEC সম্মেলনে একটা সাইডলাইন মিটিং এর সিদ্ধান্ত হয়েছিলো বলে জানা যায়কিন্তু BIMSTEC সম্মেলনের দুই দিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সাইডলাইন ও দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের তালিকা থেকে বাংলাদেশ বাদ পড়ে যায়। ভারতের কূটনীতিক ও রাজনীতিক মহলের তথ্য অনুযায়ীবাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা চীনে বেসরকারি ব্যবসায়িক নেতাদের ফোরামে যোগদানকালীন ভারতের কয়েকটি রাজ্য ও আঞ্চলিক সমুদ্র নিয়ে মন্তব্য করায় অমনটি ঘটেছিলো। যাহোকবাংলাদেশ সেটা জানার পরও থেমে না থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে শেষ মুহূর্তে সাইডলাইন বৈঠকে বসতে সমর্থ হয়

বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে দুই দেশের ব্রিফিং ছিল দুইরকম। ভারতের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র সচিবের মতো সিনিয়র কূটনীতিক প্রেসকে ব্রিফ করলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সাংবাদিকতা থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রেস সচিব (কূটনীতিক নন) এর মাধ্যমে ব্রিফ এসেছিল। ওই ব্রিফিং ও তার সামাজিক মিডিয়া পোস্টের ভিত্তিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের অবস্থান প্রকাশে বাধ্য হয়েছিল। মিটিং প্রসঙ্গে সংবাদপত্র প্রথম আলো” ‘র মতামত কলামে বলা হয়েছেওই বৈঠকের পরও ভারতবাংলাদেশ সম্পর্কের বরফ গলেনি।

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী দেশটি বিশ্ব অর্থনীতিতে পঞ্চম। এ মুহূর্তে মোট অর্থনীতির পরিমান ৪.২৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর বিপরীতেপাকিস্তানের অবস্থান ৪৪তম এবং পরিমান মাত্র ৩৭৪.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ অর্থ বছরে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ২.৬ শতাংশ হতে পারে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান যাই হোক না কেনবিশ্বে তার পরিচিতি সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসের কারণে। South Asian Terrorism Portal (SATP) অনুযায়ী পাকিস্তানে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে ৮০টিসক্রিয় সন্ত্রাসী সংগঠন ৪৫টি।

এই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উষ্ণ পর্যায়ে যেতে শুরু করার সময়ে নিউইয়র্ক টাইমসদি গার্ডিয়ানসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তথ্য-প্রমাণসহ বারবার প্রকাশিত হয়েছেবাংলাদেশে রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে এবং শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থার অভাবে টেরোরিস্ট গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছেআগে এরকম প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। পাকিস্তানের মতোই এখানে হরকাতুল জিহাদহিজবুত আল তাহরির মতো গোষ্ঠী সক্রিয়। তারা শাসন ব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে মিছিল ও প্রচার চালাচ্ছে। এ অবস্থায়পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে বাধাহীন সমুদ্র কানেক্টিভিটি এবং আসন্ন আরও বেশি এয়ার কানেক্টিভিটিদীর্ঘ ল্যান্ড বর্ডারের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হবে না কি ক্ষতিগ্রস্থ করবেএ প্রশ্ন উঠে। কারণআন্তর্জাতিক ফোরামে ভারত সবসময় পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে এবং তাদের অবস্থানও সেটাই। অন্যদিকেআন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিদদের বইয়ে দেখা যায়চীনের উইঘুর মুসলিমরাও পাকিস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে প্রশিক্ষণ নেয়। সুইডেন ও বোম্বের সন্ত্রাসী হামলাকারীদের কয়েকজন কীভাবে পাকিস্তানের গোষ্ঠীতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলতাও সেখানে বলা হয়েছে

চীনও যে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সন্ত্রাস নিয়ে উদ্বিগ্নতার প্রমাণ স্পষ্ট। কারণচীন পাকিস্তানে  গোয়েধার ডীপ সি পোর্ট করলেও তা নিজেদের নিরাপত্তা সংস্থার অধীনে রেখেছে। পাশাপাশি, সামান্য বিশ্লেষণ করলেই চীনের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যায়গত পনের বছরে চীন যেভাবে বাংলাদেশের অবকাঠামো গড়ে তুলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতা করেছেএমনটিই কখনো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে করে না। কারণচীন পাকিস্তানকে একটি স্ট্র্যাটেজিক এলাকা হিসেবে ধরে রাখতে চায়অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগী হতে চায় নাএর মূল কারণ টেরোরিজম। চীন নিজ দেশে ও দেশের বাইরে টেরোরিজমবিরোধী বিষয়ে অত্যন্ত কৌশলীযদিও ভারতআমেরিকা বা ইউরোপের মতো প্রকাশ্যে সরব নয়।

এছাড়াওস্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টা আসে। বহু বছর আগের ধারণা অনুযায়ী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি অঞ্চলে বাংলাদেশের সঙ্গে ২২ কিলোমিটার চওড়া একটি করিডোর রয়েছেযা ভারতের সামরিক নিরাপত্তার একটি স্ট্র্যাটেজিক এলাকাযেমনটা পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার ৬৫ কিলোমিটার চওড়া সুয়েটি গ্যাপ। ইউরোপ ভেবেছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এই গ্যাপ নিরাপত্তাকে ভলনারেবল করবেকিন্তু বাস্তবে যুদ্ধে সি রুট ও সি স্ট্র্যাটেজিকাল পয়েন্টই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ওই গ্যাপ রাশিয়া কাজে লাগায়নি

সর্বপরিএ মুহূর্তে পৃথিবী প্রবেশ করেছে অর্থনৈতিক বিশ্বযুদ্ধেযার অন্যতম শক্তি চীন। চীনের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে এশিয়াতে ভারতই অন্যতম সহযোগীআবার এশিয়ায় চীনের অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে আমেরিকার সহযোগীও ভারত। এছাড়াওবর্তমান প্রযুক্তির এই পৃথিবীতে অর্থনৈতিক যুদ্ধকে এগিয়ে নেবার কাজে সামরিক যুদ্ধ অতীতের ধারণা হয়ে গেছে।

বরং ভারতের মতো চায়না ও আমেরিকা উদ্বিগ্ন হতে পারে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের কানেক্টিভিটি ও স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কের ফলে বাংলাদেশে সন্ত্রাস আরও বাড়বে কি নাএ বিষয়ে। কারণএই ধরনের সন্ত্রাস পৃথিবীর সব দেশেরই অভ্যন্তরীন নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর।

এ কারণে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণতায় গেলে অবশ্যই তার বৃহৎ প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক শক্তিশালী দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

ইতোমধ্যে ভারত ও বাংলাদেশ ছোটখাটো অর্থনৈতিক বিষয়ে টিট-ফর-ট্যাট অবস্থায় চলে গেছেভারত বাংলাদেশের ল্যান্ড শিপমেন্ট বন্ধ করেছেবাংলাদেশও ভারত থেকে ল্যান্ড বর্ডার দিয়ে সূতা আমদানিসহ কিছু পণ্য আমদানিও বন্ধ করেছে। ট্রেড ওয়ার শেষ পর্যন্ত কতদূর যাবেকেউ বলতে পারে না। বাংলাদেশকে খেয়াল রাখতে হবে এই ট্রেড-ওয়াকালে টেরোরিস্ট তকমা গায়ে না লাগে,  তকমা ট্রেড ওয়ারে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ হয়।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024