মালিহা লোধি
গত ২৫ বছরে এটি ভারত‑পাকিস্তান সম্পর্কের পঞ্চম বড় সংকট।
প্রতিটি সংকটই ক্রমে জটিল হয়েছে এবং ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছে, ফলে উত্তেজনা কমলেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বরাবরই কঠিন হয়েছে। এসব সংকটের পর দীর্ঘ সময় কূটনৈতিক যোগাযোগ বন্ধ থাকে; আনুষ্ঠানিক সংলাপ স্থগিত হলে তা পুনরায় শুরু করাও দুরূহ হয়ে পড়ে। একসময়ের সম্ভাবনাময় ‘সমন্বিত সংলাপ’ প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার পর গত ১২ বছরে আর চালুই করা যায়নি।
চলমান সংকট ইতোমধ্যেই দুই পারমাণবিক প্রতিবেশীকে বিপজ্জনক মোকাবিলার চক্রে ঠেলে দিয়েছে। ভারতের সূচিত পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবার অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এগিয়ে গেছে। সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করে ভারত পানি‑প্রশাসনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে—তাৎক্ষণিক প্রভাব সীমিত হলেও এর সুদূরপ্রসারী পরিণতি রয়েছে। নিয়ন্ত্রণ রেখা জুড়ে হালকা আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি‑বিনিময় চলছে। আরব সাগরে ভারতীয় নৌবাহিনী দীর্ঘ‑পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মহড়া চালাচ্ছে; জবাবে পাকিস্তানও নৌ তৎপরতা বাড়িয়েছে।
পাকিস্তানি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, ভারতের সামরিক আঘাতের প্রস্তুতি সম্পর্কে তাঁদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য আছে। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর শাস্তির হুমকি ও “পাহেলগাম হামলার দায়ীদের সমর্থকদের” উপর আঘাতের ঘোষণায় সামরিক পদক্ষেপের আশঙ্কা আরও বেড়েছে। তিনি সেনাবাহিনীকে “কোন পদ্ধতিতে, কোথায় ও কখন” পাল্টা জবাব দেবে, সে বিষয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। ভারতে যুদ্ধোন্মাদনাও প্রবল হয়ে উঠেছে।
সামরিক সংঘর্ষের আশঙ্কা আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়িয়েছে; সবাই সংযমের আহ্বান জানাচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, ইরানসহ অনেকেই উত্তেজনা প্রশমিত করার তাগিদ দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রেরই দুই দেশের উপর প্রভাব সবচেয়ে বেশি—১৯৯৯‑এর কারগিল থেকে ২০১৯‑এর শেষ সংকট পর্যন্ত ওয়াশিংটনই প্রশমন‑ভূমিকায় ছিল। এবারও, অন্যত্র ব্যস্ত থাকার জল্পনা সত্ত্বেও, তারা দ্রুতই ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করে সংযম ও সরাসরি কথোপকথন পুনরুদ্ধারের অনুরোধ জানিয়েছে।
তবে কি পূর্ণাঙ্গ সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব?
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে ফোনে এই বার্তা শেয়ার করেন। সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজও আর্মি প্রধান জেনারেল আসিম মুনির ও ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে একই আহ্বান জানান, কয়েক দিন আগে তাঁকে পদচ্যুত করার আগ পর্যন্ত। সিআইএ পরিচালক জন র্যাটক্লিফ ও জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড ডিজি আইএসআই জেনারেল আসিম মালিককে ফোন করেন; সম্প্রতি তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে দোভালের সঙ্গে আলোচনা প্রস্তুতির ইঙ্গিত বলে ধরা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র কি ভারতের সামরিক পথ থেকে সরে আসা নিশ্চিত করতে পারবে, তা এখনো অনিশ্চিত। ভারতীয় গণমাধ্যম জানাচ্ছে, মোদি সরকার বেশ কয়েকটি বিকল্প বিবেচনা করছে, যাতে পাকিস্তানকে কষ্ট দেওয়া যায়, আবার পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধেও না জড়ায়—কারণ ইসলামাবাদের পাল্টা প্রতিক্রিয়া অনিশ্চিত। পাকিস্তান স্পষ্ট বলেছে, ভারতের যেকোনো সামরিক পদক্ষেপের জবাবে “কঠোর ও সঠিক” প্রত্যুত্তর দেওয়া হবে। এতে অনিয়ন্ত্রিত উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়বে। সরাসরি যোগাযোগ না থাকায় ভুল হিসাব ও অনিচ্ছাকৃত উত্তেজনা‑বৃদ্ধির সম্ভাবনাও বেশি। মধ্যস্থতাকারী যুক্তরাষ্ট্র বার্তা পৌঁছালেও সে ঝুঁকি পুরোপুরি কাটবে না।
অতীত কখনোই হুবহু পথনির্দেশ নয়, তবু স্মরণ করলে হয়তো কিছু শিক্ষা মিলবে। ২০১৯‑এর ফেব্রুয়ারি সংকটের সূচনা হয়েছিল অধিকৃত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় হামলায় ৪০ জন ভারতীয় নিরাপত্তা সদস্য নিহত হওয়ার পর। পাকিস্তানকে দোষারোপ করে ভারত শক্ত জবাবের হুঁশিয়ারি দেয়। ১২ দিন পরে ভারতীয় মিরাজ জেট নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে বালাকোটে বোমা ফেলে ‘সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবির ধ্বংস’ ও জঙ্গি হত্যার দাবি তোলে। পাকিস্তান পরে দেখায়, হামলার জায়গাটি বন‑জঙ্গল ছাড়া আর কিছু নয়, ক্ষয়ক্ষতিও হয়নি। জবাবে পাকিস্তান ‘সুইফট রিটার্ট’ চালিয়ে জম্মুর একটি সামরিক লক্ষ্যে বিমান আঘাত হানে; তাতেও তেমন ক্ষতি হয়নি।
তবে আকাশযুদ্ধে একটি ভারতীয় মিগ‑২১ ভূপাতিত হয় এবং পাইলট আটক হন। তাঁকে মুক্তি দেওয়াই উত্তেজনা প্রশমনের মোড় বদলে দেয়। সর্বোচ্চ টানাপোড়েনের সময় পাকিস্তান নিশ্চিত হয়, ভারত হামলার প্রস্তুতিতে নয়টি ক্ষেপণাস্ত্র তাক করে রেখেছে। বিদেশসচিব বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় শক্তিগুলোর কূটনীতিকদের জানিয়ে স্পষ্ট করেন, প্রতিটি ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রের জবাবে পাকিস্তানের তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত থাকবে। ফলে ভারতকে থামাতে হত। যুক্তরাষ্ট্র তখন কর্মপর্যায়ের আলাপে থাকলেও পরে উচ্চপর্যায়ে সক্রিয় হয়। মাইক পম্পেওর স্মৃতিচারণ ‘নেভার গিভ অ্যান ইঞ্চ’‑এ বলা হয়, উভয় পক্ষই ধারণা করেছিল অপরটি পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের দ্বারপ্রান্তে, ফলে পারমাণবিক উত্তেজনা বাস্তব আশঙ্কা হয়ে দাঁড়ায়।
জোরালো তৃতীয়পক্ষীয় কূটনীতি ও পাকিস্তানের উত্তেজনা‑হ্রাস প্রচেষ্টা পাইলট মুক্তির সিদ্ধান্ত দ্রুত করে; সেটিই সংকট থেকে বের হওয়ার পথ দেখায়। ‘অ্যাংগার ম্যানেজমেন্ট’ বইয়ে সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার অজয় বাসারিয়া দাবি করেন, ভারতের ‘বাধ্যকারী কূটনীতি’ এ ফল দিল। পরে নির্বাচনী ভাষণে মোদি ইঙ্গিত দেন, পাইলট মুক্তি না পেলে ‘কাতাল কি রাত’ (রক্তাক্ত রাত) অপেক্ষা করছিল। পাকিস্তান অবশ্য বলেছে, তাদের “দায়িত্বশীল আচরণই” উত্তেজনা হ্রাস করেছে, একই সঙ্গে যেকোনো নিরাপত্তা হুমকির জবাব দেওয়ার সক্ষমতাও প্রমাণ করেছে।
হঠাৎ ঘটে যাওয়া কিছু অনুকূল বিষয়, সক্রিয় তৃতীয়‑পক্ষীয় হস্তক্ষেপ ও টানাপোড়েনের মাঝে একটি ‘শান্তির অঙ্গীকার’—এই সমষ্টিই সে সংকটের ইতি টেনেছিল। সৌভাগ্যও কাজ করেছিল, অনেক বিশেষজ্ঞের মতে। প্রশ্ন হলো, আজ কী এমন কোনও অনুকূল পরিস্থিতি আছে, যা চলমান উত্তেজনা থামিয়ে সরাসরি সংঘর্ষ এড়াতে পারে?
লেখক যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
প্রকাশিত: ডন, ৫ মে ২০২৫