আর্কাদি গাইদার
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
অবাক হয়ে আমি ভাস্কার দিকে তাকিয়ে ছিলুম। ওর বোকাটে লাল মুখখানা আর আনাড়ির মতো নড়াচড়ার ভঙ্গি দেখে কে বলবে যে তার আগের দিনই শ্বেতরক্ষীদের গতিবিধির সন্ধান করার সময় ও অমন চট্টপটে ভাব দেখিয়েছিল আর ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বন্দী সৈন্যটাকে বেধে নেয়া সত্ত্বেও সজোরে চাবুক কষিয়ে অত জোরে বেয়াড়া ঘোড়া ছুটিয়েছিল।
লাল ফৌজের লোকজন ততক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সকালের খাওয়া সেরে, টিউনিকগুলো পরে নিয়ে বোতাম লাগিয়ে, পায়ে পটি জড়িয়ে রওনা হবার জন্যে প্রস্তুত হল বাহিনী।
আগেই তৈরি হয়ে নিয়েছিলুম। অন্যদের জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল বলে আমি জঙ্গলটার একটা প্রান্তে গিয়ে ফুটন্ত পাখি-চেরিফুল দেখতে লাগলুম।
পেছনে পায়ের শব্দে এক সময় আমার মনোযোগ আকর্ষিত হল। ফিরে দেখলুম, সামনে-সামনে বন্দী গাইদামাক আসছে আর পেছনে আসছে আমাদের বাহিনীর তিনজন লোক আর তাদের সঙ্গে চুবুক।
‘ওরা কোথায় চলেছে কে জানে?’ আলুথালু, চুল, বিষন্ন মুখ বন্দীর দিকে তাকিয়ে আমি ভাবলুম।
‘দাঁড়াও!’ চুবুক হুকুম করলেন। ওরা সকলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
একবার শ্বেতরক্ষীর দিকে আরেকবার চুবুকের দিকে তাকিয়ে এবার আমি বুঝতে পারলুম বন্দীকে ওখানে কেন এনেছে ওরা। জোর করে মাটি থেকে যেন পা দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে পেছন ফিরে খানিকটা দৌড়ে গিয়ে একটা বার্চ’গাছের গুড়ি প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে পড়লুম।
তারপরই পেছন থেকে সংক্ষিপ্ত একঝাঁক গুলির আওয়াজ কানে এল।
‘বুইলে খোকা,’ আমার সঙ্গে দেখা হতে গম্ভীরভাবে বললেন চুবুক। ওঁর গলায় যেন একটা ক্ষীণ অনুতাপের সুর, ‘যদি ভেবে থাক লড়াইটে এটা খেলাকথা, আর নয়তো সোন্দর-সোন্দর জায়গায় ঘুরি বেড়ানো, তাইলে তোমার ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত। শ্বেতরক্ষী হচ্ছে শ্বেতরক্ষী, আমাদের আর ওদের মধ্যি মাঝামাঝি বলে কিছু নেই। ওরা আমাদের গুলি করি মারে, কাজেই আমরা ওদের ছেড়ে দিতি পারি না!’
লাল লাল চোখ মেলে ওঁর দিকে তাকালুম আমি। তারপর শান্ত কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বললুম:
‘আমি বাড়ি ফিরে যাব না, চুবুক। আসলে, ব্যাপারটার কথা আগে ভাবি নি কিনা, তাই, কিন্তু আমি লাল ফৌজেরই লোক, আমি নিজে লড়াই করতেই এসেছি…’ হঠাৎ থেমে গিয়ে একটু ইতস্তত করে তারপর যেন কিছুটা কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে আস্তে-আস্তে বললুম, ‘সমাজতন্ত্রের সমুজ্জল রাজত্বের জন্যে লড়াই করতে এসেছি।’