নজরুল
প্রত্যেক ঘর হইতে পাখার শব্দ আসিত, আর মাঝে মাঝে ছারপোকা মারার শব্দ শোনা যাইত। তাছাড়া প্রত্যেক ঘরের মেয়েরা সূক্ষ্মভাবে পরদা মানিয়া চলিত, অর্থাৎ পুরুষেরাই যার যার ঘরে আসিয়া পরদায় আবদ্ধ হইত। প্রত্যেক বারান্দায় একটি করিয়া চটের আবরণী। পুরুষলোক ঘরে আসিলেই সেই আবরণী টাঙাইয়া দেওয়া হইত। দুপুরবেলা যখন পুরুষেরা অফিসের কাজে যাইত, তখন এ ঘরের ও ঘরের মেয়েরা একত্র হইয়া গালগল্প করিত, হাসি-তামাশা করিত,
কেহ-বা সিকা বুনিত, কেহ কাঁথা সেলাই করিত। তাহাদের সকলের হাতে রংবেরঙের সুতাগুলি ঘুরিয়া ঘুরিয়া নকশায় পরিণত হইত। পাশের ঘরের সুন্দর বউটি হাসিয়া হাসিয়া কখনও বিবাহের গান করিত, বিনাইয়া বিনাইয়া মধুমালার কাহিনী বলিত। মনে হইত, আল্লার আসমান হইতে বুঝি এক ঝলক কবিতা ভুল করিয়া এখানে ঝরিয়া পড়িয়াছে।
এ হেন স্থানে আমি অতিথি হইয়া আসিয়া জুটিলাম। আমার ভগ্নিপতিটি ছিলেন খাঁটি খোন্দকার বংশের। পোলাও-কোর্মা না খাইলে তাঁহার চলিত না। সুতরাং মাসের কুড়ি টাকা বেতন পাইয়া তিনি পাঁচ টাকা ঘরভাড়া দিতেন। তারপর তিন-চার দিন ভালো গোস্ত, ঘি কিনিয়া পোলাও-মাংস খাইতেন। মাসের অবশিষ্ট সময়ে কোনো দিন খাইতেন, কোনো দিন বা অনাহারেই থাকিতেন।
মাসের প্রথম দিকেই আমি আসিয়াছিলাম। চার-পাঁচ দিন পরে যখন পোলাও-গোস্ত খাওয়ার পর্ব শেষ হইল, আমার বোন অতি আদরের সঙ্গে আমার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, “সোনাভাই, আমাদের সংসারের খবর তো তুই জানিস না। এখন থেকে আমরা কোনোদিন আধপেটা খাব, কোনোদিন বা অনাহারে থাকব। আমাদের সঙ্গে থেকে তুই এত কষ্ট করবি কেন? তুই বাড়ি যা।”
আমি যে সঙ্কল্প লইয়া কলিকাতায় আসিয়াছি, তাহা সফল হয় নাই। কলিকাতার সাহিত্যিকদের সঙ্গে এখনও আমি পরিচিত হইতে পারি নাই। বোনকে বলিলাম, “বুবুজান, আমার জন্য আপনি ব্যস্ত হবেন না, কাল থেকে আমি উপার্জন করতে আরম্ভ করব।”
বুবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিভাবে উপার্জন করবিরে।”
আমি উত্তর করিলাম, “এখন তাহা আপনাকে বলব না। পরে জানাব।”
পরদিন সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া খবরের কাগজের অফিসে ছুটিলাম। তখনকার দিনে ‘বসুমতী’ কাগজের চাহিদা ছিল সবচাইতে বেশি। কয়েকদিন আগে টাকা জমা না দিলে হকাররা কাগজ পাইত না। ‘নায়ক’ কাগজের তত চাহিদা ছিল না। ‘বসুমতী’ অফিসে চার-পাঁচ দিন আগে টাকা জমা দেওয়ার সঙ্গতিও আমার ছিল না। সুতরাং পঁচিশখানা ‘নায়ক’ কিনিয়া বেচিতে বাহির হইলাম। রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া ‘নায়ক, নায়ক’ বলিয়া চিৎকার করিয়া ফিরিতে লাগিলাম। সারাদিন ঘুরিয়া পঁচিশখানা ‘নায়ক’ বিক্রয় করিয়া যখন বাসায় ফিরিলাম, তখন শ্রান্তিতে আমার শরীর অবশ হইয়া আসিয়াছে। পঁচিশখানা কাগজ বিক্রয় করিয়া আমার চৌদ্দ পয়সা উপার্জন হইল। আমার পরিশ্রান্ত-দেহে হাত বুলাইতে বুলাইতে বোন সস্নেহে বলিলেন, “তুই বাড়ি যা। এখানে এত কষ্ট করে উপার্জন করার কি দরকার। বাড়ি গিয়ে পড়াশুনা কর।”
চলবে…..